ঠিকানা বদলে যায়
-আহমেদ চঞ্চল
অনেকদিন পর গ্রামে ভোর হওয়া দেখলাম। এ বাড়িতে শেষ কবে যে সকাল হতে দেখেছি আজ তা মনেও পড়েনা। কোনার ঘর থেকে ছোটদার গলা ভেসে এলো- “ মিহির এত ভোরে উঠে কোথায় যাচ্ছিস? এখন দিনকাল ভালো না , অনেকেই এখন আর তোকে চিনতে পারবেনা। বেশি দূরে যেন যাসনে।
: না, দাদা।বড় জোর নদী অব্দি যাবো। আর আমার সাথে আরিফ থাকবে অসুবিধা নেই।
বারান্দা থেকে সিড়ি ভেঙ্গে উঠোনে নামছি সিড়ির দূরত্ব টা আমার কাছে কেমন যেন কম বলে মনে হলো। বারান্দা থেকে উঠোন অব্দি এই পথ টুকু আমার চীর চেনা, যত দিন পরেই আসিনা কেন এ পথের হিসাব নিকেষ আমার কাছে ভুল হবার নয়। অবারিত মাঠের মত ছড়ানো উঠোনের ঠিক মাঝখানে এসে ব্যাপার টা ধরতে পারলাম। নতুন করে মাটি ফেলে উঠোনটাকে উচু করা হয়েছে ফলে দুটো সিড়ি মাটিতে ঢাকা পড়েছে। তুলসী বেদীর নিচের অংশে তাকিয়ে বিষয় টা আরো নিশ্চিত হতে পারলাম। গত বন্যার সময় আমি তখন ওপারে , বদ্দা স্কাইপিতে বলেছিল যে, মাটি ফেলা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাবার আমলের সেগুন কাঠের সদর দরজাটা এখনো আছে শুধু তার গায়ে নতুন কিছু মেরামতের চিহ্ণ বলে দিচ্ছে এ বাড়ির মানুষ নিরাপত্তার ব্যাপারে ইদানিং বেশ সচেতন হয়েছে। দরজার খিল খুলতেই একটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দের আশঙ্কা করেছিলাম কিন্তু কোন রকম শব্দ ছাড়াই সদর দরজা টা খুলে গেল তার মানে দরজার গায়ে নিয়মিত যত্ন-আত্তি পরছে। দরজা খুলে বের হতে প্রথমেই বড় একটা ধাক্কা খেলাম। আমাদের বাড়ি ঘেসে ঠিক ডান পাশে মাহমুদদের ছোট্ট একটা বাগান ছিল। সেই বাগানে হরেক রকমের ফুল ও ফলের গাছ ছিল। বাগানের ঠিক পশ্চিম কোণায় ছিল একটা বয়সী শেফালি ফুলের গাছ। প্রতিদিন ভোরবেলা পুজোর জন্য আমি আর দিপালি পিসি মাহমুদদের বাগানে ফুল কুড়োতে আসতাম। মাহমুদ ছিল আমার খুব ছোট বেলার বন্ধু। একবার মাহমুদ আমার ডালিতে খুব যত্ন করে টগর আর কাঠ মালতি তুলে দিয়েছিল। তারপর বাড়ি ফিরে এসে পিসি বলেছিল –“সব ফুল ফেলেদে মিহির,ওতে মুসলমানের ছোয়া পড়েছে।“ সেইদিন থেকে বুঝলাম আমার আর মাহমুদের মধ্য বিশাল একটা বিভেদ আছে। তখন আমাদের আর কতই বা বয়স হবে ? সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি ।
মাহমুদদের সেই ছোট্ট বাগানে এখন প্রকান্ড দুটি দালান উঠে গেছে। ইট সুরকির বড় বড় ইমারত দেখে এতটুকু বোঝার উপায় নেই যে, একদা এখানে নিকুন্জ ছিল। সদর রাস্তায় দাড়াতেই আরিফের সাথে দেখা হয়ে গেল। বুঝলাম ও সেই আগের মতই টাইম পাঞ্চুয়াল আছে।
: মিহির তোর চেহারা যে মলিন হয়ে গেছে ?
