somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“জ্বরের ঘোরে অথবা অমীমাংসিত রহস্য” /// ছোট গল্প

২০ শে আগস্ট, ২০১৯ দুপুর ১২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামতেই চারিদিকে কেমন যেন আলোর ঝলকানির মত মনে হলো। একটু পরেই ব্যাপারটা বুঝে গেলাম, সামনের পাচঁ-তারা হোটেল টা আজ আলোকসজ্জ্বার আয়োজন করেছে।সে কারণেই কিনা জানিনা চারপাশে একটা উতসবের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে।আকাশে মেঘেদের আনাগোনা, যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে।হঠাত খেয়াল হলো আমি শাহবাগের দিকে হাটা শুরু করেছি অথচ আমার গন্তব্য হলো মিরপুর।রাস্তায় যানবহনের বিশাল জটলা, একটা গাড়ির গায়ে আরেকটা গাড়ি লেগে রয়েছে নড়াচড়ার কোন নাম নেই।আগামী রবিবার জন্মাষ্টমীর ছুটি থাকার কারণে একটানা তিন দিন ছুটির কবলে পড়েছে দেশ।মানুষ পাগলের মত যে যার গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে।আমার শরীরের ভেতর কাপুনি দিয়ে শীত শীত অনুভূতি হলো, বোধ হয় জ্বর আসবে।ইদানিং দেশজুড়ে জ্বরের মহোতসব চলছে। ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে চিকুনগুনিয়া নামক কি এক আফ্রিকান জ্বরের একক চিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়েছে।সরকার ইচ্ছে করলে এ মাসটাকে জাতীয় জ্বরমাস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে দিতে পারতো।এক টানা হাটার ফলে গলা শুকিয়ে গেছে, আজিজ মার্কেটে এসে ঢক ঢক করে এক বোতল পানি শেষ করে চেনা কোন মুখ মনে মনে সন্ধান করতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে বুঝে গেলাম আজ আর পরিচিত কাউকে এ অঞ্চলে পাওয়া যাবেনা অগত্যা শাহবাগ মোড়ের দিকে হাটা শুরু করলাম। শাহবাগে ফুলের দোকানের কাছে আজকে মাত্র দু’জন রিক্সাওয়ালা দাড়িয়ে আছে। একজন বুড়ো চাচা রিক্সার উপর বসে লাল চা খাচ্ছে আরেকজন মধ্য বয়সী সাদা ধবধবে স্যান্ডো গেন্জি পড়ে আছে। রিক্সাওয়ালাদের গায়ের গেন্জি এত পরিষ্কার হয় তা আগে কখনো-ই আমার জানা ছিলনা।আমার খুব ইচ্ছে হলো এই মানুষটার রিক্সার যাত্রী হতে।
: মামা যাবেন নাকি?
: কই যাইবেন ?
: নির্দিষ্ট কোথাওনা , এই ধরেন আপনার রিক্সায় চড়ে পুরান ঢাকা ঘুরে বেড়াবো। দুই থেকে তিন ঘন্টা ঘুরবো আপনারে পাচ’শ ঠাকা দেব। যাবেন আপনি ?
