আতাউর নামে আমার এক আঁতেল কিসিমের বন্ধু আছে। সে আমার সব লেখাই পড়ে এবং ফোনে বা সাক্ষাতে সমালোচনা করার সুযোগ কখনো হাতছাড়া করে না। এই লেখাটিও সে পড়বে এবং ধুন্ধুমার সমালোচনা করবে, আমি নিশ্চিত। গল্পে তার আসল নাম উল্লেখ করার কারণে এই বুড়ো বয়সেও তার হাতে আমার ঘুষি খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তারপরেও আঁতলামির সাথে তার নামটা এত সুন্দরভাবে মানিয়ে যায় যে এই গল্পের একটা জম্পেশ শিরোনামের জন্য ঘুষি খাওয়ার ঝুঁকিটা নিতেই হলো।
তো আঁতেল আতাউর কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই ইন্টেলেকচুয়াল। সে হলো জ্যাক অফ অল ট্রেডস, বাট মাষ্টার অফ নান। তাকে দেখলে ‘বইয়ের পোকা’ শব্দগুলি আর আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করার দরকার হয় না। দাঁড়িয়ে, বসে বা শুয়ে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, তার হাতে একখানা বই নেই-এই দৃশ্য অকল্পনীয়। স্কুল জীবন থেকে বর্তমানের অবসর জীবন পর্যন্ত তার বইপ্রেম একই রকম। ডায়াবেটিসের কারণে প্রতিদিন সকালে তাকে হাঁটতে হয়। এই সময়েও তার হাতে একখানা বই থাকে। হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে গেলে রাস্তার ধারে বসে সে বইয়ের দুটো পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে জিরিয়ে নেয়, তারপর আবার হাঁটা ধরে।
সত্যি কথা বলতে কী, আতাউরের কারণেই জীবনে আমার অনেক বই পড়া হয়েছে। স্কুল জীবন থেকে সে আমাকে বই ধার দেয় এবং ধারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ছোটলোকের মতো অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বই কেড়ে নেয়। এ কারণে অনেক ভালো ভালো বইয়ের শেষ অংশ আমার পড়া হয়নি।
তবে আতাউর পড়া ছাড়া কখনো লেখার চেষ্টা করেনা। সে হলো বিশুদ্ধ পাঠক। আমি জীবনে কোনদিন তাকে লেখালেখি করতে দেখিনি। এ ব্যাপারে তার কোন আগ্রহও নেই।
২০১১ সালে আমার লেখা উপন্যাস ‘স্বপ্ন বাসর’ প্রকাশিত হলে আঁতেল আতাউরকে একটা সৌজন্য কপি দিলাম। সকালে বই হাতে পেয়ে সে আলোর গতিতে পড়া শেষ করে বিকেলে আমাকে ফোন দিল। বললো, ‘এক্ষুনি আমার বাসায় চলে আয়। শাহীনা (আতাউরের ছেলে-বউ) তোর আর আমার জন্য ডালপুরি বানাচ্ছে। তুই না আসা পর্যন্ত আমি কিন্তু খাচ্ছি না।’
বুঝলাম, আমার কপালে অনেক দুঃখ আছে। কিন্তু কী আর করা! স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে আতাউর নিঃসঙ্গ। বাসায় তার ছেলের বউ আর বাইরে আমি ছাড়া তাকে সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ নেই। তাই প্রচুর সমালোচনা হজম করার মতো মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ওর বাসায় গেলাম। বাসায় ড্রইং রুমের একটা অংশ এক কালে কয়েকটা শো-কেস দিয়ে পারিবারিক লাইব্রেরীর মতো করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পুরো বাড়িটাই লাইব্রেরী। একমাত্র বাথরুম ছাড়া সব ঘরে মেঝের ওপর বইয়ের স্তূপ। এ রকম কয়েকটা স্তূপের আড়ালে আমার উপন্যাসটা হাতে নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে আতাউর। আমাকে দেখে সে হাত ইশারায় মেঝের ওপর বসতে ইঙ্গিত করে বললো, ‘এই বুড়ো বয়সে লাভ স্টোরি লেখার কুবুদ্ধি তোকে কে দিয়েছে?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘না, মানে সেলফ বায়োগ্রাফিক্যাল নভেল তো! আর তুই তো আমার সবই জানিস ভাই!’