: বয়স তো আর কম হলোনা বন্ধু। আচ্ছা, মাহমুদের খবর কি ? কোথায় থাকে এখন ?
: মাহমুদ এখন ঢাকাতেই সেটেল্ড একটা ছেলে ওর। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে তবে দু’এক দিনের বেশি থাকেনা।
মাহমুদ ও আরিফ দুজনেই আমার খুব ছোট বেলার বন্ধু। আমরা এক সাথে সব খেলাধুলো করতাম, এক সাথে এক নদীর জলে স্নান করতাম আবার এক সাথে দল বেধে স্কুলে যেতাম। আরিফ এখন সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে। আরিফের বাবা মারা গেছে ও যখন খুব ছোট, তারপরই ওর মা বাবার বাড়িতে চলে আসে। সেই থেকে আরিফ নানা বাড়িতে মানুষ হয়েছে। হাটতে হাটতে কখন যে একেবারে অন্জনা নদীর পাড়ে চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি। এক সময়ের প্রমত্তা অন্জনা নদী এখন অনেকটাই ক্ষীণকায়।
: আরিফ,, নদীর ওপারে গ্রাম টার নাম যেন কি ?
: কৃষ্ণপুর। মনে নেই আমরা সাতরে গিয়ে ওপার থেকে আম চুরি করে আনতাম।
: হ্যা, ওপারে তো বিশাল একটা আম বাগান ছিল ! বাবলু গাছের মগ ডালে উঠতো আর নিচে ধপ ধপ করে আম ফেলতো। আমরা বালির উপর থেকে আমগুলো কুড়িয়ে গামছাতে বেধে আবার দ্রত সাতরে এপারে চলে আসতাম।এপারে এসে আম ভাগাভাগির পর প্রায়ই দেখা যেত বাবলুর ভাগে কোন আম নেই। আমার কথা মেষ না হতেই দেখি আরিফের চোখে জল। যেন অনন্তকালের মত সময় নিয়ে আমরা নীরব হয়ে গেলাম। শিশির ভেজা ঘাসের উপর বসে মাঝ নদীর দিকে স্থির হয়ে রইলাম দুজন। টানাটানির সংসারে হাল ধরবার জন্য ইন্টারমিডিয়েট পাশের পরেই পুলিশের চাকুরিতে ঢুকে পড়েছিল। কিভাবে কিভাবে যেন পোস্টিং টা ও পেয়েছিল পাশের জেলা ঝিনাইদহতে। সেই সময় ঝিনাইদহ তে নিষিদ্ধ ঘোষিত নকশাল বাহিনির প্রচন্ড দাপট ছিল। এক মাঘ মাসের শীতের রাতে টহল রত অবস্থায় নকশাল বাহিনির অতর্কিত গুলিতে ষ্পটেই মারা যায় আমাদের সব থেকে হাসোজ্জ্বল বন্ধু বাবলু। বাবলু যে রাতে মারা যায় সেই রাতে ভীষণ কুয়াশা পড়েছিল। এখনো যে কোন কুয়াশা ভেজা রাতে বাবলু কে আমার ভীষণ মনে পড়ে।
আমি কি উদ্দেশ্য নিয়ে এবার বাংলাদেশে এসেছি তা আরিফ কে বলা হয়ে ওঠেনি। বলা হয়ে ওঠেনি মানে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছি। শুধু আরিফ নয় আমার পরিবারের বাইরে আর কেউ ই এ কথা জানেনা।আমি ইন্ডিয়া চরে যাবার পর এদেশে যেমন দু/এক বছর পর পর বেড়াতে আসি সবাই ভাবছে আমার এবারের আসাটা-ও বুঝি সেরকম। অন্জনা নদীর ঠিক পশ্চিম পাম দিয়ে একটা একটা চোড়া পিচ ঢালা রাস্তা চলে গেছে। এই রাস্তা টা করেজ মোড় হয়ে একদম আমাদের বাড়িব পেছনের দরজায় গিয়ে মিশেছে। আরিফ প্রস্তাব দিলো –
: চল মিহির , শোভাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যায়
: শোভারা কি আর বাংলাদেশে আসে?