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, রিক্সাওয়ালা খুব ভালো কিসিমের লোক আর আমার রিক্সা চলছেও সে রকম গতিতে।পলাশী বাজারের কাছে এসে রিক্সাচালক আপন মনেই বদরুন্নেসা কলেজের দিকে টার্ণ নিল।আমি আসলে এ দিকেই যেতে চেয়েছিলাম।হঠাত ঠান্ডা বাতাস ছাড়া শুরু হয়েছে।এরকম ঠান্ডা বাতাস এলে বৃষ্টির আর কোন সম্ভাবনা থাকেনা। প্রবাহমান বাতাসে হুট করে বেলী ফুলের সুবাস পেলাম । দু’টি কিশোর কিশোরি মোড়ের কাছে দাড়িয়ে বেলী ফুলের মালা বিক্রি করছে।মনে পড়ে গেল আজ থেকে ঠিক বিশ/একুশ বছর আগে ঠিক এখানে দাড়িয়ে ই দশ-বারো বছরের সম-বয়সী ভাই-বোন বেলী ফুলের মালা বিক্রি করতো। কবিতা-কে এ পথে বাড়ী পৌছে দেবার সময় প্রতিদিন ওকে তিনটা করে বেলী ফুলের মালা কিনে দিতাম।তখন প্রতি পিছ মালার দাম ছিল দু’টাকা করে আর এক সাথে তিনটা নিলে পাচ টাকা।কবিতার সাথে আমার টানা তিন বছরের প্রেম ছিল।অনেক ঘুরেছি আমরা দু;জন, ঢাকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত করে বেড়াতাম।এই ওল্ড টাউনের প্রতিটি অলি-গলিতে ওর সাথে আমার হাজারো স্মৃতি মিশে আছে।কবিতার সাথে আমার যখন প্রথম পরিচয় হয় তখন আমরা দুজনেই একটা চরম মানসিক ক্রাইসিসে ভুগছি।আমি ঠিক তখনো রিয়ার সাথে ব্রেকাপের ধকলটা ঠিকমত কাটিয়ে উঠতে পারিনি।রিয়া ছিল আমার শৈশব-কৈশোরের খেলার সাথী, আমার প্রথম প্রেমিকা। আমার সাদা মাটা গ্রাজুয়েশন আর অনিশ্চিত ভবিষত দেখে বুদ্ধিমতি রিয়া দীর্ঘ এক যুগের প্রেমের পাঠ চুকিয়ে প্রবাসী চকচকে ছেলে দেখে বিয়ে করে গ্লাসগোতে সেটেল্ড হয়ে গেল।রিয়ার চলে যাওয়াটাই মূলত আমার জীবনের কাল হয়ে দাড়ালো। আমি লেখা-পড়া, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে উদভ্রান্তের মত দিন কাটাতে লাগলাম। একই ভাবে কবিতার-ও তখন একটা ছেলের সাথে সদ্য ব্রেকাপ হয়েছে।এ রকম একটা টানপোড়েন পরিস্থিতিতে আমাদের দু’জনের মানে কবিতার সাথে আমার পরিচয় হয়। পরিচয় মানে আমার রুমমেট জাহিদ কবিতাকে পড়াতো। জাহিদের বাবা মারা যাবার কারণে আমি সাতাশ দিনের জন্য প্রক্সি-টিউটর হিসাবে কবিতাকে পড়াতে যাই। ঐ সাতাশ দিনেই আমাদের পরিচয় প্রেমে পরিণত হয়।আমাদের প্রেমটা খুব ভালোই চলছিল। দুজনেই যেন আবার নতুন করে শুরু করেছিলাম, স্বপ্নের মত করে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো।একদিন খুব ভোরে কবিতা হঠাত তার ছোট ভাই কে নিয়ে আমার মেসে হাজির, ও সাধারণত আমার মেসে কখনোই আসতোনা।আমি বুঝতে পেরেছিলাম নিশ্চয় কোন খারাপ ব্যাপার আছে। খুব স্বাভাবিক ঢং-এ কবিতা আমাকে জানিয়েছিল---“আজ সন্ধ্যায় বাবা তোমাকে বাসায় যেতে বলেছে। বাবা তোমার ইন্টার ভিউ নিবেন। আজ ই তুমি চীর জীবনের জন্য হয় আমার হবে নতুবা আমাকে চীরতরে হারাবে”। সেদিন সনধ্যায় আমি গিয়েছিলাম কবিতার বাবার সাথে দেখা করতে এবং সেদিন দুর্ভাগ্য আর ঔদাসীন্য আমাকে চীরতরে গ্রাস করেছিল। আমি যে শার্ট টা পড়ে