ভূমিকা:
কয়েকটি প্রশ্ন অনেকের মাঝেই ঘুরপাক খায়। প্রশ্নগুলো হলো,
১.“মেধাবীরা অনেক ক্ষেত্রে ইসলামী সংগঠনে কেনো সক্রিয় হচ্ছে না?
২.দায়ী কি সংগঠন নাকি মেধাবী নিজেই?”
এ প্রশ্নসমূহের সঠিক জবাব খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
নিরপেক্ষ মন নিয়ে পর্যালোচনা করা উচিত:
উপরিউক্ত প্রশ্নগুলোর জবাব কোনো পক্ষের বা কারোর বিপক্ষের না হয়ে ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। আর অন্ধভাবে কেবল একটি পক্ষের হয়ে ওকালতি করাটা উচিত হবে না।
আলোচ্য বিষয়ের লেখাটি সংগঠনে সক্রিয় এবং মেধাবীদের গুরুত্ব অনুধাবন করেন এমন লোকদের পক্ষ থেকে আসলে সেটা হয়তো ঝোকপ্রবণতার উর্ধ্বে থাকবে এবং কোনো বিশেষ পক্ষের অন্ধ প্রশংসা বা অন্ধ সমালোচনার দোষে দুষ্ট হবে না।
লেখক মনে করেন, তিনি নিজে মেধাবী নন এবং তিনি কখনো নিষ্ক্রিয়ও ছিলেন না। সবসময় হয় তাকে সংগঠন ধরে রেখেছে অথবা তিনিই সংগঠনকে আঁকড়ে ধরেছেন। সুতরাং লেখকের বক্তব্য কোনোরকম বিদ্বেষপ্রসূত বা ‘গায়ে লেগেছে তাই ক্ষেপেছে’ ধরনের নয় (আলহামদুলিল্লাহ)।
মেধাবী কারা?
যারা স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্য প্রতিষ্ঠানে ভালো বিষয়ে ভালো রেজাল্টধারী এবং সাহিত্য, সংস্কৃতি বা অন্য বিভিন্ন কাজে বিশেষভাবে পারদর্শী- এ ধরণের লোকেরাই সাধারণত মেধাবী হিসেবে সর্বস্তরে স্বীকৃত।
ইসলামে জ্ঞানীদের অগ্রাধিকার রয়েছে:
সৎ লোক যদি মূর্খ হয় তাহলে তার দ্বারা কল্যাণকর রাষ্ট্র ও আদর্শবাদী দল গড়ার কাজ সুচারুরূপে সম্পাদিত হতে পারে না। তাই, কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা,
“বলো, (হে নবী!) যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি কখনও সমান হতে পারে?” (৩৯/সূরা আয যুমার:৯)
আল্লাহ আরও বলেন,
“আর ক্ষমা করার অভ্যাস গড়ে তোলো, সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং মূর্খ-জাহেলদের থেকে দূরে সরে থাকো।” (৭/সূরা আল আরাফ:১৯৯)
মেধাবীরাই সর্বত্র নেতৃত্বদানের অধিক উপযোগী:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলনে মেধাবী লোকেরা সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অবশ্য বাংলাদেশের অবস্থা ব্যতিক্রম।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী ছাত্র সংগঠনের সাবেক একজন কেন্দ্রীয় সভাপতি মালয়েশিয়া, তুরস্ক, শ্রীলংকা ইত্যাদি দেশে ঘুরে এসে আফসোসের সাথে উপরিউক্ত সত্য স্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি বিভিন্ন দেশে গেলাম। সব জায়গায় দেখি কেন্দ্রীয় কমিটির শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ সদস্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ, উচ্চস্তরের আলিম প্রভৃতি। আফসোস, বাংলাদেশে ১-২ জনও নেই!
চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ‘সে সকল দেশে মেধাবীরা ও পেশাজীবীরা নেতৃত্ব দিতে পারলে, সময় দিতে পারলে এবং কর্মী হতে পারলে বাংলাদেশে কেনো পারছে না’?
কার্যক্ষেত্রে প্রজ্ঞাবানের বিকল্প নেই:
১.আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তর্দৃষ্টি, সচেতনতা, বুদ্ধি ও বিবেচনা শক্তি অপরিহার্য। শুধু সততা যথেষ্ট নয়।
২.বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাশীল লোকেরাই সাধারণত সমাজ চালায়।
৩.প্রত্যেক রাষ্ট্রের ভিত হলো মূলত সে দেশের সুশিক্ষিত সমাজ।
৪.প্রজ্ঞার অভিব্যক্তি হচ্ছে- (ক)মনস্তত্ব অনুধাবন করে কথা বলা (খ)রোগ অনুযায়ী চিকিৎসা করা (গ)কৌশলে প্রতিবন্ধকতা দূর করা (ঘ)পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রাখা (ঙ)সময় অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ (চ)বিধি-নিষেধ এর কারণ, যৌক্তিকতা ও ফলাফল জানা ইত্যাদি। এসকল কাজ দুর্বল বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের দ্বারা সুচারুরূপে সম্পাদিত হওয়া সম্ভব নয়।
মৌলিক মানবীয় গুণ ছাড়া বিজয় অর্জন করা যায় না:
ব্যক্তি ঈমানদার বা কাফির (তথা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) যাই হোক না কেনো নিম্নোক্ত গুণগুলো থাকলে বিজয় সাধারণত সুনিশ্চিত। গুণগুলো হলো: প্রবল বাসনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণশক্তি, সাহসিকতা (আত্মপ্রত্যয়), সহিষ্ণুতা, ত্যাগ, বীরত্ব, পরিশ্রমপ্রিয়তা, লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সবকিছু উৎসর্গ করার প্রবণতা, সতর্কতা, দূরদৃষ্টি, অন্তর্দৃষ্টি, বোধশক্তি, বিচারক্ষমতা, উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ ও সকল পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ার যোগ্যতা, আকৃষ্ট করার ও প্রভাব সৃষ্টি করার যোগ্যতা ইত্যাদি। চিন্তা করলে বুঝা যায় আত্মপ্রত্যয়, সতর্কতা, দূরদৃষ্টি, অন্তর্দৃষ্টি, বোধশক্তি, বিচারক্ষমতা, আকৃষ্ট করে প্রভাব সৃষ্টির যোগ্যতা ইত্যাদি গুণগুলো মূলত মেধাবী ও প্রতিভাবান লোকদের মাছেই বিদ্যমান থাকে।
রাষ্ট্র ও দলের বিভিন্ন কাজে মেধাবী ও যোগ্য লোক অপরিহার্য:
রাষ্ট্রের অনেক বিভাগ রয়েছে যেগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জ্ঞানী, মেধাবী ও দক্ষ জনবল আবশ্যক। যেমন: প্রশাসনিক বিভাগ, দূত ও প্রতিনিধি প্রেরণ বিভাগ, অনুবাদ বিভাগ, দাওয়াহ (প্রচার) বিভাগ, প্রতিরক্ষা বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, নিরাপত্তা বিভাগ, সমরাস্ত্র নির্মাণ ও সংরক্ষণ বিভাগ, বিচার বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ, জনস্বাস্থ্য বিভাগ, পরিসংখ্যান বিভাগ, নগর উন্নয়ন ও প্রকৌশলী বিভাগ, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি। যে কাউকেই উপরিউক্ত বিভাগগুলোতে দায়িত্ব দিলে চলে না। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষ ও মেধাবী লোকদেরকেই উক্ত দায়িত্ব দিতে হয়।