‘হাঁ জানি। উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে তো আমি কিছু বলছি না। কিন্তু এসব প্রেম ভালোবাসা নিয়ে লেখালেখি করবে ছেলে ছোকরারা। তুই লিখবি ক্ল্যাসিক উপন্যাস। মাদার, ওয়ার এ্যান্ড পিস, দি ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দি সী, আঙ্কেল টম’স কেবিন।’
‘ওগুলো তো লেখা হয়ে গেছে। আমি আবার নতুন করে কী লিখবো?’
‘আরে ব্যাটা গর্দভ! ওগুলো লিখতে তোকে কে বলেছে? ওরকম ক্ল্যাসিক উপন্যাস লিখে দেখা। তবে তো বাংলা সাহিত্যে অমর হতে পারবি! উঠতি বয়সের মেয়ে পটানো নভেল লিখে ব্যাটার লেখক হওয়ার শখ!’
আমি চুপ করে আছি দেখে আঁতেল আতাউর বললো, ‘তোর দ্বারা হবে না। তুই তো অতো উঁচু মাপের লেখক না। তা’ছাড়া তুই লেখালেখি শুরু করলি কবরে যাওয়ার আগে। সব কিছুর একটা পিক পিরিয়ড থাকে, বুঝলি? এই জেনারেশনের পাঠকরা তোর মতো বুড়ো হাবড়ার লেখা পড়বে কেন?’
আমি বললাম, ‘এই জেনারেশনের পাঠকরা হুমায়ূন, সুনীল, শীর্ষেন্দু এদের মতো বুড়ো হাবড়াদের লেখাই তো পড়ছে।’
আতাউর রেগে গিয়ে বললো, ‘তুই কী তাদের মতো চল্লিশ পঞ্চাশ বছর ধরে লিখছিস? মাত্র এক বছর আগে লেখা শুরু করে ব্যাটার আঁতেল আঁতেল কথা! বানান শুদ্ধ করে লিখতেই তো তোর মতো গর্দভের দু’চার বছর চলে যাবে। ব্যাটা হুমায়ূন সুনীলের সাথে নিজের তুলনা করছে। আহাম্মক কোথাকার!’
এরপর আমার কী লেখা উচিৎ, কীভাবে লেখা উচিৎ, কেন লেখা উচিৎ-এসব বিষয়ে আঁতেল আতাউর রবীন্দ্রনাথ, হেমিংওয়ে ও বার্নার্ড শ’র রেফারেন্স সহ বেশ কিছু মূল্যবান পরামর্শ দিল। ইতিমধ্যে তার ছেলের বউ শাহীনা ডাইনিং টেবিলে গরম গরম ডালপুরি, আলুর চপ, নিমকি ও টমেটো সস পরিবেশন করে আমাদের ডাকতে এসেছে। এই মেয়েটা দুই বছর হলো বিধবা। ঢাকা থেকে বিমানযোগে রাজশাহী ফিরে আতাউরের স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র ফারুক বিমানের মাইক্রোবাসে এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফিরছিল। পথে ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে দু’জনেই মারা যায়। এরপর থেকে নিষ্প্রাণ মেয়েটা শ্বশুরকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। আমরা খেতে বসলে সে আমাকে বললো, ‘চাচা, আপনি একটু আব্বাকে বোঝান তো। বই পড়তে গিয়ে দুপুরে আব্বার গোসল, খাওয়া, নামাজ কিচ্ছু হয়নি। ডায়াবেটিসের রোগী, এসব অনিয়ম করলে......।’বলতে বলতে শাহীনা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিরব হয়ে গেল।
আমার খুব রাগ হলো। বললাম, ‘এটা কেমন কথা হলো আতা? গোসল খাওয়া বাদ দিয়ে বই পড়া?’