গিয়েছিলাম তার কলার টা একটু ছেড়া মত ছিল। যাহোক, সেদিনের দৃশ্যপটটা অনেকটা বাংলা সিনেমার মতই হয়েছিল। সেই খারাপ অভিজ্ঞতা আমি খুব ঘটা করে আর লিখতে চাইনা। ঐদিনের পর থেকে কবিতার সাথে আমার আর কোনদিন-ই দেখা হয়নি। আমার খুব ইচ্ছে ছিল জীবনে বড় কিছু হতে পারলে আমি কোন একদিন কবিতার বাবার সামনে গিয়ে দাড়াবো। তারপর প্রায় একুশ বছর কেটে গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর যে অংশটা কবিতাদের বাড়ির পাশ দিয়ে শহীদ নগরের দিকে গিয়েছিল সেটা শুকিয়ে গেছে, পুরাতন ঢাকার মানুষ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শিখেছে, কামরাঙ্গির চরে বিদ্যুতের আলো জ্বলেছে-গ্যাসের লাইন গেছে, কবিতার বাবাও বুঝি মরে ভূত হয়েছে শুধু আমার আর উনার সাথে দেখা করা হয়ে ওঠেনি।কবিতার কিছু বান্ধবি ছিল আমার পরিচিত। ওদের কাছে জেনেছিলাম পুরান ঢাকার এক ধন্যাঢ্য ব্যবসায়ীর এক মাত্র পুত্রের সাথে কবিতার বিয়ে হয়। ছেলেদের চকবাজারের কাছে নিজেদের সাত তলা বাড়ী। এছাড়াও ঢাকাতে আরো তিনটা বাড়ি আছে। এটাও শুনেছিলাম যে কবিতার বাবা কি এক কারণে আর্থিক দৈন্যতায় পড়ে গিয়ে তাদের ওল্ড টাউনের বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে পল্লবীতে ভাড়া বাসায় থাকা শুরু করেছিল। এ সব কিছুই আমার সাথে ছাড়াছাড়ির তিন মাস সময়ের মধ্য ঘটনা। এরপরে আমি আর কোন কিছুই জানিনা। আমি ও মাঝে পেশাগত কারণে কিছু সময় ঢাকার বাইরে কাটিয়ে আসি। বিয়ে করে পুরোপুরি সংসারি হয়ে যায় , আমার আর মনেই থাকেনা কবিতার বা সেদিনের কোন কথা।
: মামা, এইবার কই যাইতাম?
রিক্সাওয়ালার আকস্মিক প্রশ্নে আমি যেন মহাসিন্ধুর ওপার থেকে আবার এই জগতে ফেরত আসলাম।
: সোজা চকবাজারের দিকে চলেন।
একুশ-বাইশ বছর আগে উর্দু রোডের ঢাল দিয়ে উঠে হরনাথ ঘোষ রোড আসার আগেই হাতের বাম দিকে ছোট একটা বাগান সদৃশ ফাকা জায়গা ছিল, যেখানে পাশাপাশি দু’টি বকুল ফুল গাছ আকাশের দিকে মাথা তুলে দাড়িয়ে থাকতো। ঠিক ঐ জায়গাতেই কবিতা প্রতিদিন আমার জন্য দাড়িয়ে অপেক্ষা করতো। আমি আমাদের মেসবাড়ী থেকে বেড়িয়ে লালবাগ চৌরাস্তা থেকে একবারে টি,এস,সি পর্যন্ত রিক্সা ঠিক করতাম। মাঝপথে রিক্সা থামিয়ে ঐ বকুল গাছের তলা থেকে কবিতা-কে রিক্সায় তুলে নিতাম।অনেক বছর পর আজ আবার রিক্সায় করে ঠিক ঐ স্মৃতি বিজড়িত জায়গাটা ক্রস করছি এখন দেখি সেখানে বড়-বড় কয়েকটি এপার্টমেন্ট উঠে গেছে। ঢাল শেষ করে আমার রিক্সা গতির সাথে হরনাথ ঘোষ রোডে এসে পড়বে ঠিক এমন সময় আমি চিতকার করে উঠলাম।
:মামা, রাখেন,রাখেন,রাখেন !আমার রিক্সার ঠিক সামনে কবিতা দাড়িয়ে , একুশ বছরে ওর চেহারায় খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। আমার চিনতে এতটুকু কষ্ট হযনি। শুধু একটু রোগাটে এবং ক্লান্ত লাগছে সেটা ওর গায়ে লেপ্টে থাকা ময়লা জীর্ণ শাড়িটার কারণেও হতে পারে।
:কবিতা, কেমন আছো তুমি?আমাকে কি চিনতে পেরেছো?