কিছু কিছু কাজ জ্ঞানী, মেধাবী ও প্রজ্ঞাবানদের ছাড়া সম্পাদন করানো কঠিন বা অসম্ভব:
১.নির্ভুল পরিকল্পনা গ্রহণ, সংবিধান প্রণয়ন, রাষ্ট্রের ও দলের সফল পরিচালনা
২.ইসলাম ছাড়া অন্য আদর্শ বা ধর্মের (যেমন: পুঁজিবাদের, কমিউনিজমের) ত্রুটি প্রমাণ করা। যেমন: অর্থনৈতিক সমস্যার ফ্যাসিবাদী সমাধানের ব্যর্থতা প্রমাণ, নতুন নতুন অর্থনৈতিক প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ জবাব দান, আধুনিক যুগে ইসলামী ব্যাংকিং ও বীমা এর রূপরেখা প্রণয়ন
৩.আদর্শ প্রচারের বিজ্ঞানসম্মত কর্মনীতি তৈরি
৪.গুপ্ত সংস্থা ও সংগঠনের বিপক্ষে যুক্তিশীল লেখনীর দ্বারা গণসচেতনতা সৃষ্টি
৫.শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনে মৌলিক ও বাস্তবসম্মত দিক-নির্দেশনা প্রদান
৬.ইসলামী সংস্কৃতির ধারণা বিশ্লেষণ ও বাস্তবায়ন
কুরআনের কিছু বিজ্ঞান সম্পর্কিত আয়াত মেধাবী বিজ্ঞানীরাই ঠিকমতো বুঝে থাকে:
১.“তিনি সেই সত্তা, যিনি রাত, দিন এবং সূর্য, চন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকেই তার বৃত্তাকার পথে পরিভ্রমণ করছে।” (২১/সূরা আম্বিয়া:৩৩)
২.“নভোমণ্ডল এবং ভূমণ্ডলে অণু পরিমাণ কোনো কিছু তাঁর থেকে অজ্ঞাত নেই, না তা থেকে ক্ষুদ্র না তা থেকে বৃহৎ, বরং এক সুস্পষ্ট কিতাবে তা সংরক্ষিত।” (৩৪/সূরা সাবা:৩)
৩.“এবং তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, অত:পর যমীনের মৃত্যুর পর তাকে এর সাহায্যে জীবন দান করেন।” (৩০/সূরা রূম:২৪)
৪.“তিনিই স্বীয় অনুগ্রহের শুরুতে সুসংবাদবাহীরূপে বায়ু প্রেরণ করেন..।” (২৫/সূরা আল ফুরকান:৪৮)
৫.“এবং আমি পৃথিবীতে পর্বতমালা খাড়া করে দিয়েছি, যাতে সেগুলো নিয়ে পৃথিবী ঢলে না পড়ে।” (২১/সূরা আম্বিয়া:৩১)
৬.“তিনি আল্লাহ, যিনি দুই সমুদ্রকে মুক্তভাবে প্রবাহিত করেছেন, একটি হলো মিষ্ট ও সুস্বাদু, আর অপরটি হল লবণাক্ত এবং বিস্বাদ এবং উভয়ের মাঝে তিনি এক প্রাচীর ও এক দুর্বোধ্য বিভাজক নির্মাণ করেছেন।” (২৫/সূরা আল ফুরকান:৫৩)
৭.“মহামহিম সেই সত্তা, যিনি প্রতিটি বস্তুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন, যা যমীন উৎপাদন করে, এমনকি তাদের নিজেদের প্রজাতি অথবা সে সব বস্তু, যা তারা জানেও না।” (৩৬/সূরা ইয়াসীন:৩৬)
৮.“তার (বা মৌমাছির) পেট থেকে নির্গত হয় বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত এক প্রকার পানীয় (মধু), যার মধ্যে রয়েছে, মানুষের জন্য আরোগ্য শক্তি।” (১৬/সূরা নাহল:৬৯)
৯.“আর তোমাদের জন্য গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুদের মধ্যেও শিক্ষা রয়েছে। তাদের পেটের মধ্য হতে অন্ত্ররস এবং দুধের মধ্য থেকে নিষিক্ত এক প্রকার পানি আমি তোমাদের পান করাই- তা হল খাঁটি দুধ, যা পানকারীদের জন্য খুবই উপাদেয়।” (১৬/সূরা আন নাহল:৬৬)
১০.“এবং আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির এক সারবস্তু থেকে; তারপর তাকে এক সুনির্দিষ্ট সংরক্ষিত স্থানে শুক্র-কণা হিসেবে গঠন করেছি। তারপর শুক্র-কণাকে জমাট বাধা রক্তে পরিণত করেছি; অত:পর ঐ জমাট বাধা রক্তকে মাংসল পিণ্ডের আকারে গঠন করেছি। তারপর ঐ মাংসল পিণ্ড থেকে অস্থি-মজ্জা বানিয়েছি এবং অস্থি-মজ্জাগুলোতে মাংস দিয়ে আচ্ছাদিত করেছি। শেষ পর্যন্ত তাকে সৃষ্টির এক নতুন রূপে উন্নীত করেছি। ফলত: আল্লাহ হলেন বড়ই বরকতময়, যিনি সর্বোত্তম স্রষ্টা!” (২৩/সূরা আল মুমিনুন:১২-১৪)
১১.“মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার অস্থিগুলোকে একত্র করতে পারব না? কখনো না, বরং আমি তো তার অঙ্গুলির ছাপকেও (পুনরায়) সুবিন্যস্ত করতে সক্ষম।” (৭৫/সূরা কিয়ামাহ:৩-৪)
১২.“আমার নিদর্শনসমূহের প্রতি যেসব লোক অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে, নিঃসন্দেহে আমি তাদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করব। যখন তাদের চামড়াগুলো জ্বলে-পুড়ে গলে যাবে, তখন তদস্থলে অন্য চামড়া পাল্টে দেবো, যেনো তারা আযাবের স্বাদ পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে।” (৪/সূরা আন নিসা:৫-৬)
প্রজ্ঞা ও যোগ্যতার আরও কিছু দিক:
১.ভাষাজ্ঞান:
শুদ্ধ ভাষা জানা ও জানানোর ব্যাপারেও প্রয়োজন যোগ্য ও মেধাবী মানুষ। এ সকল যোগ্যদের দ্বারাই ইসলামের বেশি উপকার হওয়া সম্ভব।
(ক)মহানবী (সা.) বিশুদ্ধ ভাষা চর্চার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন।
(খ)রাসূল (সা.) তাঁর দরবারে কবিদের স্থান দিতেন। হযরত হাসসান (রা.) ছিলেন তাঁর দরবারের প্রধান কবি।
(গ)একবার এক কাফির কবি ছন্দ মিলিয়ে মহানবী (সা.) কে অপদস্থ করছিলো। রাসূল (সা.) বলেছিলেন, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার লোক পেয়েছি। এবার কাব্য দিয়ে সাহায্য করবে এমন কেউ আছে কি? এর পর কাফেরদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেওয়া হয় (বিভিন্ন সাহাবী রচিত কাব্য-সাহিত্যের মাধ্যমে)।
২.কন্ঠশক্তি:
কন্ঠশিল্পীরাও এক ধরনের মেধাবী ও প্রতিভাবান। তাদেরকে বিশেষভাবে ইসলামের স্বার্থে কাজে লাগানো উচিত।
(ক)রাসূল (সা.) বলেছেন- “তোমার কণ্ঠধ্বনী দ্বারা কুরআনের আবৃত্তিকে সুমধুর করে তোলো। সকল বস্তুর অলংকার রয়েছে; পাক কুরআনের অলংকার হল সুমধুর সুর।”
