পরবর্তী উপন্যাসের জন্য মারমা সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক রুপকথা-উপকথা সামনে আসছে, সংগ্রহ করছি, অনুবাদ করছি। আজকে যেটা শেয়ার করবো সেটা হলো একটা মারমা রুপকথা; নদাই আর গদাইয়ের গল্প (গল্পের নাম আমার দেয়া)। যা লিখছি তাতে এমন বেশ কিছু মারমা রুপকথা-উপকথার সাক্ষ্যাত পাওয়া যাবে, কিছু কিছু শিশুতোষ মনে হলে হতেও পারে।
এই গল্পটি এখনো এডিটিং পর্যায়ে রয়েছে তাই পরিপক্ক নয় জেনেই পাঠের অনুরোধ রইল।
নদাই আর গদাইয়ের গল্পঃ
এক গ্রামে দুই বন্ধু ছিল; নদাই আর গদাই, তারা ছিল বড়ই গরীব। জংগলে গিয়ে তারা ফাঁদ পেতে বন-মোরগ ধরে, শামুক-ঝিনুক-কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। একবার জংগলে গেলে তাদের প্রায় নয়-দশ দিনের খোড়াকি নিয়ে গভীর জংগলে যেতে হত। জংগলে বন-মোরগ, শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, কচ্ছপ ইত্যাদি পেলে তারা কিছু সেখানে রান্না বান্না করে খেত আর কিছু বাড়ি নিয়ে এসে বিক্রি করত। এভাবেই অনেক দুঃখে-কষ্টে তারা দিনানিপাত করত।
একবার জঙ্গলে দিন-রাত কাটাতে কাটাতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছিল, সুতারাং তারা সিদ্ধান্ত নিল বাড়ি ফিরবার। বাড়ি ফিরতে গিয়ে জংগলে তারা পথ হারিয়ে ফেলে এদিক-সেদিক ঘুরতে লাগলো। এভাবে বেশ কয়েকদিন যাওয়ার পর একদিন হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ শুনে উঁচু একটা গাছে উঠে নদাই দেখলো যে তারা একটা অচেনা গ্রামের নিকটে চলে এসেছে। তারা খুব দ্রুত পথ চলতে চলতে পৌঁছে গেল সেই গ্রামে।
গ্রামের প্রবেশ পথেই রয়েছে সুন্দর একটা বৌদ্ধ বিহার, বিহারে কয়েকজন ভিক্ষু আর বেশ কয়েকজন বালক শিক্ষানবীশ ছিলেন। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত নদাই আর গদাই সেই বিহারে এক রাত থাকার জন্য বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুর নিকট অনুমতি চাইলে তারা তাদেরকে থাকার জন্য বড় একটা রান্নাঘর দেখিয়ে দেয়।
রান্না ঘরে আশ্রয় নেয়া নদাই আর গদাই এর একটা বিষয় বেশ খটকা লেগে যায়, সাড়া দিন হৈ-হুল্লোর আর কোলাহলে মেতে থাকা গ্রামটায় সন্ধ্যা হওয়া মাত্রই লোকজনের আওয়াজ, গরু-মহিষের ঘন্টির শব্দ, শিশুদের কান্নাকাটির আওয়াজ সবই বন্ধ হয়ে যায়। চারিদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই।
যেহেতু থাকবার জায়গা হিসেবে তারা বড় একটা রান্নাঘর পেয়েছিল সেহেতু ক্ষুধা নিবারনের লক্ষ্যে তারা সেই রান্না ঘরেই শামুক রান্না শুরু করে দিল এবং রান্নাবান্নার পর মিটিমিটি চেরাগের আলোয় খেতে বসল।
এমন সময় বিরাট গম্ভীর গলায় একটি কণ্ঠ বিহারের ভিক্ষুর শয়নকক্ষ হতে ভেসে আসলো। এই তোরা চুক চুক করে কি চুষে খাচ্ছিস্? চুক চুক চুক! আমাকে একটু দে।
দুই বন্ধুর আর বুঝতে বাকী রইল না, এটা প্রেত ছাড়া আর কিছুই নয়, কারণ তারা জানে ভিক্ষুরা রাতে খাদ্য গ্রহন করেনা, তাছাড়া এই কন্ঠ অনেক বিকট এবং ভয়ানক। বেশ ভীত হয়েই তারা উত্তর করে, আসতেছি। তোদের আসতে হবে না, আমার এইখানে তুলে দে বলে প্রেত তার বিরাট জিহ্বার অগ্রভাগ রান্না ঘরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। জলে ভেজা, লালসার জল টপটপ করে পড়া সে জিহ্বার সেকি ভয়ানক বিশ্রী গন্ধ।