:এত বিশ্রী মোটা হয়ে গেলে কিভাবে চিনবো ? এত মোটা হলে কিভাবে তুমি ?
:আগের মত যেন চিকনা বলে উপহাস করতে না পারো তাই মোটা হয়ে গেছি। এসো রিক্সায় উঠে বসো।
কোন রকম কথা ছাড়াই কবিতা আমার রিক্সায় এসে বসলো, রিক্সা আবার চলতে শুরু করেছে।

তুমুল গতিতে আমরা অতীত দিনের মতই একটানা কথা বলে চলেছি।আমি পরপর প্রশ্ন করে যাচ্ছি কবিতা উত্তর দিচ্ছে আবার কখনোবা কবিতা আমাকে প্রশ্ন করছে আমি উত্তর দিচ্ছি।আমাদের সংসার, খুটনাটি সব কিছু নিয়েই কথা হচ্ছে। মন টা খারাপ হয়ে গেল কবিতা খুব অশান্তিতে আছে জেনে।ওর স্বামী ফয়সাল রহমান পুরান ঢাকার নাম করা চুইংগাম ব্যাবসায়ী। শুরু থেকেই নাকি কবিতার সাথে ঠিকমত বনাবনি হয়নি। ফয়সাল সাহেব ব্যবসার বাইরে আর মাত্র তিনটি জিনিস বুঝেন তা হলো –মদ,জুয়া আর নিত্য নতুন নারী। এর বাইরে কোন কিছু নিয়েই তার কিঞ্চিত আগ্রহ নেই। বাসর রাতে ঘরে ঢুকেই নাকি কবিতার কাছে একটা কুৎসিত নোংড়া আব্দার করেছিল, চোখের জলে ভেসে কবিতাতে সেই আব্দার মেটাতে হয়েছিল। সেই ঘটনার পর থেকেই কবিতা জেনে গিয়েছিল- ফযসাল সাহেব একটা বিকৃত চরিত্রের অধিকারী। প্রায় রাতেই বাইরে থাকতো কবিতার স্বামী, মাঝে মাঝে দেশরে বাইরে চলে যেত কবিতাকে কোন কিছু না জানিয়েই।এ সব কিছু নিয়েই কবিতার সাথে ওর বাবার প্রায়ই বাক-বিতন্ডা হতো, সব শেষ কবিতার বাবা মলিন মুখে একাকি চুপচাপ বসে থাকতেন। কবিতার প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিন ওর বাবা হার্ট এটার্ক করেন, হাপাতালে নেওয়া মাত্রই ডাক্তার ঘোষনা দেন তিনি আগেই মারা গিয়েছেন। ফযসাল সাহেব তখনো বিজনেসের কাজে চায়না তে ছিলেন। কবিতাদের সংসারে প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিয়ে অশান্তি লেগেই থাকতো সেটা আরো চূড়ান্ত রূপ লাভ করে কবিতার বাবার মৃত্যুর পরে।
: তোমার বাচ্চা-কাচ্চা কি ?
: তুমি তো দেখি আগের মতই কম বুঝো! ফযসাল তো সুস্থ-স্বাভাবিক যৌনতায় বিশ্বাসী ছিলনা বাচ্চা টা হবে কিভাবে ?আমি দু:খিত, বিষয়টা এর চেয়ে খুলে আমি বলতে পারবোনা।
আমি পরিস্থিতি হালকা করে নেবার ইচ্ছায় কথা ঘুরিয়ে নিলাম।
: তো তুমি এখন কোথায় যাবে ?
: কোথায় যাবো মানে ? তোমার পাশে বসে রিক্সায় ঘুরে ঘুরে রাতের ঢাকা দেখবো। তার আগে কিছু একটা খেতে হবে। মারুফ, আমার খুব খিদে পেয়েছে। কোথায় খাওয়াবে বলতো ?
: তুমি কোথায় খেতে চাও বল ?
