আগের পর্বের লিংকঃ
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ এক (ক)
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ এক (খ)
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ দুই (ক)
পর্বঃ দুই (খ)
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের মানসিক স্বক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত সাইকো-সোস্যাল সাপোর্ট সেশনে লেকচার প্রদান শেষ করে, ডিসি সাহেবের কক্ষে সামান্য জলপানের দাওয়াত গ্রহন করতে গিয়ে বেশ বিব্রতই হয়ে পরে যুলকারনাইন ইসলাম। ডিসি সাহেব ছাড়াও কক্ষে উপস্থিত সেনাবাহিনীর একজন বড় কর্মকর্তা, জেলার এসপি সাহেব, একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কোন একটি কমিউনিটির নেতা গোছের দুইজন হেডম্যান এবং কারবারী পদবীধারী সকলেই চোখ বড় বড় করে যুলকারনাইনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। টেবিল ভর্তি নানান পাহাড়ি ফল-মূল আর খাবার সাজানো থাকলেও কেউ তা ছুয়ে দেখছেন না, যদিও পাহাড়ি এসব ফল-ফলাদির ব্যাপারে যুলকারনাইনের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। উপস্থিত সকলেই যেন তাদের সামনে সাক্ষাৎ কোন ভূত কিংবা অশরীরী দেখা পেয়ে গিয়েছেন। ছোটবেলায় একবার যুলকারনাইনের গ্রামে একটা খবর রটে গিয়েছিল, সম্পর্কে তার নানা স্থানীয় এমন একজন মানুষ নাকি জ্বিনের মেয়েকে বিয়ে করেছেন। দূর-দূরান্ত হতে মানুষ ছুটে আসছিল তার সেই নানাকে দেখতে। যেহেতু তার নানী জ্বিনের মেয়ে এবং তাকে চর্ম চক্ষু দৃষ্টি দিয়ে দেখবার কোন সুযোগ নেই সেহেতু দূর-দূরান্ত হতে ছুটে আসা সেই মানুষগুলো দূর হতে তার নানাকে দেখেই তাদের মানব জনমকে স্বার্থক ভেবে ফেরত যাচ্ছিলেন।
খবরটি যেহেতু যুলকারনাইনের পরিবারেও চলে এসেছিল সেহেতু তার পরিবারও একদিন তার সেই নানাকে বাড়িতে ডেকে পাঠালে, তার সেই নানা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন এবং কথা দেন পরের শুক্রবার তিনি আবার এসে তার নতুন বউয়ের সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দেবেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শুক্রবার এশার নামাজের পরপর সময়ে বাড়ির অন্ধকার একটা কক্ষে পুরো পরিবার একত্রিত হলেন, উদ্দেশ্য নতুন বউয়ের সাথে পরিচিত হওয়া। যেন তেন বউ তো নয়! একেবারে জ্বিনের মেয়ে। ঘরের ভেতরে হালকা হ্যারিকেনের আলোতে নানার প্রতি নিবদ্ধ পরিবারের সদস্যদের চকচকে চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিলনা। হ্যারিকেনের আলো নিভিয়ে দেয়ার কিছু সময় পর, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে