শাহাবুদ্দিন শুভ : শৈশবের স্মৃতিতে ভেসে আসে সেই সরু মাটির রাস্তা, যেখানে আমরা প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। বর্ষাকালে গোপলা নদীর স্রোতে রাস্তা প্রায় বিলীন হয়ে যেত। তখন আমরা আখড়ার পাশে থাকা প্রাচীন তেঁতুল গাছ ধরে পার হতাম। আজ সেই নদীর যৌবন হারালেও, সেখানে নির্মিত হয়েছে শক্তপোক্ত রাস্তা।
স্কুল ফেরার পথে আখড়ার মন্দির থেকে ভেসে আসা কীর্তনের সুর আমাদের আকৃষ্ট করত। সাদামাটা পোশাকে বৈষ্ণব-ভৈষ্ণবীদের সাধনা, আর মন্দিরের পবিত্র পরিবেশ আমাকে শৈশব থেকেই সম্প্রীতির মর্ম বুঝিয়েছে। বাজারের দোকানগুলোতে হিন্দু সম্প্রদায়ের তৈরি খাবার—খই, বাতাসা, কদমা—আমাদের শৈশবের মিষ্টি স্মৃতির অংশ হয়ে আছে।
নবীগঞ্জ সরকারি কলেজে পড়ার সময় আমার বন্ধুদের মধ্যে ছিল শিশির, গৌতম, রাজীব, সূবর্ণা মিতু, এবং আরও অনেকে। পুজোর মণ্ডপে যাওয়া, বাড়িতে নিমন্ত্রণে যাওয়া বা গ্রুপ স্টাডি—সব কিছুতেই তাদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। একবার এক সিনিয়র আপু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "তুমি কি হিন্দু?"—কারণ তাদের সঙ্গে আমার এমনই মেলামেশা ছিল।
সিলেটে অনার্সে ভর্তির সময় প্রথমবার পরিবার ছেড়ে মেসে থাকতে হলো। তখন রমজান মাস ছিল। একদিন অসুস্থ হলে শিশির আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। সে এবং তার বড় ভাই মিলে আমার জন্য ইফতার বানালেন, রাতে সেহরির জন্য মাছ-মাংস রাঁধলেন। তাদের আন্তরিকতা আজো হৃদয় উষ্ণ করে।
শিশিরের বড় ভাইয়ের বিয়েতে সুনামগঞ্জের জয়শ্রী গ্রামে গিয়ে তাদের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আবার আমার মেয়ের জন্মের সময় উত্তম ও সঞ্জয় দা গুলশান থেকে ধানমন্ডি হাসপাতাল পর্যন্ত ছুটে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
উত্তমের সঙ্গে পুরান ঢাকার রাজ্জাক হোটেলে ইফতার খাওয়ার অভ্যাস এখনো মনে দাগ কেটে আছে। ঐতিহ্যবাহী খাবার আর বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো ছিল বন্ধুত্বের অপরূপ উদাহরণ।
পেশাগত জীবনে, যুগভেরী পত্রিকায় কাজ করার সময় সনাতন ধর্মাবলম্বী সহকর্মী অপূর্ব দা, সজল দা, দেবু দা ও সেতু দা আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। ডাচ বাংলা ব্যাংকে চাকরি করার সময় রিপন দা, প্রতীক দা, লিটন দা, তাপস দা, হিরন্ময় বণিক প্রমুখের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো আজো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে।
বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহর, পাহাড় থেকে সমতল—এই মাটির মানুষ সবসময় একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল। মাঝে মাঝে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই বন্ধন নষ্ট করতে চাইলেও, আমাদের বিশ্বাস—এ মাটির সম্প্রীতি এত গভীর যে তা কোনোদিন ভাঙবে না।
আমাদের এই ঐতিহ্য যেন চিরকাল অটুট থাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যাক হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থানের এই গল্প। সম্প্রীতির মাটি যেন একদিন বিশ্বের সামনে আমাদের শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:০২