: নাহ। সেই যে ওপারে চলে গেল আর কখনোই আসেনি। শুনেছিলাম শোভার বাবা লাখনোতে উনার ভাই এর বাড়ির পাশে বাড়ি করে ওখানেই সেটেল্ড হয়ে গেছে।
শোভা দত্ত। কালো কিন্তু অবিকল দেবীর মত দেখতে ছিল। আমাকে পাগলের মত পছন্দ করতো। হয়তো আমি ও করতাম। আমাদের থেকে এক ক্লাশ নিচে একই স্কুলে পড়তো। শোভার বাবা ছিলেন গ্রাম্য ডাক্তার। খুব ভালো চিকিতসা করতেন, রোগীর জিভ আর চোখ দেখেই রোগ ধরে ফেলতেন। সাথে ব্যবহারটাও ছিল বড় অমায়িক।এ সব কিছুর গুণে অল্প কদিনেই নাম ও যশের চরম শীর্ষে পৌছে গিয়েছিলেন হরেণ ডাক্তার। এমন কি সেই সময়ে এ অঞ্চলে হরেণ ডাক্তারের জনপ্রিয়তার সাথে পাশ করা ডাক্তাররাও পেরে উঠছিলেন না। এক সময় সকল অজনপ্রিয় ডাক্তার রা একযোগ হয়ে হরেণ কাকাকে হিংসা করতে শুরু করলেন। রাত বিরাতে উনার বাড়িতে ঢিল ছোড়া হতো, গরু জবাইয়ের পর উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলা হতো। শোভাকে রাস্তা ঘাটে উত্যক্ত ও করতে শুরু করলো একদল বখাটে। প্রথমে থানা পুলিশের সহযোগিতায় লড়াই টা ভালো মতই চালিয়ে যাচ্ছিলেন হরেণ কাকা। শেষ পর্যন্ত তা আর কুলিয়ে ওঠেননি। অবশেষে এক শ্রাবণ মাসের ভোর বেলায় সপরিবারে কাউকে না জানিয়ে অনেকটা পালিয়েই ওপারে চলে গেলেন । পরে শোনা গিয়েছির তিনি ভারতে উনার ভাইয়দের সাথে সেটেল্ড হয়েছেন। আমি আর আরিফ কলেজ মোড়ে ঘুরে শোভাদের বাড়িটার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাড়ালাম। আগেকার সেই গোল রেলিং দেওয়া বারান্দা এখন ভেঙ্গে ফেলে চার কোনা বারান্দা করা হয়েছে। সেই পুরনো কোন কিছুই আর চোখে পড়লোনা, শুধু বাড়ির পাশের ঠাই দাড়িয়ে থাকা বুড়ো তাল গাছ টা ছাড়া। দক্ষিনের জানালার ধারে বুড়ো তাল গাছ টা যেন এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে।
ফাল্গুণ মাসের পড়ন্ত দুপুর বেলা।উপজেলা সাব রেজিষ্টারের অফিস থেকে আমি আর ছোটদাদা অটো রিক্সা যোগে গ্রামে ফিরছি। প্রকৃতিতে বারোয়ারি ফুলের আনাগোনা। রাস্তার দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত সরিষা ক্ষেত । চারিদিকে সরিষা ফুলের অবারিত হলুদ গালিচা, যতদূর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। মাঝে মাঝে বেশ কিছু আম গাছে মুকুল ধরতে শুরু করেছে। ইদানিং এ অঞ্চলে বাহারি জাতের ফুলের চাষ শুরু করা হয়েছে। মাঠের পর মাঠ জুড়ে রং বেরং এর গাদা, ইনকা, চন্দরমল্লিকা, জারবেরা প্রভূতী ফুল ফুঠে রয়েছে। নানা রকম ফুলের মিহি গন্ধের সাথে আম এর মুকুলের গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত নেশা ভরা ঘ্রাণে চারিদিক মৌ মৌ করছে। রেল লাইন ক্রসিং এর কাছে এসে হঠাত আমাদের অটো টা স্লো হয়ে গেল্। আমি পাশে বসা ছোটদার দিকে তাকাতেই দেখি দাদার চোখে জল।
:ছোটদা কাদছিস কেন ?