(খ)ঈদ, বিয়ে ইত্যাদি সময়ে নির্দোষ আনন্দময় সঙ্গীতের অনুমতিও আছে ইসলামে।
(গ)আল্লাহ বলেন, “মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর রাস্তা থেকে লোকদের দূরে সরানোর জন্য ‘আল্লাহ থেকে গাফেল করার মতো কথা’ (বা গান-বাদ্য) সংগ্রহ করে এবং আল্লাহ প্রদর্শিত পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের বিষয় বানায়। এ ধরনের লোকদের জন্য রয়েছে অপমানকর শাস্তি।” (৩১/সূরা লুকমান:৬)
(ঘ)অপসংস্কৃতিমুক্ত থাকতে হলে ইসলামের পক্ষে শিল্পীর প্রয়োজন।
৩.শারীরিক সক্ষমতা:
ক্রীড়াতেও প্রতিভাবান লোক আছে যাদের মূল্যায়ন করা কর্তব্য। ইসলাম, মন ও দেহের বিকাশের জন্য ঘোড়দৌড়, তীরন্দাজী, বল্লম চালনা, কুস্তি ইত্যাদি খেলায় উৎসাহিত করে।
উপযুক্ত পরিকল্পনা, নিরপক্ষে বাছাই, পরিচর্যা, মূল্যায়ন, ক্ষেত্র সৃষ্টি, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিভিন্ন কার্যাবলীর সফল বাস্তবায়নের দ্বারা উপরিউক্ত ক্ষেত্রসমূহে সফল, সার্থক ও যোগ্য ব্যক্তিসমষ্টি গড়ে তোলা সম্ভব।
মেধাবীদের ব্যাপারে অভিযোগ ও পর্যালোচনা (এক):
অভিযোগ: “মেধাবীরা বুদ্ধিজীবি হতে চায়, বেশি বুঝে, বৈঠকে বেশি কথা বলে, জটিল কথা বলে এবং খালি প্যাচায়। ওদের কথায় কান দিলে চলে না।”
পর্যালোচনা: এই জাতীয় কথা আসলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করারই একটি পরিশিলিত রূপ। অথচ, আল্লাহ বলেন, “তোমাদের কোনো সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়কে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে যেনো বিদ্রুপ ও ঠাট্টা না করে।” (৪৯/সূরা হুজুরাত:১১)
১.উপরিউক্ত অভিযোগে একচেটিয়াভাবে সে লোকদেরকেই দায়ী করা হয়েছে যারা সংগঠনকে ভালোবেসেও সক্রিয় নন। এ ধরনের অভিযোগে অনেক সময় মেধাবীদের নিস্ক্রিয়তার সমালোচনা করা হলেও ভালোবাসার প্রশংসা করা হয়না। কিন্তু আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা কাফির (বা সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের) বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে না মুমিনদের বাদ দিয়ে।” (৪/সূরা আন নিসা:১৪৪) অর্থাৎ, মুমিন ব্যক্তিকে বন্ধু বানানো যেতে পারে। এমনকি ইসলামের প্রতি তার ভালোবাসাটাও মূল্যবান। সক্রিয় না হলেই ভালোবাসা যাবে না- এমন কোনো কথা নেই। আর কাউকে ভালোবাসলে তাকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু বানানো সমীচীন নয়।
২.আল্লাহ আরও বলেন, “ভাল ও মন্দ সমান নয়। যা উৎকৃষ্ট তা দিয়ে মন্দকে প্রতিহত করো, ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো হয়ে যাবে।” (৪১/সূরা হা মীম সিজদা:৩৪) ইসলাম এভাবে সকল ঈমানদারদেরকে আপন করে নিতে শেখায়; কোনো ঈমানদারকে দূরে ঠেলে দিতে শেখায় না।
৩.কেনো মেধাবীরা সক্রিয় হচ্ছেন না সেটার কারণও নিরপেক্ষভাবে উদঘাটনের চেষ্টা করা প্রয়োজন। অনেক সময় একচেটিয়াভাবে মেধাবীদেরকে ‘বনী ইসরাইলের’ (স্বার্থপরতার) সাথে তুলনা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এ ধরণের বক্তব্যে মেধাবীরা আকর্ষিত হবে নাকি বিকর্ষিত হবে- তা সহজেই অনুমেয়। মেধাবীদেরকে বিকর্ষিত করার মধ্যে সাফল্যের কারণ নিহিত নয়। মহান আল্লাহ বলেন, “আর আপনার প্রতি আল্লাহর রহমত থাকার কারণে আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলেন। কিন্তু যদি আপনি কর্কশ স্বভাব ও কঠোর হৃদয়ের হতেন, তবে তারা আপনার আশ-পাশ থেকে সরে পড়তো। সুতরাং আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৫৯)
অভিযোগ ও পর্যালোচনা (দুই):
অভিযোগ: “মেধাবীদের মূল্যায়ন পেতে চায়, মূল্যায়ন না পেলে যতো ভালো কাজই হোক খুব কম মেধাবীই সে কাজটি করতে চায়।”
পর্যালোচনা: ইসলামী ধারণা মতে, মানুষের কাছে মূল্যায়ন আশা না করে কেবল আল্লাহর সন্তোষকেই লক্ষ্য বানানো উচিত। কুরআনের ঘোষণা, “আপনি বলুন, আমার সলাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।” (৬/সূরা আল আনআম:১৬২)
১.যোগ্য ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করার শিক্ষাও দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ বলেন, “স্বৈরতন্ত্রী ও রাজা-বাদশাহরা যখন কোনো জনবসতির উপর কর্তৃত্ব লাভ করে তখন তারা সেই জনবসতিটিকে ধ্বংস করে এবং তার সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে বানায় সর্বাধিক লাঞ্ছিত ও অপমানিত। তাদের এরূপ কাজ চিরন্তন।” (২৭/সূরা আন নমল:৩৪) তাই, আমাদের কাজ হবে স্বৈরতন্ত্রী না হয়ে মূল্যায়নের হকদারকে মূল্যায়ন করা।
২.মেধাবীদের মূল্যায়ন না করাটাও ইসলামবিরোধী এবং মানুষের সন্তোষকে লক্ষ্য বানানোও ইসলামবিরোধী।
৩.মূল্যায়ন চাওয়া একটি মানবিক দুর্বলতা যা মেধাবী-অমেধাবী সকলের মাঝেই বিদ্যমান। অমেধাবীরা কি মূল্যায়ন পেতে চায় না? মূল্যায়ন চাওয়ার রোগটি কি কেবল মেধাবীদের?
৪.আল্লাহর কোনো দয়া যে বান্দার মাধ্যম হয়ে আসে সেই বান্দার প্রতিও কৃতজ্ঞতা পোষণ করার শিক্ষা দেয় ইসলাম। মানুষকে খুশি করা আর যোগ্যকে মূল্যায়ন করাতে কোনো দোষ নেই; দোষ আছে মানুষের সন্তোষকে লক্ষ্য বানানোর মধ্যে।
৫.ড: মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, “যে জাতি গুণের কদর করতে জানে না, সেখানে গুণী জন্মায় না।” তার কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে, গুণীর কদর অবশ্যই থাকা উচিত। হাদীসে সবচেয়ে যোগ্য লোককে নেতা বানানোর আদেশ কি অকারণে ও অযৌক্তিকভাবে দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্বাস করা যেতে পারে?
