************************
ডিউটিতে এসেই হাবিলদার করিম মিয়া তিন নং সেলের দিকে হাটতে শুরু করে। কাছাকাছি পৌছাতেই সাবধানি চোখে চারিদিকে একবার চেয়ে নেয়। পুরো জেলখানা জুড়ে সুনশান নীরবতা, অন্যান্য প্রহরীরা সবাই ঝিমুতে শুরু করেছে। ইনচার্জ স্যার একটু আগেই দারোগা রফিক স্যার কে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় চলে গেছে তবে একটু পরেই আবার ফিরে আসতে পারে। কনডেমন সেল ছাড়া সাধারণ সকল সেলের নিরাপত্তা আজ অনেক টা কম ই বলা যেতে পারে। তিন নাম্নার সেলের ঠিক কোণার ছোট দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আস্তে করে ডাক দেয় হাবিলদার করিম মিয়া
- বাসেত, বাসেত জাগনা আছস?
এক ডাকেই সাড়া দেয় খুনের মামলার আসামী বাসেত সিকদার।চব্বিশ বছরের টগবগে যুবক বাসেতের শৈশব কেটেছে আজিমপুর এতিম খানায়, এখন যৌবন কাটছে কেন্দ্রীয় কারাগারে। প্রায়ই বাসেতের কাছে মনে হয় তার জন্ম টা ই একটা আজন্ম পাপ। ষড়যন্ত্রের মামলায় আজ সে জেলে পঁচে মরছে, দেখার কেউ নেই। অথচ যে রাতে বুয়েটে খুন টা হয়েছিল সে রাতে বাসেত ঢাকাতেই ছিলনা, শরীয়তপুরে গিয়েছিল একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে। বাসেত সব ই বুঝে, যে লিডার তাকে ভালোবেসে এতিম খানা থেকে এনে আশ্রয় দিয়েছিল, নতুন জীবন দিয়েছিল। স্বার্থে আঘাত লাগায় সেই দেবতুল্য ঋষি লিডার ই তাকে মিথ্যে খুনের মামলায় ফাসিয়ে দিয়েছে। সামনে দুটো শুনানি মাত্র বাকি আছে এর পরেই মামলার রায় হয়ে যাবে। বাসেত নিশ্চিত তার ফাঁসি হবে। এ নিয়ে আগে সে খুব বেশি চিন্তা করতোনা, কারণ আগে তার জন্য কান্নার কেউ ছিলনা কিন্তু এখন কান্নার মানুষ হয়েছে। সে অনেক গল্প, মাঝে মাঝে বাসেত ভাবে তার জীবন নিয়ে একটা চলচ্চিত্র হতে পারতো।
করিম মিয়া আবার একবার চারিদিকে তাকিয়ে নেয়, তারপর খুব সঙ্গোপনে কোমড় থেকে জিনিস টা বের করে লোহার গরাদের ফাক দিয়ে বাসেতের হাতে দেয়। বাঁশি টা হাতে নিয়েই হুহু করে কেঁদে ফেলে বাসেত। তার জীবনের সত্যিকারের বন্ধু এই পুরনো বাশের বাঁশি টা। এতিম খানায় থাকতে মন খারাপ হলে সে এই বাঁশিটা বাজাতো। প্রায় দেড় বছর পর বাসেত তার প্রিয় জিনিসটা কে আবার কাছে পেল।
****************
ফজরের আযান হতে আরো কিছু সময় বাকি, জেলের ইনচার্জ জনাব লতিফুর রহমান উনার অফিস ঘরে বসে একটা জরুরী চিঠি লিখছিলেন। হঠাৎ উনার কানে বাশির করুণ সুর ভেসে এলো। যেন তেন সুর নয় এ যেন যাদুকরী সুর। লতিফুর সাহেব সুরের আবেশে অফিস ঘর থেকে বেড়িয়ে ধীর লয়ে ভাঙ্গা পরিত্যাক্ত সিড়ি বেয়ে জেল খানার চিলেকোঠায় বসে মোহাবিষ্ট হয়ে বাশি শুনতে লাগলেন। বিরহী এ সুর এ রাগাশ্রয়ী ধনী তার পুরনো চেনা, যৌবনে তিনিও রাগ সংগীতের তালিম নিতেন। বাশির সুরে ছাদ পেড়িয়ে অদূরে কেল্লার মাথার উপর যেন ঝড় শুরু হয়েছে, লতিফুর সাহেব স্পষ্ট সেই ঝড় দেখতে পেলেন। আস্তে আস্তে আধার কেটে সুবহে সাদিক নামছে, তিনি খুব ধীরে হেটে তিন নাম্বার সেলের সামনে এসে দাড়ালেন। ততক্ষণে বাশির সুর টা থেমে গেছে। হাবিলদার করিম মিয়া জেলার সাহেব কে দেখে যেন ভুত দেখলেন, ভয়ে থির থির করে কাঁপতে কাঁপতে বল্লেন -
- স্যার, ভুল করে তিন নাম্বার সেলের বাসেত বাশি টা বাজিয়ে ফেলেছে। এই বাসেত স্যারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নে। বাসেত তোর লাল দাগ পড়ে যাবে কিছু করার নেই।।
জেলার সাহেব মৃদু আলোতে গরাদের এপারে দাঁড়িয়ে যত টুকু দেখা যায় ঠিক তার চেয়েও বেশি শক্তি দিয়ে বাসেত কে দেখতে লাগলেন। তারপর লোহার রেলিং ধরে প্রশ্ন করলেন -
- বাশি তুমি বাজাচ্ছিলে?
- জ্বী স্যার, আর কখনো বাজাবোনা।
- জানো কি সুর তুলেছিলে তুমি?
- এটা রাগ ভিম পলাশী । কাফি ঠাটের উপর এটা একটা সুফি ঘরানার রাগ।
জেলার সাহেব বিষ্ময়ে অসুস্থ অনুভব করলেন, মনে হলো এই সব ভূতের কারসাজি। খুনের আসামী এ সব কি বলে?
(আমার লেখা ছোট গল্প " সকাল বেলার সুর" এর অংশ বিশেষ)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:৫১