: মিহির,, এই কয় বছরে তুই তো তাও ওপারে গিয়ে থেকে অভ্যাস্ত হয়ে গেছিস। আমি ভারতে নতুন দেশে গিয়ে কিভাবে থাকবো বল ? জন্মের পর পর থেকেই আমি এদেশের আলো বাতাসে মানুষ হয়েছি। কোন দিন-ই ওপার টা আমার ভালো লাগেনি রে। দু:স্বপ্নেও কখনোই ভাবিনি আমি এই শহর, এই দেশ ছেড়ে গিয়ে অন্য কোথাও থাকবো।
আমি কিছু বলে যে দাদাকে স্বান্তনা দেবো কেন জানি ইচ্ছে হলোনা। শুধু আমার বাম হাত টা খুব আলতো করে দাদার কাধের উপর ফেলে রাখলাম।
সমস্ত আয়োজনই প্রায় শেষের দিকে শুধু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি রয়ে গেছে। তার মধ্য একটা বড় কাজ হলো ওদেশে টাকা টা পাঠানো। আগামীকাল সকালে সে কাজ টা সেরেই ছোটদা ওপারে রওনা দিয়ে দিবে। তারপর আমি একা, টুক টাক বিদায়ী কাজগুলো সমাধান হয়ে গেলেই কেল্লা ফতে। হঠাত করেই আজ থেকে বেশ গরম পড়তে শুরু করেছে। দুপুরে ঘুম থেকে উঠেই দেখি ঘামে আমার সমস্ত শরীর ভিজে জবজবে হযে গেছে। রোয়াকের দড়িতে ঝুলানো গামছা টা টেনে নিয়ে ছেলে বেলার মত বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে মাহমুদদের আম বাগানের দিকে চলে গেলাম। আদি আম বাগানটার অনেক পরিবর্তন এসেছে।আগের সেই পুরাতন বয়সী গাছগুলো নেই বল্লেই চলে। এখন সেই শুন্য স্থানে নতুন নতুন গাছ স্থান পেয়েছে। চাপ পাশে তাল গাছের সংখ্যা-ও বেশ কমে এসেছে। পড়ন্ত বিকালের একটা সোনালী আভা দীঘির বিশাল জল রাশির উপর এসে ঠিকরে পড়ছে। আমাদের বাড়ি সোজাসুজি যে ঘাট সেখানে একবারে জন মানব শূন্য। আমি বাধানো ঘাটের সিড়ির উপর বেশ অনেক টা সময় চুপচাপ বসে থাকলাম। এখান থেকে তাকালে আগে দীঘির অপর প্রান্তে বড় রাস্তা দেখা যেত। আজ আর ঠিক বড় রাস্তা টা দেখা যাচ্ছেনা। বড় বড় অট্টালিকার আড়ালে পাকা জায়গাগুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছে। দীঘির জলে নামতে যাবো হঠাত আমার গায়ের ভেতর কেমন যেন ছম চম করে ওঠে। দীঘির হলদে হয়ে আসা জলটাও খুব বেশি সুবিধার মনে হলোনা। এক সময় যে দীঘিটা আমার এত বেশি আপন ছিল আজ কেন জানি দীঘিটাকেই অচেনা ভুতুরে একটা জলাশয় মনে হতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত আমার আর দীঘির জলে স্নান করা হলোনা। আমি দ্রত পা ফেলে বাড়ি ফিরে আসলাম।