শাহীনা বললো, ‘উপন্যাসে আপনি কী লিখেছেন, আমি জানিনা। আপনি আসার দশ মিনিট আগেও আব্বা উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠাগুলো বার বার পড়ে চোখ মুছছিলেন। এই বয়সে এমন ইমোশন শরীরের জন্য ক্ষতিকর। আব্বাকে সেটা আমি বোঝাতে পারছি না, চাচা।’
আতাউর অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললো, ‘আরে বাবা, বাধ্য হয়ে অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়। থার্ড ক্লাস কোয়ালিটির লেখা জেনেও পড়লাম। হেনা আমার ছোটবেলার বন্ধু। সে শখ করে একটা উপন্যাস লিখেছে। না পড়ে ফেলে রাখবো, বলো?’
পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হলে আঁতেল আতাউর কখনো কখনো আমাকে ফোন করে খবর দেয়। বলে, ‘তোর একটা উদ্ভট লেখা ছাপা হয়েছে পত্রিকায়।’ আবার কখনো কখনো আমাকেও খবর দিতে হয় ওকে। পত্রিকায় বা ব্লগে লেখা প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওর ফোন না পেলে বুঝতে পারি আতাউর জানে না। তখন ওকে ফোন করে বলি, ‘আমার একটা থার্ড ক্লাস কোয়ালিটির লেখা বেরিয়েছে দোস্ত্। পড়ে দেখিস।’ লেখা পড়ার পর আতাউর আমাকে ফোন করে জানায়, ‘তোর আরও পড়াশুনা করার দরকার আছে।’
একদিন স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক লিয়াকত সাহেবের সাথে দেখা হলে তিনি বললেন, ‘আপনার বন্ধু আতাউর সাহেব আমাদের খুব জ্বালাতন করছেন।’
‘আতাউর জ্বালাতন করছে? কী রকম?’
‘উনি প্রায় প্রতিদিন ফোন করে জানতে চান আপনি কোন লেখা দিয়েছেন কী না।’
‘সে কী! আমাকে ফোন করলে তো আমিই বলে দিই। অহেতুক আপনাদের জ্বালাতন করে কেন?’
‘সেটা আপনি তাকে একটু বলে দিয়েন বড় ভাই।’
আমি আতাউরকে ফোন দিলাম। বললাম, ‘এই পাঁঠা, সারাজীবন এত বই পড়ে তুই পাঁঠাই থেকে গেলি। মানুষ হতে পারলি না।’
আতাউর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন, কী হয়েছে?’
‘তুই লিয়াকত সাহেবকে রোজ রোজ ফোন করে জ্বালাতন করিস কেন? পত্রিকায় কী রোজ রোজ কারো লেখা ছাপা হয়? ঢাকা বা রাজশাহীর কোন পত্রিকা বা অনলাইনে লেখা বেরলে আমিই তোকে ফোন করে জানাবো। ঠিক আছে? অহেতুক মানুষকে ডিস্টার্ব করিস না।’
আতাউর ক্ষেপে গিয়ে বললো, ‘তোর লেখা বেরিয়েছে কী না, আমি খোঁজ করতে যাবো কেন? তেলাপোকাও একটা পাখি আর তুইও একটা লেখক! যা ব্যাটা! জীবনে আর তোর লেখা পড়বো না।’
‘ঠিক আছে, পড়িস না।’
আতাউরের সাথে এর আগেও কয়েকবার কথা কাটাকাটি করে আমার সম্পর্কচ্ছেদ হয়েছে। পরে আবার কীভাবে তা’ জোড়া লেগেছে বলা মুশকিল। এবার ওর ওপর ভীষণ রাগ হলো। বাসায় এসে বনফুলের ‘পাঠকের মৃত্যু’ গল্পের একটা ফটোকপি খামে ভরে ডাকযোগে ওর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। ওর তরফ থেকে উত্তর পেলাম হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে।
কড়া ঘুমের ওষুধে পৃথিবীর কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম আমি। চলছিল অক্সিজেন ও স্যালাইন। বলছি গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের কথা। হার্ট এ্যাটাকের পর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে পুরো একটা দিন ও রাত আমি ঘুমের ঘোরে অচেতন অবস্থায় ছিলাম। অথবা হয়তো কোমায় ছিলাম। ঠিক জানি না। তবে এটুকু মনে আছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল। ভর্তি হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে অনেক গুলো ইনজেকশন দেওয়া হয়। পরে ছেলেদের কাছে শুনেছি, প্রথম রাতটা নাকি আমাকে নিয়ে আজরাইলের সাথে ডাক্তারদের অনেক টানাহেঁচড়া হয়েছে।
