দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের মহল্লায় ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে দু’দল ছেলের মধ্যে মারামারি হয়। আমি তখন কলেজের ছাত্র। আমি নিজে ঐ সংঘর্ষে জড়িত না থাকলেও মহল্লার আট দশজন ছেলের সাথে আমাকেও আসামী করে মামলা দেওয়া হয়। মামলার বাদী ছিলেন একজন ডাকসাইটে পুলিশ কর্মকর্তা, যার ছেলে মারামারিতে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আমাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ থানায় নিয়ে যায় এবং সারা রাত নির্যাতন করে পরদিন কোর্টে চালান করে দেয়। আমার বাবা একজন এ্যাডভোকেট হওয়া সত্ত্বেও বাদীপক্ষের অনৈতিক দাপটের কারণে ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে জামিন না দিয়ে জেলে পাঠানোর হুকুম দেন।
প্রায় ছয় মাস রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকার পর আব্বার অক্লান্ত চেষ্টায় আমার জামিন হয়। কিন্তু কিছুদিন পর জামিন বাতিল করে কোর্ট থেকে আমার নামে আবার গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করা হয়। আমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে আব্বা আমাকে রাজশাহীতে রাখার ঝুঁকি নিলেন না। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য তিনি আমাকে চট্টগ্রামে আমার এক মামার বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে আমি তিন মাস আত্মগোপনে থাকি। সেটা ছিল ১৯৭৪ সালের শীতকাল।
মামা ছিলেন বয়সে তরুণ এবং একটি তেল কোম্পানির (সম্ভবতঃ শেল অয়েল) কর্মকর্তা। তিনি তখনো অবিবাহিত। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ এলাকায় একটি তিন তলা ফ্ল্যাট বাড়ির দোতলা ভাড়া নিয়ে তিনি থাকতেন। আবদুল নামে নোয়াখালীর এক দরিদ্র অথচ বিশ্বস্ত ছেলে (আমার সমবয়সী) মামার রান্নাবান্না করতো এবং বাসার সার্বিক দেখাশুনা করতো। মামা সকালে অফিসে চলে যেতেন, ফিরতেন রাত দশটা এগারোটার দিকে। মাঝে মাঝে তাকে দু’একদিনের জন্য ঢাকায়ও যেতে হতো। ফলে আবদুলকে বাসায় প্রায়ই নিঃসঙ্গ থাকতে হতো। আমি যাওয়ার পর কথা বলার একজন মানুষ পেয়ে আবদুল খুব খুশি। সে রান্নাবান্না ও ঝাড় পোঁছ করার ফাঁকে ফাঁকে আমার সাথে গল্প করতো। প্রথম প্রথম তার আঞ্চলিক ভাষা বুঝতে আমার একটু অসুবিধা হলেও পরের দিকে ঠিক হয়ে যায়।
সময়টা ছিল দুর্ভিক্ষের। চারদিকে অরাজক অবস্থা। সারা দেশে মানুষের খাবার অভাব। দেড় দুই টাকা সের চাল হঠাৎ করে দশ টাকায় উঠে যায়। গম বাজার থেকে উধাও। অন্যান্য খাদ্যপন্যের দাম আকাশচুম্বী। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুই মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) থেকে এক ধরণের অসিদ্ধ মোটা চাল আসতো, যা ছিল খাওয়ার অনুপযোগী। তবু সেই চাল পাওয়ার জন্য গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। আবদুল চকবাজারে বাজার করতে যেত। ফেরার পথে কোন কোন দিন রাস্তার পাশে হতদরিদ্র নিরন্ন মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে সে কেঁদে ফেলতো। বাসায় এসে মাথা চেপে ধরে বসে থাকতো সে। সেদিন সারাদিন কাজকর্মে তার মন বসতো না। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করতো না। আমি ভয়ে বাসা থেকে বেরতাম না। না খেতে পেয়ে মরে যাওয়া মানুষের লাশ দেখা আমার জন্য খুবই অস্বস্তিকর ছিল আর ছিল পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়। আমি সারাদিন বাসার ভেতর স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে থাকতাম।
বাসায় প্রতিদিন দলে দলে ভিক্ষুক আসতো। ক্ষুধার্ত ছিন্নবস্ত্র নারী, পুরুষ, শিশু। তাদের কংকালসার দেহ ও কোটরাগত চোখ দেখে আমার বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠতো। প্রচণ্ড শীতেও তাদের গায়ে ছেঁড়া ফাটা যৎসামান্য কাপড়। শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তারা অসহায়ের মতো হাত বাড়িয়ে দিত। বাড়ির তিন তলায় কেউ থাকতো না। এক তলায় বাড়ির মালিক নিজে পরিবার পরিজন নিয়ে বাস করতেন। তিনি দু’চার আনা পয়সা কাউকে কাউকে দিলেও কখনো চাল দিতেন না। ভিক্ষুকরা পয়সার বদলে এক মুঠো চালের জন্য হাহাকার করতো। আমি আসার আগে আবদুল কী করতো, জানিনা। কিন্তু আমি আসার পর মনিবের ভাগ্নে বলে আমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় সে তাকিয়ে থাকতো। আমি সবাইকে এক মুঠো করে চাল দিতে বললে সে খুব খুশি হতো।