বিগত সাতাশ টা দিন কিভাবে যে পার হয়ে গেল তা বুঝে উঠতেই পারলাম না। নানান প্রকারের কাজের ঝামেলা আর গোছগাছের ব্যস্ততায় পুরো মাথা টা যেন ভারী হয়ে ছিল। এখন বিছানার উপর শরীর টা এলিয়ে দিতেই জগতের সমস্ত ক্লান্তি এসে ধরা দিলো। তবে কেন যেন আজ রাতে আমার এক ফোটাও ঘুমাতে ইচ্ছে করছেনা। এই বাড়িতে , এই শহরে, এমন কি এই দেশে আজ ই আমার শেষ রাত। কখনো শখ করে বেড়াতে আসলে সেটা ভিন্ন কথা কিন্তু এই শহরে হয়তো এই জীবনে আর আমার আসা হবেনা। যে বাড়িটা ছেড়ে একদিন আমি একটা রাত কোথাও গিয়ে শান্তি পাইনি এখন জীবনের প্রয়োজনে সেই বাড়িটা ছেড়ে চীর দিনের জন্য একটা ভিন্ন দেশে আমি চলে যাচ্ছি। শৈশব-কৈশোরের চিরচেনা এই বাড়ি, এই শহর ছেড়ে আমি ভোরেই চলে যাবো নতুন এক দেশের কোন এক শহরে। আমাদের ক্ষুদ্র এই জীবনে একটা ছোট্ট সুখের জন্য , একটু ভালোভাবে থাকার জন্য আমার নিজের শহর, নিজের দেশ,নিজের মানচিত্র এমন কি আমার প্রিয় জাতীয় সংগীত টা-ও কাল থেকে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
আমি বিছানায় অসাড় হয়ে পড়ে আছি হঠাত কানে সিডি প্লেয়ারে বাজতে থাকা একটা প্রিয় গানের সুর ভেসে এলো। আমি কি যেন একটা আজানা মোহে বাইরের বারান্দায় এসে দাড়ালাম। গানের আওয়াজটা স্পষ্ট মাহমুদদের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে।আহা ! কতদিন পরে প্রিয় গানের সুর টা আমার কানে এলো । আমার প্রিয় শিল্পী সুবীর নন্দীর মিষ্টি গলা:--
“ এই তো শুধুই আমার জন্য কারাগার….”
এক সময় আমি আর মাহমুদ সারাদিন ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনতাম। গানের ক্ষেত্রে ওর আর আমার প্রায় একই রকম পছন্দ ছিল। পান্না লাল আর অনুপ জালোটার ভজন মাহমুদ খুব পছন্দ করতো। নজরুল সংগীত ও ওর খুব প্রিয় ছিল তবে যে কোন কন্ঠে নয়। ধীরেন বসু,, মানবেন্দ্র নতুবা ফিরোজা বেগমের কন্ঠে ছাড়া মাহমুদ কখনো নজরুল গীতি শুনতোনা। মাহমুদ ভীষণ মেধাবী ও বিনয়ী ছিল। ও যখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ে তখন ওর বাবা মারা যায়। ঐ সময়টাতে ওদের সংসারে ভীষণ অভাব ছিল। আমরা প্রায়ই চাল, আটা, ডাল দ্রব্যাদি ওদের বাড়িতে দিয়ে আসার চেষ্টা করতাম। সবসময় যে ওরা এটা গ্রহণ করতো এমন নয় তবে নিলে বাবা ভীষণ খুশি হতেন। মাহমুদের মা’কে আমার বাবা “বড় বুবু: বলে ডাকতেন। একেবারে আপন মায়ের পেটের বোনের মত করে দেখতেন। এই সব হাবিজাবি পুরাতন ভাবনায় কতক্ষণ ডুবে ছিলাম তা ঠিক মনে নেই তবে আমার সম্বিত ফিরে আসলো গান টা থেমে যাওয়ায়। আমার মনের ভেতর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে, আজ মাহমুদ বাড়ি এসেছে। নিশ্চয় ই এসেছে। মাহমুদের নাম ধরে কয়েকবার ডাক দিলাম। ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরেই ামাদের দোতলার জানালা বরাবর খোলা ছাদে এসে দাড়ালো মাহমুদ।
: আরে মি-হি-র! কবে এলি ?