৬.যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়াটা বিপর্যয়ের উৎস। বেশি ভারী বস্তু কখনো হালকা বস্তুর সাথে তুলনাযোগ্য হতে পারে না। সঙ্গত কারণে আল্লাহ বলেন, “তোমরা মাপে ঠিক দাও, কারো ক্ষতি করো না এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ঠিকমতো ওজন করো।”(২৬/সূরা আশ শুআরা:১৮১-১৮২)
৭.ধরা যাক, একজন লোক জীবনের সর্বক্ষেত্রে মূল্যায়ন পেয়ে এসেছেন। ভালোভাবে পড়াশুনা করেছেন, ভালো রেজাল্ট করেছেন, শিক্ষকদের ভালোবাসা পেয়েছেন, সহপাঠীদের সুদৃষ্টি পেয়েছেন, তাঁর কথা সবসময় গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছে, তার কথা অনেককে পরিবর্তিত করেছে। তাকে হঠাৎ এমন অনুসারী বা কর্মী বানানো হলো যার কথা বলার উপযুক্ত কোনো ক্ষেত্র নেই। কথা বললেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলা হয়, ‘আরে ভাই থামেন, আগে ঠিকমত রিপোর্ট লেখেন, এটা করেন, ওটা করেন, তারপর কথা বলতে এসেন।’ তার ব্যাপারে কিভাবে এ আশা করা যাবে যে, তিনি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ঐভাবে চুপ করে থেকে সংগঠনের সামনের সারিতে থেকে কাজ করবেন বা করতে পারবেন? তাকে কি মানোন্নয়নের ছাড়পত্র (বা Clearance) দেওয়া হবে? তার ব্যাপারে কি বলা হবে না যে- ‘বেশি কথা বলে’? যে কথার বা কাজের যথাযথ মূল্য দেওয়া হয় না সে কাজ একজন কতোদিন ধরে করবেন?
৮.ইসলামবিরোধী দলগুলো তাদের স্বার্থে প্রায়ই মেধাবীর মূল্যায়ন করে থাকে। তাহলে আমরা কেনো ইসলামেরই স্বার্থে ইসলামের শিক্ষা মতে, মূল্যায়নের হকদারদেরকে মূল্যায়ন করতে পারবো না? আল্লাহ বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানাত তার প্রকৃত হকদারের নিকট পৌঁছে দিতে।” (৪/সূরা আন নিসা:৫৮)
৯.সকল দায় শুধু যোগ্য ও মেধাবীদের উপর চাপিয়ে দিলেই কি আমরা মুক্ত হয়ে যাবো? আমরা যারা মেধাবী নই তাদের কি কোনো দায় নেই?
১০.যোগ্যরা সাধারণত সব যুগেই যোগ্য। নবী করীম (সা.) এক হাদীসে বলেন, “তোমাদের মধ্যে ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগের উত্তম লোকগণ ইসলামী যুগেও উত্তম ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হবে।” (ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি)
অভিযোগ ও পর্যালোচনা (তিন):
অভিযোগ: ‘মেধাবীরা দায়িত্বশীল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে নয়, বরং নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে বা অন্তত উপদেষ্টার সম্মান চায়।’
পর্যালোচনা: অমুসলিম সমাজেও অনেক সময় কর্মীরা নেতার কঠিন আনুগত্য করে। ঐ নেতারা কি আনুগত্যের আয়াত-হাদীস শুনিয়ে আনুগত্য আদায় করে? নাকি জ্ঞান, গুণ, দক্ষতা, প্রজ্ঞা ইত্যাদির বলে কর্মীরা নেতার স্বত:স্ফূর্ত আনুগত্য করে?
১.রাসূল (সা.) আনুগেত্যের আয়াত শুনানোর আগে কি সাহাবীগণ (রা.) তাঁর আনুগত্য করেননি?
২.রাসূল (সা.) এর জ্ঞান, গুণ, দক্ষতা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা কি অন্য লোকদের চেয়ে কম ছিলো? রাসূল (সা.) এর সাহাবীদের মধ্যে এমন একজনও লোকও কি ছিলো যার গুণাবলী রাসূল (সা.) এর চেয়ে বেশি ছিলো?
৩.আনুগত্যের আয়াত-হাদীস শুনিয়ে আনুগত্য আদায় করার অপরিহার্যতা সাধারণত তখনই সৃষ্টি হয়- তখন নেতৃবৃন্দ স্বীয় জ্ঞান, গুণ, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা বা এ জাতীয় বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে কিছু অধ:স্তন লোককে অগ্রসর মনে করে হীনমন্যতায় ভোগেন অথবা অধিকতর যোগ্য লোকদেরকে নিজের পদ-পদবীর জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করেন। অবস্থা এমনটা না হলে আনুগত্যের আয়াত হাদীস শোনানো ছাড়াই জনশক্তি মজবুত ও স্বত:স্ফূর্ত আনুগত্য করতে থাকে।
৪.সত্যিকারের ভালো নেতা নিজের চেয়ে যোগ্য লোক পেলে তাকে মূল পদে বসানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দেন এবং এ প্রক্রিয়ায় সফল হলে নেতা নিজেকে নেতৃত্বের দায়িত্বের কঠিন বোঝা থেকে মুক্ত মনে করেন এবং পরকালের জবাবদিহিতা সহজ হওয়ার আশায় অত্যন্ত খুশি হন।
৫.গুনাবলী ছাড়া কেবল দায়িত্বশীলের পদবী কাজে লাগিয়ে সফল নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অবশ্য, কিছু ‘জি হুজুর’ স্বভাবের লোক সহজেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। সফল নিয়ন্ত্রণের জন্য লাগে অধিকতর জ্ঞান, যুক্তি, ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি। দায়িত্বশীল এগুলো দিয়ে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এবং অধীনস্তদের স্বত:স্ফূর্ত আনুগত্যও লাভ করে থাকেন।
৬.আল্লাহ বলেন, “বিজ্ঞতা ও সদুপদেশের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকো এবং উৎকৃষ্ট ও মহোত্তম উপায়ে তাদের সাথে বাক্যালাপ করো।” (১৬/সূরা আন-নাহল:১২৫) এ আয়াতের আলোকে প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনো কর্মীর প্রস্তাবের দুর্বলতা যুক্তি দিয়ে খণ্ডন না করে আনুগত্যের আয়াত দিয়ে করালে কোনো প্রজ্ঞাবান ও মেধাবী লোকই সংগঠনে সহজে টিকতে পারবে কি? তবে, যারা স্পষ্ট ভুল সিদ্ধান্ত হতে দেখেও সবকিছু সহ্য করে বৈঠক থেকে বেরিয়ে কেঁদে ফেলে তারা টিকতে পারলেও পারতে পারে। উপরিউক্ত আয়াতে উৎকৃষ্ট বাক্যালাপ (ও বিতর্ক) করতে বলা হয়েছে যা করা হবে বিজ্ঞতা (বা যুক্তি) ও সদুপদেশ (বা আন্তরিকতা) এর সাথে। উন্নত যুক্তি ও প্রস্তাব ছাড়া কেবল আনুগত্যের আয়াত শুনিয়ে আনুগত্য করতে বাধ্য করা বা নিজ মত চাপিয়ে দেওয়া ইসলামী স্বভাব হতে পারে না।
৭.প্রজ্ঞাবান ও মেধাবী লোকেরা নতুন নতুন পথ-পন্থা ও প্রস্তাব তুলে ধরবে- এটাই স্বাভাবিক । সেগুলোর চেয়ে উত্তম প্রস্তাব না দিয়ে একের পর এক সকল প্রস্তাব নাকচ করতে থাকলে এ আশা করা যায় না যে, আনুগত্যের আয়াত শুনেই প্রজ্ঞাবানদের ‘অন্ধ আনুগত্য’ পাওয়া যাবে। ৮.একজন সাধারণ মানুষের আনুগত্য না করলেই কেউ ইসলাম থেকে পূর্ণভাবে বেরিয়ে যায় না। কারণ তার কাছে অন্য আরেকজন নেতার আনুগত্য করার পথ খোলা থাকে। এমনকি তার জন্য দায়িত্বশীল হওয়ার পথও তো খোলা থাকে। অন্যরাও তার আনুগত্য করবে- এ পথও তো বন্ধ নয়। এভাবে একজন প্রতিভাবান মুসলিমের সামনে বিভিন্ন পথ এসে যেতে পারে। এমনকি সে নিজেও ইসলামের আলোকে যুগোপযোগী নতুন পথ সৃষ্টির উপযোগী হতে পারে। তাই, মেধাবী লোকেরা যদি মনে করে যে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তাদের কোনো যুক্তিসঙ্গত কথাই বিবেচনা করা হচ্ছে না তাহলে তারা কেনো সেই সকল সুস্পষ্ট ভুল সিদ্ধান্তের দায়-দায়িত্ব জেনে-বুঝে নিজের কাঁধে তুলে নেবে?