জানালা খোলার আওয়াজ করে জ্বীন নানী তার উপস্থিতি জানান দেন। একটা সুমধুর নারীকন্ঠ সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে বলেন, আপনারা কেউ ভয় পাবেন না! আমি এখন আপনাদের পরিবারেরই একজন, আমাকে ভয় পাবার কিছুই নেই। হয়তোবা নানীর অভয় বানীতে উপস্থিত সকলে কিছুটা স্বস্তি এবং সাহস অর্জন করে নানীকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছিলেন যদিও ঘরে প্রবেশের পূর্বে নানার নানান শর্তাবলির মাঝে ভয় না পাওয়া এবং বাচ্চা আর ভীত শ্রেনীর মানুষকে দূরে রাখবার অনুরোধ ছিল। বয়স কম হবার সুবাদে, যুলকারনাইনের সে ঘরে থাকবার অনুমতি কোন ভাবেই ছিলনা। এমন একটা ঘটনার স্বাক্ষী হবার লোভ যেহেতু যুলকারনাইন কোন ভাবেই সংবরন করতে পারছিল না তাই আসরের নামাজের পরে-পরেই সেই ঘরের কাপড় ভর্তি কাঠের আলনার পেছনে লুকিয়ে পরাটাই ছিল উত্তম পন্থা। জ্বিন জাতি যে মিস্টি খেয়ে বেচে থাকে সেটা প্রথম সে জানতে পেরেছিল তার সেই জ্বিন নানীর নিকট হতেই। যাই হোক, সেদিন যুলকারনাইনের সেই নানী আসলেই জ্বিন ছিল নাকি পরবর্তীতে ঝাড়-ফুঁক তন্ত্রে মন্ত্রে বেশ ভালো রকম জমিয়ে নেয়া তার সেই নানার কোন কারসাজি ছিল তা নিয়ে বিস্তর বিস্তর গবেষনার প্রয়োজন ছিল, যেটা আর যুলকারনাইনের করা হয়ে ওঠেনি।
তবে বদ্ধ ঘরে হালকা হ্যারিকেনের আলোতে জ্বিনের মেয়ে বিয়ে করা নানা ও গায়েবী নানীর আওয়াজের প্রতি নিবদ্ধ তার পরিবারের মানুষদের যে চকচকে চোখ যুলকারনাইন সেদিন দেখেছিল, সেই চোখগুলোই যেন আজ এই ডিসি সাহেবের কক্ষেও দেখতে পাচ্ছে। মানুষ গুলোর জ্বিন, ভূত আর যুলকারনাইনের রহস্য উন্মোচন নিয়ে ছিল হাজারটা প্রশ্ন! সেনাবাহিনীর একজন অফিসার তো বলেই বসলেন, "আপনার সাথে কয়টা জ্বিন রয়েছে? উনারা কি এখন আছেন এখানে?" যুলকারনাইনের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ঘুমপুর এলাকার মানুষকে সমুদ্র হতে জন্ম নেয়া 'মারিদ' গোত্র প্রধান হানিফ নামক তার গৃহপালিত জ্বিনের যে গল্পটা সে শুনিয়েছিল সেই গল্প এখানেও শুনিয়ে দেয়! খুব কষ্ট করে নিজেকে সংবরন করে সে সকলের উদ্দেশ্যে বলে, "দেখুন সরকার কিংবা ব্যাক্তিগত উদ্যোগে আমি কিছু শক্ত শক্ত রহস্য উন্মোচন করেছি সত্য! কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমার নিকট ভূত, জ্বীন কিংবা অতি প্রাকৃতিক কোন শক্তির উপস্থিতি থাকা খুব জরুরী! আপনারা আমাকে প্রচন্ড বিজ্ঞান মনস্ক একজন মানুষ ভাবতে পারেন, বলতে পারেন আমি সকল প্রাকৃতিক-অতি প্রাকৃতিক ঘটনার পেছনে যুক্তি খুঁজি, বিজ্ঞান দ্বারা বিশ্লেষন করবার চেষ্ঠা করি আর যেটা করবার চেষ্ঠা করি সেটা হলো প্রচুর পড়াশোনা। পড়াশোনা করলে আপনারা নিজেই এসব আধিভৌতিক বিষয়ের সমাধান করতে পারবেন।"