:বল্লেই কি পারবে তুমি? হোটেল রয়েলে খাওয়ার টাকা আছে তোমার কাছে ?
:তুমি কি যে বল ? সেই দিন আর আছে নাকি ? এখন তুমি চাইলে থাইল্যান্ডের লং বিচেও তোমাকে খাওয়াতে পারি । কথাটা বলেই পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কবিতাকে দেখালাম।
: না, অন্য কোথাও খাবোনা। আমি হোটেল রয়েলেই খেতে চাই। যে রয়েলে থেতে চাইলে তুমি টিউশনির বেতন পাবার উছিলা দিয়ে মাসের দশ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করাতে , ঠিক সেই রয়েলেই খেতে চাই আমি।

হোটেল রয়েলের সামনে এসে রিক্সাওয়ালা কে বিদায় করে দিলাম । পাঁচশোর পরিবর্তে ওর হাতে একটা চকচকে এক হাজার টাকার নোট তুলে দিলাম।
হোটেলে ঢুকতেই আমি আবাক হয়ে গেলাম।একুশ বছর আগে যে ওয়েটার টা আমাদের খুব বেশী পরিচিত ছিল আজ এত বছর পর টিক সেই ওয়েটার টা-ই এসে আমাদের টেবিলের সামনে এসে দাড়িয়েছে।

কবিতা সেই আগের মতই কাচ্চির সাথে ওর প্রিয় রেশমি কাবাব মিশিয়ে খেতে লাগলো। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে কবিতা বলে উঠলো
:কৃপণতা করছো নাকি মারুফ ? লাবাং এর অর্ডার টা কেন দিচ্ছোনা ?
:আরে না । কিসের কৃপনতা, লাবাং এর কথা ভুলেই গেছিলাম।
খাওয়া শেষ করে আমরা যখন লালবাগ চৌরাস্তায় এসে দাড়ালাম তখন বেশ রাত। আমি বাসায় ফিরে যাবার ইংগিত দিয়ে বল্লাম-
: তাহলে তুমি কোন দিকে যাবে ?
: কোন দিকে যাবো মানে ? এখন আমি তোমার সাথে সদর ঘাটে যাবো। সেই আগের মত লঞ্চ ঘাটে হাত ধরাধরি করে দুজন পাশাপাশি বসে থাকবো।টার্মিনাল থেকে সাইরেন বাজিয়ে একে একে সব লঞ্চ ছেড়ে দিবে তবুও আমরা উঠবোনা। মারুফ, দাড়িয়ে আছো কেন ? রিক্সা ডাকো ? দাম-দর ঠিক করে নিয়ো , তোমার তো আবার রিক্সায় উল্টা-পাল্টা বাড়া দেওয়া স্বভাব ।
:আরে পাগলি কিসের রিক্সা , দিন পাল্টেছে না ?

কথা টা বলেই আমি পকেট থেকে আই ফোন বের করে উবার এ্যাপসে টিপ দিলাম।

আমরা আজ মূল ঘাট থেকে সোয়ারি ঘাটের দিকে একটু সরে এসে বসেছি।
সদর ঘাটের আবছা আরো আঁধারিতে একটা সদ্য পরিত্যক্ত লঞ্চের পাটাতনে আমি আর কবিতা পাশাপাশি বসে আছি।ভাদ্রমাসের বুড়িগঙ্গা যেন আগের সেই হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছে। রাত অনেক হয়েছে, প্রায় সব কয়টা লঞ্চ ঘাট ছেড়ে একে একে গন্তব্যের দিকে রওনা দিয়েছে। এখানে কোলাহল একবারে নেই বল্রেই চলে। আমরা দুজনেই নীরব হযে বসে আছি, কবিতা-ই প্রথম নীরবতা ভেঙ্গে উঠলো –
: মারূফ , তোমার ঐ কবিতা টা মনে আছে?
: কোনটা ?
: উতপল কুমার বসুর কবিতা টা ।
: ওই কবিতা তো ভুলে যাবার নয়।
: তবে শোনাও না ?