এই ভিক্ষুকদের মধ্যে এক বৃদ্ধ ও তার দশ বারো বছর বয়সী ছেলের প্রতি আবদুল খুব সদয় ছিল। অন্য ভিক্ষুকদের সাথে খিচির মিচির করলেও এই বৃদ্ধকে সে কিছু বলতো না। তাকে এক মুঠোর জায়গায় দু’মুঠো চাল দিতেও সে দ্বিধা করতো না। ইনিয়ে বিনিয়ে আমার কাছ থেকে কিছু পয়সা নিয়ে সে বৃদ্ধের হাতে তুলে দিত। এই বৃদ্ধের প্রতি তার আলাদা মমত্ববোধের কারণ আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না।
একদিনের ঘটনা। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। পুরো চট্টগ্রাম শহর জবুথুবু। রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। আমি কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, বৃদ্ধ তার ছেলেটিকে সাথে নিয়ে আমাদের বাসার দিকে আসছে। দু’জনেই ঠক ঠক করে কাঁপছে। আবদুল আমার আগেই ওদের দেখতে পেয়েছে। সে খুব দ্রুত নিচে নেমে বাড়ির গেট খুলে ওদেরকে দোতলায় নিয়ে এলো। আবদুলের এই কাজে আমি খুব বিরক্ত হলাম। ফকির মিসকিনকে একেবারে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসাটা বাড়ির মালিকেরও পছন্দ নয়। তিনি আবদুলকে বকাঝকাও করলেন। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, বৃদ্ধ তার ছেলেকে নিয়ে দরজার সামনে দোতলার ল্যান্ডিং-এর ওপর বসে আছে আর আবদুল নিচু স্বরে তাদের কী যেন বলছে। আমাকে দেখে ওরা চুপ হয়ে গেল। ছেলেটি দু’হাত বুকের মধ্যে নিয়ে জড়সড় হয়ে ওর বাপের কোল ঘেঁষে বসে আছে আর দু’জনেই আতংকিত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ঠাণ্ডায় থর থর করে কাঁপছে ওরা। আমি আবদুলকে বললাম, ‘ওদের কিছু চাল আর আট আনা পয়সা দিয়ে বিদায় করে দাও।’
বৃদ্ধ হঠাৎ আমার পা জড়িয়ে ধরলো। তারপর আঞ্চলিক ভাষায় কাকুতি মিনতি করে যা বললো, তা’ এরকমঃ আজ তারা চাল বা পয়সা চায় না। আজ তার ছেলেটিকে যেন আমি একটা গরম কাপড় দেই। এই শীতে ছেলেটি যে আর বাঁচে না! একদিন অনাহারে থাকলেও বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু এই কনকনে শীতে ছেলেটি যে তার আজই মরে যাবে!
অবিশ্বাস্য অসহায় দৃষ্টিতে ওরা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ভয়ে ও ঠাণ্ডায় থর থর করে কাঁপছে দু’জনেই। আমি বাসার ভেতরে এসে আমার বেডরুমে দাঁড়িয়ে ভাবছি, কী করা যায়! আমার একটা ফুলহাতা সোয়েটার ও একটা উলেন জ্যাকেট ছিল। বিছানার দুটো চাদরের (বেডশিট) একটা আলনায় ঝোলানো ছিল। সেই চাদর ও জ্যাকেটটা নিয়ে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। জ্যাকেটটা ছেলেটির গায়ে পরিয়ে দিয়ে বিছানার চাদরটা বৃদ্ধের গায়ে জড়িয়ে দিলাম। তারপর আবদুলকে বললাম, ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? ওদের চাল আর পয়সা দিয়ে বিদায় করো।’
ওরা যাতে আবার আমার পা ধরতে না পারে, সেজন্য কোনরকম সুযোগ না দিয়ে আমি দ্রুত বাসার ভেতর ঢুকে পড়লাম। কিন্তু পা ধরার বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পেলাম না। ভিক্ষুকদের বিদায় করে এসে আবদুল আমার দুই পা জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললো। আমি ওকে ধমক দিলে পা ছেড়ে দিয়ে সে মেঝের ওপর বসে ফোঁপাতে লাগলো। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে জানালো, বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি তার বাবা এবং ছেলেটি তার ছোটভাই। নদী ভাঙ্গনে ভিটা মাটি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে ওরা এখন চট্টগ্রাম শহরে এসে ভিক্ষা করে।
( সত্য ঘটনা অবলম্বনে )
***************************************************************************************************************
(এই গল্পটি মাসিক মৌচাকে ঢিল পত্রিকার সেপ্টেম্বর/২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম।)
রি-পোস্ট
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৮:০৭