যুলকারনাইনের এমন উত্তর সকলকে খুশি করতে না পারলেও, ডিসি সাহেবের চোখে খুশি যেন উপচে পড়ছিল। রীতিমত যুদ্ধজয়ী বীরের মত সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে বসলেন, "আরে ভাই! একই কথা আমারও। এসব ভূত-প্রেত কিংবা দেব-দেবীর কোন কারবার নেই এখানে, ঘটনার পেছনে কারন অবশ্যই রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সঠিক কারনের পেছনে ছুটবার! সঠিক কারনের পেছনে না ছুটে তোমরা দেব-দেবীর পিছে দৌড়ে বেড়ালে কি আর লাভ হবে?" ডিসি'র মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ইউএনও কমিউনিটি হতে আসা হেডম্যান আর কারবারীর দিকে তাকিয়ে সমর্থন লাভের আশায় কতকটা সহমত আবার দ্বিমত পোষন করে বলেন, "একই কথা আমারও স্যার! কিন্তু উনারা কিছুতেই মানছেন না। বলছেন কোন কারনে উনাদের পাড়া রক্ষী দেবী রুষ্ঠ হয়েছেন বিধায় একটার পর একটা খুন হচ্ছে।"
পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি কলার স্বাদ জগত বিখ্যাত! তিনি নম্বর কলায় কামড় বসাতে বসাতে ডিসি সাহেব এবং ইউএনও সাহেবের কথায় বেশ ভালো রকম সন্দেহ হয় যুলকারনাইনের। কামড়ে নেয়া সুমিষ্ট কলার অংশটুকুকে গালের ফাঁকে জমা দিয়ে ডিসির দিকে তাকিয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে, "দেখুন আপনারা কি নিয়ে আলাপ করছেন তা আমার জানা নেই! খোলাসা করে বললে আমার জন্য বুঝতে সুবিধা হয়।" যুলকারনাইনের এমন সরাসরি লাইনে প্রবেশ করাটা ডিসি সাহেবের জন্য নিঃসন্দেহে বেশ স্বস্তিদায়ক ছিল। স্বস্তি মাখানো সুরেই ডিসি সাহেব বলা শুরু করেন, "দেখুন বেশ কয়েক মাস যাবত আমরা একটা বেশ ভালো রকমের ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। পাশেই আমাদের একটা উপজেলা রয়েছে, কাপ্তাই! সেই উপজেলার একটা ইউনিয়নের নাম ওয়াজ্ঞা। খুব ছোট্ট একটা ইউনিয়ন, আটাশটি পাড়ায় চাকমা, মারমা, তঞ্চংগা সহ প্রায় দশটি ভাষাভাষীর পাহাড়ি মানুষ আর বাঙ্গালী মিলিয়ে আনুমানিক হাজার দশেক মানুষের বাস সেখানে। সমস্যাটা শুরু হয়েছে এই ইউনিয়নের মারমা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে যেখানে বিগত আট-দশ মাসে প্রায় ষোলটির মত সিরিয়াল কিলিং এর ঘটনা ঘটেছে। সব থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি হচ্ছে যে মানুষগুলো খুন হয়েছে, খুন হবার পর তাদের প্রত্যেকের কাটা মাথা নিকটস্থ কর্ণফুলী নদীর তীরে স্থানীয় যে শ্মশান রয়েছে সেখানে পাওয়া গিয়েছে। এই খুনের তালিকায় স্থানীয় চেয়ারম্যান, অনেক