অভিযোগ ও পর্যালোচনা (চার):
অভিযোগ: “মেধাবীরা ‘শুনলাম ও মেনে নিলাম’ ধরনের প্রক্রিয়াতে প্রবেশ করে না। ফলে তাদেরকে সংগঠনে রাখা যায় না। কারণ এদেরকে ধরে রাখার অর্থ আনুগত্যহীনতার দরজা খুলে দেওয়া।”
পর্যালোচনা: ‘শুনলাম এবং মেনে নিলাম’ এটা শুধুমাত্র আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সা.) ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু অনেকে এটাকে ইসলামী সংগঠনের প্রতিটি ইউনিট পর্যন্ত দেখতে চায়- যা সবসময় বাস্তবসম্মত নয়। আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক (বা দায়িত্বশীল) তাদের। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়ো, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও (অন্য কারোর দিকে নয়) যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামাত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক।” (৪/সূরা আন নিসা:৫৯)
১.দায়িত্বশীলের আনুগত্য শর্তহীন নয় বরং শর্তসাপেক্ষ। এ শর্তযুক্ত আনুগত্যের সাথে সাথে যুক্তি, বুদ্ধি, পরিসংখ্যান, তথ্য এগুলোরও প্রয়োজনীয়তা আছে।
২.ইসলাম অন্ধ আনুগত্য পরিহারের কথা বলে। কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তারা তাদের পণ্ডিতদেরকে এবং তাদের সংসার বিরাগী যাজকদেরকে রব বানিয়ে রেখেছে আল্লাহকে ছেড়ে এবং মরিয়মের পুত্র মসীহকেও।” (৯/সূরা আত-তাওবা:৩১) আল্লাহ আরও বলেন, “তারা আরও বলবে, হে আমাদের রব! আমরা তো আনুগত্য করেছিলাম আমাদের নেতা ও প্রধানদের। অতএব তারাই আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলো। হে আমাদের রব! তাই আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন এবং তাদের প্রতি লানত করুন, মহালানত।” (৩৩/সূরা আল আহযাব:৬৭-৬৮)
৩.যুক্তি, বুদ্ধি, তথ্য, ইতিহাস, পরিসংখ্যান ইত্যাদিকে ভিত্তি করে সংগঠন ও কর্মপদ্ধতি দাঁড় করালে আনুগত্যের আয়াত মুখস্ত করিয়ে বা এ সম্পর্কিত দারস দেওয়া ছাড়াই জনশক্তি আনুগত্য করবে। মেধাবীরা নিজেই এগিয়ে আসবে; তাদের ডাকতেও হবেনা। তারা ‘বনী ইসরাইল’ নাকি ‘মদীনার আনসার’ সেটাও তখন প্রমাণ হবে।
৪.আবু বকর (রা.) এর স্থলে কোনো দুর্বল মুমিনের মূল্যায়ন বেশি হলে যে বিপদ ও বিপর্যয় আসা স্বাভাবিক সেই বিপর্যয়ের জন্য আবু বকর (রা.) দায়ী হবেন না বরং তারাই দায়ী হবেন যারা অযোগ্যকে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে কিংবা তাকে দায়িত্বশীল মনোনীত করেছে। তাই অযোগ্যকে অথবা কম যোগ্যকে- অধিকতর যোগ্য লোকের চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করার শাস্তি ইহকালে পেতে হোক বা না হোক- এটাই স্বাভাবিক যে- অন্তত পরকালে সে শাস্তি পেতেই হবে।
অভিযোগ ও পর্যালোচনা (পাঁচ):
অভিযোগ: “মেধাবীরা চায় তাদেরকে বুদ্ধিজীবী ঘোষণা করে পৃথক একটি ‘প্লাটফর্ম’ করে তাদেরকে ‘তেল দেওয়া’ হোক (বা প্রশংসা করা হোক) এবং উন্নত জীবন প্রদান করে তাদেরকে মূল্যায়ন করা হোক। বিনিময়ে তারা সংগঠনকে শুধু বুদ্ধি দেবে এবং বিভিন্ন গবেষণা করবে। তারা তাদের মেধাকে সংগঠনে বিলীন করে দিয়ে নিছক কর্মী হিসেবে জীবন যাপন করতে চায় না।”
পর্যালোচনা: তাকওয়াবান মেধাবীরা সাধারণত ‘তেল দিতে’ (বা সামনে প্রশংসা করতে) অভ্যস্ত নয় বরং উল্টো তারা বিভিন্ন গঠনমূলক পরামর্শ দেয়, প্রস্তাব দেয় এবং নতুন কর্মসূচী দেয়। অনেক সময় সে প্রস্তাবগুলো হয়তো দায়িত্বশীলের মাথাতেও ধরে না।
১.আর সংগঠন মেধাবীদেরকে উন্নত জীবন দেবে কেনো বরং উন্নত জীবনই তো (সাধারণত) মেধাবীদের পেছনে ছোটে। মেধাবীরা নিজ যোগ্যতায় উন্নত জীবনের যতোটা পাওয়ার কথা অনেক সময় সংগঠন করার কারণে সেটা থেকে বঞ্চিত হয়।
২.কোনো নেতা যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে ঝটিকা মিছিলের আনুগত্য করতে বলে এবং সেটাকেই যদি আনুগত্যের একমাত্র ও চূড়ান্ত প্রমাণ বলে মনে করে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের পক্ষে ক্লাস নেওয়া বাদ দিয়ে (তথা কাজে ফাঁকি দিয়ে বা রুযি হারাম করে) ঝটিকা মিছিলে যাওয়া সহজ নয় এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা উপকারী কৌশলও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যদি তার মেধাকে ঝটিকা মিছিলে বিলীন না করেন, আর এতে যদি তার প্রকৃত কর্মী হওয়া না হয়- তাহলে ঐ শিক্ষককে কিভাবে দোষ দেওয়া যেতে পারে?
৩.বড় ক্ষতি করে ছোটো লাভের চেষ্টা করা কি হিকমাত বা কৌশল হতে পারে? আল্লাহ বলেন, “ডাকো, তোমার রবের পথে হিকমত ও উত্তম নসীহতের সাথে।” (১৬/সূরা আন নাহল:১২৫)
৪.লেখক নিজে অনেকবার ঝটিকা মিছিলে গিয়েছেন- শুধু আনুগত্যের খাতিরে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আগেও ঝটিকা মিছিলের বিপক্ষে ছিলেন, এখনও আছেন। লেখক এখনো বুঝতে পারেননি যে- শহরের এক গলিতে পাঁচ-দশ বার ঝটিকা মিছিলের মাধ্যমে কোন কোন লাভটা হয়েছে? পক্ষান্তরে, একজন শিক্ষক কৌশলের সাথে পাঠদান ও আদর্শের প্রচার করে কি কি লাভ আনতে পারেন- তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
৫.যার জন্য যে কাজ উপযোগী তাকে সে ধরনের কাজ দেওয়াই কি যুক্তিযুক্ত নয়? ইসলাম কি কর্মবন্টন (Distribution of work) কে যুক্তিগ্রাহ্য বলে বিবেচনা করে না? কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য ইসলামী সংগঠন কি বিভিন্ন জনের ওপর বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করে না?