দ্বিতীয় দিন ঢুলু ঢুলু চোখে আমার বেডের চারপাশে তাকিয়ে দেখি, আমার স্ত্রী ও দুই ছেলের পাশাপাশি আতাউরও উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ওদের দেখে হাসার চেষ্টা করলাম। ডাক্তার ও নার্স এসে আমার স্ত্রী ছাড়া সবাইকে বেডের পাশ থেকে সরিয়ে দিল। আতাউর আমার ছেলেদের সাথে কেবিনের বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়ে একটা বই পড়ে একবেলা কাটিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে গেল।
পরদিন সে আবার এলো। তারপরদিন আবার। মুখে কোন কথা নেই। চুপচাপ আমার বেডের পাশে কিছুক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর চলে যায় করিডোরে, সেখানে বই পড়ে কিছু সময় কাটায়, তারপর আমার স্ত্রীর কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায় বাসায়। অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও চেনাজানা লোকজন আসে আমাকে দেখতে। কিন্তু তাদের সাথে আমার কথাবার্তা বলা নিষেধ। এমনকি আমার ছেলেদের সাথে কথা বললেও ডাক্তার রাগারাগি করে। খুব প্রয়োজনীয় দু’একটা কথা হয় স্ত্রীর সাথে। আতাউরকে দেখে বুঝতে পারি, সে কিছু বলতে চায় আমাকে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বলতে পারে না।
পঞ্চম দিন আতাউর এলো ওর বৌমাকে নিয়ে। অন্যান্য দিনের মতো আমার স্ত্রীর কাছে নিম্ন স্বরে আমার শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নিয়ে সে শাহীনাকে কেবিনে রেখে করিডোরে গিয়ে দাঁড়ালো। আমি ইশারায় আমার স্ত্রীকে কাছে ডেকে ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, ‘আতাকে আমার কাছে আসতে বল।’
আমার স্ত্রী একটু ইতস্ততঃ করে আতাউরকে ডেকে নিয়ে এলো। আমি ওকে পাশে বসতে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘কিছু বলবি?’
আতাউর কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইল। আমি ক্লান্ত স্বরে বললাম, ‘ডাক্তারের আসার সময় হয়েছে। তোকে কিন্তু এখানে থাকতে দেবে না।’
আতাউর আমার বালিশের পাশে রাখা চশমাটা তুলে যত্ন করে আমার চোখে পরিয়ে দিয়ে ওর বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে আমাকে দেখালো। কাগজে বড় বড় করে লেখা আছে, “পাঠকের মৃত্যু হলে লেখালেখি করবি কার জন্যে? তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ্। তোর দ্বিতীয় উপন্যাসের কয়েকটা অধ্যায় লেখা বাঁকি আছে বলেছিলি। সেটা শেষ করতে হবে না?”
আমি আতাউরের কাগজ ধরা দুটো হাতের একটা নিজের হাতের মধ্যে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আতাউর ভেজা ভেজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বাড়িয়ে দিল হাতটা।
[ সত্য ঘটনা অবলম্বনে ]
**********************************************************************************************************************
রি-পোস্ট
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১৬ সকাল ৮:০৭