(১)
পুরনো ঢাকার আতশখানা লেনের সরুগলি দিয়ে একটানা হেটে চলেছে সুষমা। অনেকটা হাপিয়েও উঠেছে সে, এরকম হাটা তার অভ্যাস নেই। তবে আজকের এই সাত সকালে সে মারুফের জন্য একশ কিলোমিটার-ও হাটতে পারবে। গতরাতে সে মারুফকে নিয়ে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে, ভোরবেলা উঠেই ওর মুখটা দেখতে ইচ্ছে হলো।। বাসায় বাবা-মার সাথে সত্যি কথা বলেই বের হয়েছে, যদিও বাবা ঠান্ডা মাথায় পরে এর রেশ তুলবে বলে তার বিশ্বাস । সুষমা অগ্রণী স্কুলে ক্লাশ টেনে পড়ে, মারুফ পড়ে ঢাকা কলেজে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। মারুফের মেসে ঢুকেই সুষমা দেখে খুব শান্তিতে কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে পাজিটা।।সুষমার ইচ্ছে হলো মারুফ কে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু এই মেস বাড়ীতে তা সম্ভব না।।অসময়ে সুষমা কে দেখে মারুফ টাসকি খেয়ে গেল, বুঝে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো।। মফস্বল থেকে ঢাকায় পড়তে আসা পিতৃহীনা সুবোধ ছেলেটা তড়িত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে করে হোক এই পাগলিটাকে এখন মেস থেকে বাড়ী পাঠাতে হবে।। বিদায়ের সময় স্বভাব সুলভ ভণিতায় বাহানা শুরু করলো মেয়েটা, মারুফের কাছে আব্দার করলো খুব রোমান্টিক একটা কবিতা পড়ে শোনাতে হবে।। মারুফ কে মেসে রেখে বাড়ীর পথ ধরেছে সুষমা বাতাসে তখনো মারুফের দরাজ কন্ঠ ভেসে বেড়াচ্ছে :--
“আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদী কালের হৃদয় উৎস্য হতে”
(২)
ফাল্গুন মাসের সাত তারিখে শুভ লগ্ন,বংশ, জাত-কূল দেখে ডাক্তার পাত্রের সাথে খুব ঘটা করে বিয়ে হয়ে গেল সুষমার।। সুষমার বাবা এডভোকেট বীরেন ব্যানার্জী সুখের পরশমাখা গলায় তার গিন্নীকে বল্লেন:-“তোমার মেয়ের ভীমরতিতে ধরছিল, না হলে মুসলমান ভিটেমাটি বিহীন ছেলের ধোকায় পড়ে ? যাক ভগবান শেষ রক্ষা করেছেন”।।
(৩)
ঠিক বিয়াল্লিশ বছর পরের কথা! পদ্মার বিশাল জলরাশির বুকে কেবল ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।। পাটুরিয়া ফেরী ঘাটে স্পেশাল ফেরীতে ঢাকা -কলকাতা গামী বাসের সাথে বিশেষ অনুরোধে আরেকটি এম্বুলেন্স-ও তোলা হলো।।ফেরী চলা শুরু করলে কলকাতাগামী বাস থেকে নাতনীর হাত ধরে এক বৃদ্ধা ফেরীতে ধীর লয়ে নামলেন, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া চেহারাও বলে দিচ্ছে যৌবনে উনি কতটা রুপবতী ছিলেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা এই বৃদ্ধার নাম মিসেস সুষমা সেন উনি ঢাকা এসেছিলেন মেয়ের বাড়ী বেড়াতে।।সুষমা সেন এম্বুলেন্সের পাশে দাড়ানো এক যুবক কে কাঁদতে দেখে কিছুটা থমকে গেলেন।। ছেলেটাকে কেমন জানি চেনা চেনা লাগে।। কি মনে করে যেন ছেলেটার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলেন।।মাত্র কয়েকটা প্রশনোত্তর টাইপের কথাবার্তা তাতেই সুষমা সেনের মনে হতে লাগলো মহা পদ্মার ওপার থেকে কোন একটা চেনা হারানো সুর তার কানে ভেসে আসছে।ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গি, হাত নাড়া, চোখের জলের টান সব কিছুই যেন সুষমা সেনের চীর পরিচিত বলে মনে হতে লাগলো।। কথপোকথনের এক পর্যায়ে সুষমা সেনের চোয়াল শক্ত হয়ে এল--- মিনতির সুরে বল্লেন --- “আমি তোমার বাবার লাশটা দেখতে চাই,, প্লিজ এম্বুলেন্সের দরজাটা একটু খোল।। ফেরীর পাতাটন থেকে এম্বুলেন্সের অবস্থান ; মাত্র কয়েকে সেকেন্ডের দূরত্ব তবুও সুষমা সেনের মনে হতে লাগলো তিনি অনেক সময় ধরে হেটে চলেছেন ।। এই পথটুকু শেষ হতে চাচ্ছেনা সেদিনের সেই আতশখানা লেনের লম্বা গলির মত !!!!!
(শেষ)