: আমি আবৃত্তি করার চেষ্টা করলাম :
“যে তমসা নদীর তীরে আমি আজ বসে আছি তার বালুকণাগুলি আমাকে
জানাতে চাইছে আমি জল থেকে কতটা পৃথক- তার ঢেউগুলি আমাকে
বোঝাতে চাইছে আমি গাছ নই, আর গাছের আড়ালে ঐ ধাঙড়বস্তির এক
মদ্যপানরত যুবক আমাকে বলতে চাইছে আমি পক্ষীরাজ, মেঘ থেকে নামলাম,
এইমাত্র, সাক্ষাৎ তারই চোখের সামনে-
হবেও-বা। তাহলে বর্ষার আঁধার সকালে আমি ডানা গুঁজে বসে থাকি। রোদ
উঠলে উড়ে যাব।“

সেদিন সদর ঘাট থেকে অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে। শেষ রাত থেকেই প্রচন্ড জ্বর শুরু হলো। ও রকম জ্বর আমার জীবনে কখনোই হয়নি।সমস্ত শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যাথা ছিল, সারা গায়ে ফোস্কার মত কি যেন উঠেছিল, মাথার চুল পড়ে গেল। এক টানা প্রায় দেড় মাস বিছানায় পড়ে থাকলাম।সুস্থ হয়ে অফিসে যেতেই কাজের চাপে কবিতার কথা এক রকম ভুলেই গেলাম আমি। মাঝে মাঝে হুট করে যে মনে পড়তোনা তা না , ভাবতাম আবার একদিন সময় করে পুরান ঢাকায় যাবো।

এভাবে বেশ কিছুদিন চলে গেল। তখন শীতের প্রায় শেষ, খুব সম্ভবত: মার্চ মাসের মাঝামাঝি হবে। আমি সুটেড, বুটেড হয়ে চট্রগ্রাম রেল স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি এমন সময় থেয়াল করলাম শাড়ি পড়া একটি মেয়ে দূর থেকে আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। প্রখমে চিনতে কষ্ট হলেও পরক্ষনেই মনে পড়ে গেল—মেয়েটা কবিতার সেই সময়ের বান্ধবী নাম মুক্তা । মুক্তার সাথে আলাপচারিতা শুরু হতেই উঠে এল কবিতার কথা। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মুক্তা যা বলে গেল তা শুনে আমি একবারে বরফের মত হিম শীতল হয়ে গেলাম ।
: কবিতা যেদিন মারা যায় আমি অনেক চেষ্টা করেছি আপনাকে খবর টা দিতে কিন্তু পারিনি, আপনার কোন প্রকার মোবাইল নাম্বার বা ঠিকানা-ই আমার জানা ছিলনা। আর আমি শুনেছিলাম আপনি গ্রামে চলে গেছেন, আপনি নাকি ওখানেই সেটেল্ড হয়েছেন।
: কবিতা মারা গেল কবে ? কিভাবে ?
: ওর বাবা মারা যাবার ঠিক দুই মাস পরে।অর্থাত ওর বিয়ে হবার এক বছর দুই মাস পরে। নিজের ঘরে সিলিং ফ্যান এর সাথে রশিতে ঝুলে গলায় দড়ি দিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেলে নেবার এক ঘন্টা পরেই ডাক্তার কবিতাকে মৃত ঘোষণা করে।
: সে তো অনেক আগের কথা ! তাহলে কিছুদিন আগে যে ?
: কিছুদিন আগে কি ?
: না কিছুনা!আমি অতি সাবধানে মুক্তার কাছে কবিতার সাথে দেখা হবার ঘটনা টা গোপন করে গেলাম ।

আমার মাথার ভেতরে একটা ঝি ঝি পোকা বন বন শব্দ করে ঘুরতে লাগলো।আমি দুই হাত দিয়ে আমার মাথাটা শক্ত করে ধরে রইলাম। মনে হলো , আবার আমি ক্রমশ সেদিনের মত জ্বরের ঘোরের মধ্য ঢুকে যাচ্ছি!

***********************সমাপ্ত ****************************
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৯ দুপুর ১২:২৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×