৬.ইসলামবিরোধী বুদ্ধিজীবীরা ইসলামের বিপক্ষে মিছিলে না এসেও ইসলামের বেশি ক্ষতি করছে। একইভাবে ইসলামের পক্ষের মেধাবীরা ইসলামের পক্ষে ঝটিকা মিছিলে না এসেও ইসলামের বেশি উপকার করতে পারে। সেই যথাযথ ও বৃহত্তর উপকার গ্রহণ না করে কেবল ঝটিকা মিছিলের উপকার নিতে যাওয়া কি হাতি মেরে মশা বাঁচানোর মতো নয়?
৭.২০০৮-০৯ সালে ফেসবুক ব্যবহার করতে বাধা দেয়া হতো। তখন অনেকেই (যারা তুলনামূলকভাবে আগে বুঝতে সক্ষম তারা) বলেছিলেন, ফেসবুকই একসময় হবে সবচেয়ে বড় মিডিয়া (বা মাধ্যম)। সেইসব ফেসবুক বিদ্বেষী দায়িত্বশীলকে এখন দেখা যায় ফেসবুকে পেজ খুলেছেন। অর্থাৎ তিনি বুঝলেন ঠিকই- তবে দেরিতে। অথচ, আগে বুঝলেই তা অধিকতর ধীশক্তি ও যোগ্যতার প্রমাণ বহন করতো।
৮.একজন মেধাবী যখন দিনের পর দিন দেখেন তার চোখের সামনে সামান্য (বা ক্ষুদ্র বিষয়ে) ভিন্ন মত পোষণকারীদের হেয় করে অদূরদর্শীর মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, জীবন ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি করা হচ্ছে তখন সবার পক্ষে কি ‘শুনলাম এবং মান্য করলাম’ ধরনের আনুগত্য করা উপকারী বলে প্রতীয়মান হয়?
৯.নিজেদের ব্যর্থতাজনিত বিপদকে ঈমানের পরীক্ষা ভাবা উচিত নয়। নিজেদের ভুল, দোষ, অদূরদর্শিতা কি কি সেটাও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। সঙ্গত কারণেই আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।” (১৩/সূরা আর রাদ:১১) নিজেদের ব্যর্থতাকে স্বীকার না করাকে কি মহত্ব বলে আখ্যা দেওয়া যায়? নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার না করে ব্যর্থতাজনিত বিপদকে বিনা বিচারে ‘ঈমানের পরীক্ষা’ আখ্যা দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করা কি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো অনুচিত কাজ নয়?
অভিযোগ ও পর্যালোচনা (ছয়):
অভিযোগ: ‘মেধাবীরা উপদেষ্টা হতে চান; কর্মী নন। তারা আনুগত্য করতে নয় বরং উপদেশ দিতে ভালোবাসেন। তাদেরকে ধরে যদি রাখতেই হয় তাহলে কর্মী না বানিয়ে ও আনুগত্যের আশা না করে ধরে রাখতে হবে।’
পর্যালোচনা: দরকার ছিলো এই যে, সংগঠনে সকল কর্মীই উপদেষ্টা হবে। কিন্তু আফসোস, এখন উল্টো কর্মীদেরকে কেবল ‘কাজের লোক’ হিসেবে ভাবা হচ্ছে। নেতার ভাবখানা এমন যে, ‘যা বলেছি সেটা মেনে চলেন, এতো কথা (বা উপদেশ) কিসের?’
১.মেধাবীরা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করবে, যুক্তি সহকারে কথা বলবে- সেটাকে কর্মীর পরামর্শ মনে না করে উপদেশ মনে করাটাই তো আসল সমস্যা। এটাকে উপদেশ মনে না করে পরামর্শ মনে করাই তো উচিত।
২.কর্মী-সমর্থকদের পরামর্শকে উপদেশ মনে করে গ্রাহ্য না করার মানসিকতা অত্যন্ত ক্ষতিকর। আল্লাহ বলেন, “সুতরাং তুমি তাদের (সাথীদের) মাফ করে দাও (ও কোমল ব্যবহার করো), তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করো। আর যখন কোনো সিদ্ধান্ত নাও তখন আল্লাহর উপর ভরসা করো (ও গৃহীত সিদ্ধান্তে অটল থাকো।)” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৫৯)
৩.নেতা যোগ্যতা ও প্রজ্ঞায় ঠিক হলে প্রায় সবাই আনুগত্য করবে, মেধাবীরা ‘মুরসি’র মতোই হবে ইনশাআল্লাহ; যদি সংগঠনের কর্মীকে ‘মাটিকাটা কর্মীতে’ পরিণত না করা হয়।
যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সকল পর্যায়ের নেতা ও ব্যবস্থাপকদের করণীয়:
১.ঈমান, আল্লাহভীতি, জ্ঞান, রাসূলের (সা.) আদর্শের অনুসরণ এবং সার্বিক যোগ্যতায় সকলের চেয়ে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ বলেন, “আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী জাতি বানিয়েছি যেনো তোমরা লোকদের জন্য সাক্ষী হও আর রাসূলও যেনো তোমাদের জন্য সাক্ষী হন।” (২/সূরা আল-বাকারা:১৪৩)
২.যোগ্য ও মেধাবী লোকদেরকে (যথাসাধ্য) সর্বস্তরের নেতৃত্বে আনা প্রয়োজন। বিপরীতক্রমে যোগ্য লোক থাকতে অযোগ্য ও প্রজ্ঞাহীন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া নি:সন্দেহে আমানাতের খিয়ানাত। আল্লাহ বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানাত তার প্রকৃত হকদারের নিকট পৌঁছে দিতে।” (৪/সূরা আন নিসা:৫৮)
৩.নিজের চেয়েও যোগ্য লোক সংগ্রহের বা গঠনের চেষ্টা করতে হবে।
(ক)যোগ্য লোক সংগ্রহ বা গঠনে অক্ষম হলে নেতার মধ্যে নেতৃত্বের লোভ আছে বলে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে।
(খ)সকলের মানসিক ও চিন্তাগত পরিশুদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
(গ)জ্ঞানচর্চাকে শুধু দায়িত্ব নয় বরং সখে পরিণত করা প্রয়োজন।
(ঘ)অধীনস্তদের প্রতিভা বিকাশ করে তাদেরকে সাফল্য লাভের পথনির্দেশ প্রদান করা উচিত।
(ঙ)অনুসারীরা যে কাজের জন্য অধিক যোগ্য তা নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে তাকে সে কাজে আরও দক্ষ করে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
(চ)অনুসারীদেরকে অধ্যবসায়ী, আত্মপ্রত্যয়ী, লেখক, চিন্তাবিদ ও সুবক্তা ইত্যাদি হিসেবে গড়ে তোলা উচিত।
(ছ)অধীনস্তদেরকে নিজস্ব ক্যারিয়ারের ব্যাপারে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, (অ)“নামায শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে।” (৬২/সূরা আল জুমুআ:১০) (আ.)“আমি (আল্লাহ) ব্যবসাকে হালাল করেছি আর সুদকে করেছি হারাম।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৭৫) (ই)“তোমরা দারিদ্রের ভয়ে নিজ সন্তানদের হত্যা করো না। আমি (আল্লাহ)-ই তাদের জীবিকা দান করি আর তোমাদেরও।” (১৭/সূরা বনী ইসরাইল:৩১) (ঈ)“এ সম্পদ যেনো শুধুমাত্র ধনীদের (কিংবা কেবল রাষ্ট্রের) কুক্ষিগত হয়ে না পড়ে।” (৫৯/সূরা হাশর:৭)
৪.ন্যায়বিচারের সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ, পরকালে নেতা ও পদের অধিকারীদের হিসেব কঠিন হবে।