প্রভাবশালী মানুষ এবং কি কাপ্তাই থানার প্রাক্তন ওসি পর্যন্ত রয়েছেন। আমরা প্রশাসন হতে গোয়েন্দা নামিয়েছি, সন্দেহ ভাজন মাত্র গ্রেফতার করছি কিন্তু কিছুতেই খুন হওয়া থামাতে পারছি না। স্থানীয় মারমাদের মতে, 'রোওয়াশ্যাংমা' নামে তাদের একজন পাড়া রক্ষী দেবী রয়েছেন। কোন ভাবে তার প্রচন্ড অসন্তোষের কারনেই এই খুনের ঘটনা গুলো ঘটছে। তাদের মতে, খুন হবার আগের দিন খুনী বড় একটা দেওয়ালে কাটা মুন্ডুর ছবি একে চলে যায় এবং পরের দিন কারো না কারো কাটা মাথা সেই শ্মশানে পাওয়া যায়। যদিও আমরা প্রশাসন হতে বিষয়টা তেমন আমলে নিচ্ছি না তথাপি আমি নিজে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। যেখানে লাশের মাথাগুলো পাওয়া যাচ্ছে সেই শ্মশানের বিপরীতে জমাদ্দার টিলা নামে একটা ছোট্ট টিলা রয়েছে। রাস্তার পাশে বিধায় আমরা সেখানে একটা সুরক্ষা প্রাচীর তৈরি করে দিয়েছি যেন পাহাড় হতে গড়িয়ে আসা কোন বস্তু পথচারিদের কোন ক্ষতি করতে না পারে। আমি গিয়ে দেখলাম সেই দেওয়ালে কাঠ-কয়লার সাহাজ্যে কি সব আঁকিবুঁকি করে রেখেছে, এবং গুনে গুনে পনেরটা কাটা মুন্ডুর ছবি আমিও সেখানে পেয়েছি সত্য। যদিও খুনের ঘটনার সাথে এই ঘটনার সম্পৃক্ততা নিয়ে আমি যথেষ্ঠ সন্দিহান তথাপি আমরা সকল বিষয়কেই গুরুত্বের সাথে দেখছি। আমরা মিডিয়াকে কোন কিছুই জানতে দিচ্ছি না! এমনিতেই এই খুনগুলোর দোষ এক সংগঠন অন্য সংগঠনের উপর চাপিয়ে পাহাড় আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে। মিডিয়ায় এইসব ঘটনা এক্সপোজ হলে রীতিমত দুর্যোগ চলে আসবে। এখন আমরা আপনাকে এই কেইসটি আন-অফিসিয়ালি হ্যান্ডেল করবার জন্য অনুরোধ করছি! অর্থ-কড়ি নিয়ে কোন সমস্যা আমাদের নেই, আপনার পারিশ্রমিক এবং প্রয়োজনীয় অন্য সকল সুযোগ সুবিধা আমরা নিশ্চিত করবো। আমরা চাই এই সিরিয়াল কিলিং বন্ধ হোক এবং পাহাড়ে আবার শান্তি ফিরে আসুক!"
ডিসি সাহেবের কথাগুলো এতক্ষন বেশ মনযোগ দিয়েই শুনছিলেন যুলকারনাইন ইসলাম! হাতে ধরে রাখা জাম্বুরার টুকড়াটা প্লেটে ফেরত রেখে গলায় পেশাদারিত্ব বজায় রেখে প্রতি উত্তর করলেন, "যদি আপনাদের মনে হয় সেই দেয়ালে আঁকানো বস্তুর সাথে খুনের ঘটনার কোন যোগ-সাজেশ রয়েছে তাহলে সেখানে আলোর ব্যবস্থা করে কয়েকটা সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দিন! পাশে একটা পুলিশ চৌকি স্থাপন করে ২৪ ঘন্টা দুই তিন শিফটে কিছু পুলিশ মোতায়েন করুন। ইউএনও অফিসের কম্পিউটার অপারেটরকে কাজে লাগান। ক্যামেরায় সন্দেহ ভাজন কাউকে দেখা গেলেই সে পুলিশ চৌকিতে খবর দেবে আর পুলিশ গিয়ে তাকে ধরে ফেলবে- এই তো সমাধান!"