নদাই আর গদাই সাথে সাথে কিছু শামুক সেই জিহ্বায় তুলে দেয়। প্রেত ভিক্ষু কটর-মটর করে সেই শামুক চিবিয়ে খেয়ে ফেলে পূর্বের ন্যায় আবার খাবার চাইতে শুরু করে। নদাই আর গদাই শামুক শেষ হলে ঝিনুক, ঝিনুক শেষ হলে কাঁকড়া একটার পর একটা তার জিহ্বায় তুলে দিতে থাকে। ওদিকে ভোর হতে তখনো অনেক বাকী কিন্তু প্রেতের জিহ্বায় দেবার মত আর কিছুই নেই। এমন সময় জংগল হতে তাদের সাথে করে আনা মোরগটি কর-কর করে আওয়াজ করে ওঠে। মোরগের আওয়াজ শুনে প্রেত আবারো বায়না শুরু করে, "আমাকে কোর একটু দে"।
অন্য কোন উপায় না দেখে নদাই আর গদাই সময়ক্ষেপন করবার জন্য প্রথমে মোরগের পালক, পরে চামড়া, তারপরে মাংস ইত্যাদি অল্প অল্প করে প্রেতের জিহ্বায় দিতে লাগল। তারা জানত যে ভোর হলে ভূত-প্রেতের শক্তি কমে যায়, আর মানুষের শক্তি বৃদ্ধি পায়। তাই তারা মোরগের মাংস অল্প অল্প করে দিয়ে সময় ক্ষেপন করতে লাগল।
যখন প্রেতের জিহ্বায় দেবার মত আর কিছু অবশিষ্ঠ নেই তখন প্রেতের 'হ্যাঁ রে! মানুষের বাচ্চারা, তোরা কি করছিস, কোরক কি শেষ? দিবি না আমায়? নাকি বেড়িয়ে আসতে হবে? দে দে তাড়াতাড়ি দে!' শুনে রান্না ঘরের এক কোনায় গিয়ে ভয়ে তারা জড়সড় হয়ে যায়। কারন কিছু না পেয়ে প্রেত এবার তাদের ধরে খেয়ে ফেলবে।
তারা দুজনে একটা ফন্দি আঁটে, তারা প্রেতের সাথে লড়াই করবে তবে তারা দুজনে একসাথে লড়বে না। লড়বে পালাক্রমে। তাদের ফন্দী আঁটতে আঁটতেই আবার প্রেতের শাসানি, "হ্যাঁরে ! মানুষের বাচ্চারা, দে.. দে আমাকে কিছু খেতে দে। নইলে ভাল হবে না বলছি।"
শাসানি উপেক্ষা করে তারা প্রথমে একজন তৈরী হয়ে রইল লড়াইয়ের জন্য আর অপরজন এক কোণে নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রস্তুতি শেষে দুই বন্ধু প্রেতকে যুদ্ধের আমন্ত্রন জানিয়ে বলল, "তবে আয়! তোর একদিন কি আমাদের একদিন।" নদাই আর গদাই-র এমন কথা শোনামাত্র শয়নকক্ষ থেকে বিরাট কালো কাঠের গুড়ির মত কালো কি একটা গড়িয়ে আসলো রান্না ঘরের দিকে। সারা শরীরে লম্বা লম্বা লোম, উঁচু আর মোটা, চোখ দুটো ফুটবলের মত জ্বল জ্বল করছে। একটা মোটা ভূত!
প্রথমে নদাই ভূতের সাথে কুস্তি লড়তে লেগে গেল। নদাই ক্লান্ত হওয়া মাত্র গদাইকে বলল, বন্ধু বাঁচাও! অমনি গদাই, নদাইকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজে কুস্তিতে লেগে গেল ভূতের সাথে। এই ফাঁকে নদাই বিশ্রাম করে নিল, ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে তাজা হয়ে অল্প পানি মুখে নিল, আবার গদাই যখন ক্লান্ত হলো, তখন নদাই তার বদলে আবার কুস্তি লড়ল। এইভাবে পালাক্রমে তারা দুজন ভূতের সাথে লড়ে চলল সারা রাত ধরে অথচ কেউই ক্লান্ত হলো না।
ওদিকে ভোর যত হতে লাগল, একাকী ভূত তত ক্লান্ত হতে লাগল আর তার শক্তি কমে যেতে লাগল। এক পর্যায়ে ভূত হাঁফাতে হাঁপাতে বলল, আমায় ছেড়ে দে ভাই তোরা, আমাকে মাফ কর, ভাই। "তোর মাফ নেই, তুই আমাদের সব খেয়েছিস, আর আমাদের খুব ভয় দেখিয়েছিস, এবার তোর রক্ষা নেই"- বলে ভূতের কাটা বগলে চেপে ধরে নদাই আর গদাই তার ন্যাড়া মাথায় চালাতে লাগল শত শত ঘুষি। ঘুষি খেয়ে কাহিল হয়ে অবশেষে ভূত বলল, আমাকে তোরা ছেড়ে দে, তোদের আমি একটি সোনার পাতিল আর একটি রূপোর পাতিল দেব, সিড়ির গোড়ায় মাটির নীচে পোঁতা আছে।
সিঁড়ির গোড়ায় গদাই গিয়ে সম্পদের সত্যতা নিশ্চিত করে এসে তারা যখন ভূতটাকে ছেড়ে দিল, তখন সূর্য উঠেছে মাত্র। সিঁড়ির গোঁড়া থেকে সোনা-রূপার পাতিলগুলো তুলে নিয়ে তারা বাড়িতে ফেরত গিয়ে সেগুলো বিক্রি করে হয়ে যায় বিরাট জমিদার এবং বাকী জীবন দান-দক্ষিণা করে আরাম-আয়েশ করে কাটিয়ে দেয়।