(ক)নেতা হবার বা নেতা থাকার লোভ আছে কিনা তা সূক্ষবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে এবং লক্ষণাসমূহ দেখে অনুমান করতে হয়।
(খ)নেতৃত্বের লোভী লোকেরা সামনে প্রশংসা করে এবং অন্যেরা তার সামনে তার প্রশংসা করুক এটা কামনা করে অথবা অন্যকে তার নিজের প্রশংসা করতে দেয়। পরে গীবতও চালু হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, (অ.)“তোমরা পরষ্পরের গীবত (বা অসাক্ষাতে নিন্দা) করো না। তোমাদের কেউ কি নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? অবশ্যই তোমরা একে ঘৃণা করেছো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী ও দয়ালু।” (৪৯/সূরা আল হুজুরাত:১২) (আ.)“হে মুমিনগণ! ধারণা ও অনুমান করা থেকে বেশি করে সংযম অবলম্বন করো। কোনো কোনো ধারণা ও অনুমান গুনাহ। আর অন্যের দোষ খুঁজে বেড়িও না।” (৪৯/সূরা আল হুজুরাত:১২)
(গ)সুবিধাবাদী লোকেরাই আড়ালে গীবত এবং সামনে প্রশংসা করে। পরে তারা নেতৃত্বের লোভী নেতাকে একনায়কের মর্যাদা দিয়ে বসে। তখন দল বা রাষ্ট্র আর্দশভিত্তিক না থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে।
৫.নেতাদের অতি দীর্ঘ বক্তব্য অনুচিত। সংক্ষিপ্তভাবে ও কম সময়ে অধিক অর্থবহ ও আকর্ষণীয় বক্তব্য দেওয়া উচিত। হযরত আলী (রা.) বলেন, ‘সাফল্য আসে আত্মপ্রত্যয়ের মাধ্যমে, আত্মপ্রত্যয় জন্মে গভীর চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে আর চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে স্বল্পভাষণে।’
৬.নিজের ব্যাপারে কোনো (সন্দেহসূচক) প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়ার কারণ রাখা যাবে না (গোপনেও অন্যায় করা যাবে না)।
(ক)অন্যের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে উত্থাপনের পর সমাধান না হলে দ্রুত যথাযথ ফোরামে তার সমাধান হয়ে যাওয়া উচিত। অভিযোগ বা প্রশ্ন মনের মধ্যে চেপে রাখা ক্ষতিকর।
(খ)সমালোচককে শত্রু না ভেবে সংশোধনে সহযোগী বন্ধু মনে করা উচিত। অন্যায় সমালোচনায় ভীত না হয়ে সেটাকে প্রশংসার নামান্তর ভাবাই শ্রেয়।
(গ)অন্যের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে নিজে অন্যায় করা যাবে না। হাদীস মতে, ‘যে ব্যক্তি নিজের সমালোচনা করতে পারে, সেই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান।’
(ঘ)নেতা পর্যায়ের লোকেরাও যেনো সাধারণ একজন ব্যক্তির কাছেও জবাবদিহিতা করতে বাধ্য হয় এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
(ঙ)অভিযোগ যিনিই উত্থাপন করুন যা যাচাই করা উচিত। বিনা যাচাইয়ে দায়িত্বে বহাল রাখাও ঠিক নয় আবার বিনা যাচাইয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়াও ঠিক নয়। আর যাচাই হতে হবে অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে। আল্লাহ বলেন, “তোমরা যখন বিচার করো, তখন ন্যায় বিচার করো।” (৪/সূরা আন নিসা: ৫৮)
(চ)নেতা হলেই যেনো কেউ আইনের উর্ধ্বে উঠে যেতে না পারেন সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
৭.মেধাহীন ও পেশীশক্তিনির্ভর নেতৃত্ব বর্জণীয়। বিশেষ করে, রাজনীতিতে পেশীশক্তির ব্যবহার না থাকলে মেধাবীদের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যেতো।
(ক)মেধাবীদেরকে ইসলামিক, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ময়দানে উৎসাহিত করা উচিত। কারণ এ ময়দানে তাদেরকে না আনলে স্বল্পযোগ্যরাই ফাঁকা মাঠে কর্মসাধন করতে থাকবে। যা জাতির জন্য ভোগান্তির কারণ হওয়াই স্বাভাবিক।
৮.দলের মধ্যে শিক্ষক, ছাত্র, পুরুষ, নারী, আলিম, আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, কৃষিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, বুদ্ধিজীবী, কৃষক ও শ্রমিকসহ সকলকে অংশগ্রহণ করানো প্রয়োজন।
(ক)প্রতিটি বিভাগ বা সেক্টর থেকে অন্তত একজন যেনো পরামর্শ কমিটিতে থাকতে পারে যে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
(খ)সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেনো অহমিকা সৃষ্টি না করে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
(গ)সংখ্যাগরিষ্ঠরা যেনো স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে না পারে সে ব্যবস্থাও করতে হবে।
(ঘ)ইসলাম পরিশ্রম করতে শেখায় এবং শ্রমিককেও মূল্যায়ন করতে শেখায়। রাসূল (সা.) বলেন, “শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগে তার পাওনা পরিশোধ করে দাও।”(ইবনে মাযাহ)
৯.বন্ধু সংগঠনগুলোর সাথে সৌজন্য বজায় রেখে চলা উচিত। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে।
১০.নিজস্ব প্রচার মাধ্যম সৃষ্টি ও তাতে মেধাবীদের নিয়োগ করা প্রয়োজন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসারে মেধাবীদের বিকল্প নেই।
১১.কেবল শ্লোগানে গণতান্ত্রিক না হয়ে কার্যক্ষেত্রে জনমত গঠন ও জনমতের প্রতিফলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(ক)চিন্তার বিকাশ সাধন করতে ও করাতে হবে।
(খ)সর্বস্তরে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে।
(গ)অন্যের মতামতকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না।
(ঘ)কিছু মৌলিক বিষয়ে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত কিন্তু সকল গৌণ বিষয়ে শাখাগুলোর স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন।