: প্রায় এক মাস হতে এলো কাল সকালেই চলে যাবো। তুই কি আজ এসেছিস ?
: হ্যা। একটু আগেই এলাম। এসেই ভাত খেয়ে গান শুনছি আর অমনি তুই ডাক দিলি। তোর সাথে অনেক কথা আছে রে, সময় নিয়ে বলতে হবে। আবার কবে আসবি তুই ?
: জানিনা। হয়তো আর আসবোই না।
এ কথা সে কথায় সব কিছু ভুলে গেলাম আমি। মনে হলো আমরা দুই বন্ধু আবার ঠিক সেই ছোট বেলায় ফিরে গেছি। আমি মাহমুদের কাছে কোন কিছুই গোপন না করে খোলামেলা সব বলে দিলাম। এই বাড়িটা আমরা বিক্রি করে দিয়েছি,, আমরা সবাই ওপারে অলরেডি সেটেল্ড হয়ে গেছি। ছোট দা সহ সবাই আগেই চলে গেছে, আমি ও কাল সকালেই চলে যাচ্ছি। সব কিছুই মাহমুদ কে ভেঙ্গেচুড়ে বলে দিলাম। খুব ছোটবেলা থেকে মাহমুদ কে দেখে আসছি। প্রচন্ড ঠান্ডা মাথা আর শক্ত গোছের ছেলে সে। আজ এই প্রথম তাকে আবেগ প্রবণ হতে দেখলাম। আমি ষ্পষ্ট টের পেলাম আমার শৈশব-কৈশোরে প্রিয় বন্ধুর দু’চোখ জলে ভরে এসেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বল্লাম :-
: মাহমুদ, তোর বলে একটা কবিতার বই বের হয়েছে ? নাম কি দিয়েছিস ?
: হ্যা। প্রথম কবিতার শীরোনাম অনুসারে কবিতার বইয়ের নাম দিয়েছি—“ভাগ”।
: বাহ! সাবজেক্ট আছে মনে হচ্ছে! কত দিন তোর দরাজ কন্ঠে আবৃত্তি শুনিনি! একটু শোনা তো ?
কিছুক্ষণ নীরবতার পর মাহমুদ খুব ধীর অথচ দৃঢ় কন্ঠে আবৃত্তি করতে লাগলো-
“সেই ৪৭-এ মানচিত্র ভাগ হয়েছিল
তাই আমার আর আমার মায়ের দেশ ভিন্ন ,
সেদিন আমাদের বাড়িটা-ও ভাগ হয়ে গেল
তাই আমার আর আমার সহোদরের ঘর আলাদা
সেভাবে হৃদয়টা-কে তো ভাগ করিনি
তবে তোমার কষ্ট আমাকে কেন পোড়াবেনা ?”
ফাল্গুণের শেষ সপ্তাহের ঝকঝকে মিষ্টি সকাল। ছবির মত মসৃণ বাকানো সরু পথের সারি সারি আম-কাঠাল-মেহগনি বাগান পেছনে ফেলে রেখে আমি জয়নগর-গেদে সীমান্ত চেক পোষ্টের দিকে ছুটে চলেছি। আমার রিক্সাওয়ালার নাম সৈয়দ আলী, অনেক দিনের পরিচিত, বাবার প্রাইভেট রিক্সাচালক ছিলেন। সৈয়দ আলী যেতে যেতে হাতের গামছা দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বল্লো :--
: দাদা, তালি আবার কবে আসপানি?
আমি ইচ্ছে করেই তার কথার কোন উত্তর দিলাম না। আমি বিশেষ ভঙ্গিমায় চেয়ে আছি দূর আকাশের দিকে। সেখানে আকাশের বুকে এক ঝাক সাদা পাখি হঠাত করেই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল গেল পূর্বে আরেক দল পশ্চিমে। গভীর মনযোগ দিয়ে আমি পাখিদের ভাগ হয়ে যাবার দৃশ্য দেখতে লাগলাম।
**************************শেষ*************************************************
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০২০ রাত ১১:১৮