(ঙ)ভোট পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত যেনো যোগ্য লোককে সহজে নেতৃত্বে পৌঁছানো যায় এবং যেনো কম যোগ্য লোককে নেতৃত্বে আনা কঠিন হয়। (অ.)ভোট পদ্ধতি নিয়ে অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ার বা বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ ঘটানো বা ঘটতে দেওয়া যাবে না। (আ.)তাছাড়া ভোট গ্রহণ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা প্রয়োজন। মাঝে মাঝে কম যোগ্য লোক বেশি ভোট পায় এবং বেশি যোগ্য লোক কম ভোট পায়। এটা ইসলামী চেতনার বিপরীত। (ই)কুরআনের ঘোষণা, “আর তুমি যদি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চলো, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং মনগড়া কথা বলে।” (৬/সূরা আল আনআম:১১৬) এর মানে হলো, সবসময় সংখ্যাগরিষ্ঠের চিন্তা সঠিক হয় না। (ঈ)ইসলামের নীতির বিপরীত বিষয়ে বেশি ভোট পড়লে সে ভোট ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ, আগে ইসলাম; পরে ভোট।
১২.সকল পর্যায়ের নেতাকে সুবিধাবাদী না হয়ে স্থান, কাল, পাত্র অনুযায়ী অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করতে হবে।
১৩.রাষ্ট্রীয় বা দলীয় সম্পদ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করা বা করতে দেওয়া যাবে না।
১৪.স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, আত্মীয়করণ ইত্যাদি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
(ক)অযোগ্য বা কম যোগ্য ব্যক্তি নিকটাত্মীয় বা নিজ এলাকার লোক হলেও তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রদান করা যাবে না।
(খ)আল্লাহ বলেন, “আর যখন কথা বলো, তখন ইনসাফের কথা বলো, যদিও ব্যাপারটি নিজের আত্মীয়েরই (বিরুদ্ধে) হোক না কেনো।” (৬/সূরা আল আনআম:১৫২)
(গ)হাদীস মতে, নিজ সম্প্রদায়কে ভালবাসা স্বজনপ্রীতি নয়; বরং নিজ সম্প্রদায়কে অত্যাচারে বা অসৎকর্মে সাহায্য করাই স্বজনপ্রীতি।
১৫.সোনালী ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে, ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে আদর্শের বিপরীতে চলা যাবে না।
১৬.শরীরচর্চা ও সুস্থ দেহ গঠনকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।
যেসব কারণে বিভেদ প্রকট আকার ধারণ করে :
১.গোঁড়ামী:
(ক)যুক্তিহীনভাবে নিজের মতে অটল থাকাকেই গোঁড়ামী বলা হয়।
(খ)গোঁড়ামীর বিপরীত হলো সহনশীলতা।
(গ)গোঁড়ামীর অন্যতম উদাহরণ হলো- ভিন্ন মতাবলম্বীকে নির্বিচারে দেশের বা দলের শত্রু মনে করা।
(ঘ)প্রতিটি বিষয়ে কেবল নিজেকেই সঠিক মনে করা উচিত নয়।
(ঙ)অন্যের মতামতকে ন্যায়বিচারের সাথে বিবেচনা করা উচিত।
(চ)কুরআন হাদীসের বিপরীতে কারোর অন্ধ অনুসরণ করা যাবে না।
২.পারস্পরিক গালাগাল:
(ক)গালাগাল চলতে থাকলে বিভেদ বাড়তেই থাকে।
(খ)কেউ কেউ ভিন্নমতাবলম্বীকে এমনভাবে গালি দেন যেনো মনে হয় তিনি নিজে (বা তারা নিজেরা) ছাড়া সকলেই দেশ বা দলের জন্য ক্ষতিকর।
(গ)অপবাদ ও গালাগাল দেশ বা দলকে দ্বিধাবিভক্ত করে। তাই, অযথা দোষারোপের সংস্কৃতি বর্জন করতে হবে।
(ঘ)ভিন্নমতের লোক হলেই বিনা প্রমাণে দোষারোপ করা নোংরা কাজ।
(ঙ)আল্লাহ বলেন, “আর তারা আল্লাহকে ছেড়ে যাদের পূজা করে তোমরা তাদেরকে গালি দিও না, কেননা তাহলে তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দেবে।” (৬/সূরা আল আনআম:১০৮)
৩.ব্যক্তিপূজা:
(ক)পছন্দের ব্যক্তিকে জোরপূর্বক নেতায় পরিণত করার চেষ্টা করা অনুচিত।
(খ)নিজ নেতাকে অতিভক্তি এবং অন্যের নেতাকে লাঞ্ছিত করাও ঠিক নয়।
৪.দলের প্রতি অন্ধ আবেগ বা দলীয় অহংকার:
(ক)একটি ঐতিহ্যময় গৌরবকে যখন কোনো বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা কোনো দল নিজের একক অবদান বলে দাবি করে, তখনই তা কেবল বিতর্কিতই হয়ে ওঠে না, বরং জনমনেও তা নিয়ে জন্ম নেয় নানারূপ সংশয় ও সন্দেহ।
(খ)সংকীর্ণতার কারণেই ‘একলা চলরে নীতি’ সৃষ্টি হয় এবং এক গোষ্ঠীর লোক অন্য গোষ্ঠীর ভালো কাজকেও ভালো বলে স্বীকার করে না। এভাবে তারা ‘রাজনৈতিক মগজধোলাই’ এর শিকারে পরিণত হয়।
(গ)সচ্চরিত্রের লক্ষণ হলো, ব্যক্তি নিজের অন্যায় স্বীকার করবেন, নিজ দলের অনুচিত কাজ বা অন্যায় হলে তা স্বীকার করে সে কাজের সমালোচনা করতে প্রস্তুত থাকবেন এবং অন্যের বা অন্য দলের ভালো কাজের স্বীকৃতি দেবেন।
(ঘ)আল্লাহ বলেন, “তোমরা একে অন্যকে সৎকাজে এবং তাকওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবে, কিন্তু পাপকাজে ও সীমালংঘনের ব্যাপারে একে অন্যকে সাহায্য করবে না।” (৫/সূরা আল মায়িদাহ:২)
৫.অভ্যন্তরীন বিষয়ে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ কামনা:
(ক)আমাদের নিজেদের সমস্যাকে নিজেদেরকেই সমাধান করা কাম্য।
(খ)বাইরের শক্তিকে সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া মানে সেই শক্তিকে অভিভাবক বলে মেনে নেওয়া। তবে, ন্যায়সঙ্গতভাবে সহযোগিতা গ্রহণ করা হলে ভিন্ন কথা।
৬.সংখ্যাগরিষ্ঠতা, সম্পদ, ক্ষমতা ও বাহুবলের বাহাদুরী:
(ক)বাহাদুরী প্রদর্শন করলে সংখ্যালঘু, দরিদ্র, ক্ষমতাহীন ও দুর্বল জনশক্তি বা জনগণ নিজেদেরকে বঞ্চিত ভাবতে শুরু করে।
৭.দল বা দেশকে পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করা:
(ক)ক্রান্তিলগ্নে বিশেষ অবদান প্রদর্শনকারী নেতা ও দল প্রায়ই দল ও দেশকে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি ভাবতে শুরু করে- যা বিপত্তির অন্যতম কারণ।
৮.দলের চেয়ে ব্যক্তির কিংবা দেশের চেয়ে দলের স্বার্থকে বড় মনে করা :
(ক)যারা দলের চেয়েও ব্যক্তির কিংবা দেশের চেয়েও দলীয় স্বার্থকে বড় করে দেখেন তাদের বিরোধিতা করতে বাধ্য হন দলপ্রেমিক বা দেশপ্রেমিকগণ। ফলে ঐক্যের পরিবর্তে সৃষ্টি হয় বিভেদ।
তথ্যসূত্র:
১.তাফহীমুল কুরআন
২.হাদীস শরীফ
৩.আল কুরআন সৎ মানুষ ও সুন্দর সমাজ গড়ার নির্ভুল প্রেসক্রিপশন
৪.ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
৫.ইসলামী আন্দোলন: সাফল্যের শতাবলী
৬.আল কুরআনে বিজ্ঞান
৭.গণতন্ত্র, ভোটের গুরুত্ব,ভোটারের দায়িত্ব, প্রার্থী ও নির্বাচন
৮.মুহসিন আব্দুল্লাহ ও তানজীর আহমাদ রচনাসমগ্র
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৩:১২