যুলকারনাইনের এমন পরামর্শে কতকটা হাসতে হাসতে ডিসি সাহেব উত্তর করলেন, "পুলিশ চৌকি না বসালেও চার নম্বর খুন হবার পর থেকেই সেই দেয়ালের সামনে এমনকি শ্মশানে পর্যন্ত আমরা সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি যুলকারনাইন সাহেব! আর সার্বক্ষনিক পুলিশ টহল তো আছেই। ক্যামেরায় কিছু ধরা তো পরছেনা আর পুলিশ সন্দেহভাজন যাদেরকে গ্রেফতার করছে তারা নেহায়েত এলাকার সরল-সোজা মানুষ। সব থেকে অবাক করা বিষয় হলো, খুনের আগের দিন সেই ক্যামেরাগুলো অচল হয়ে পড়ছে। আবার আমাদের লোকজন গিয়ে ক্যামেরা ঠিক করে দিয়ে আসছে, আবার খুনের আগের দিন ক্যামেরা অচল। এই চলছে!"
এবার কতকটা বিজ্ঞের মত যুলকারনাইন বলে বসল, "তার মানে খুনী বেশ প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন এবং আপনারা কি করছেন সে সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল।"যুলকারনাইনের এমন বিজ্ঞ মতামতের সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করে ডিসি সাহেব তার চোখের দিকে চোখ রেখে বলে, "এজন্যই তো আমরা আপনার দ্বারস্থ হয়েছি।" ডিসি'র চোখে যে আন্তরিকতা ছিল সেই আন্তরিকতার তোয়াক্কা না করে আবারও গলার মধ্যে পেশাদারিত্ব নিয়ে এসে যুলকারনাই উত্তর করে, " দেখুন, আপনারা একটা বেশ বড় রকমের ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন জেনে বেশ খারাপ-ই লাগছে! আমাকে ক্ষমা করবেন! আপনাদেরকে সাহাজ্য করতে পারলে আমারও বেশ ভালোই লাগতো কিন্তু সামনের সপ্তাহে 'হিউম্যান মুভমেন্ট সাইন্স এ্যান্ড সাইকোলজি'র উপর একটা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স এটেইন করতে আমাকে নিউইয়র্ক যেতে হবে। সারা বিশ্বের বাঘা-বাঘা সব সাইকোলজিস্ট আর সাইক্রিয়াট্রিস্টদের সামনে আমার একটা পেপার প্রেজেন্টেশন রয়েছে সেখানে। পুরো দক্ষিন এশিয়া হতে আমি-ই একমাত্র নির্বাচিত হয়েছি, এমন সুযোগ কে-ই বা হেলায় হারাতে চায় বলুন। আর কনফারেন্স হতে ফিরতে ফিরতে সামনের মাসের একেবারে শেষের দিক! তখন যদি মনে হয় তবে আমাকে ডাকতে পারেন, আমি চেষ্ঠা করে দেখবো। এখন আমার দ্বারা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।"
ডিস সাহেবের উষ্ণ আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ডিসি সাহেবের কক্ষ হতে বের হতে যাবার সময় দরজায় দাঁড়ানো সেই ছেলেটার দিকে দৃষ্টি পড়ে যুলকারনাইনের, যে কিনা সাইকো-সোস্যাল ক্লাসে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করছিল। কি যেন নামটা? হ্যাঁ, অংসুথাই মারমা। আর যাই হোক, প্রতিপক্ষকে বিচলিত করে কিভাবে উত্তর বের করে নিয়ে আসতে হয় সেই অদ্ভুত গুন তার মধ্যে রয়েছে। ছেলেটি যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষন পুরো কথোপকথনটিই শুনেছে সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যুলকারনাইনের। হয়তোবা আবারও নতুন কোন প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছে ছোকড়াটা। অংসুথাইকে এবার বিন্দুমাত্র প্রশ্ন করবার সুযোগ না দিয়ে, ডিসি অফিস হতে বের হয়ে গাড়ির দিকে পা চালায় যুলকারনাইন।
পেছন হতে অংসুথাই এর স্যার! স্যার! ডাকটার মধ্যে একটা তীব্রতা ছিল, একটা কাতরতা ছিল! নেহায়েত প্রশ্নের উত্তর জানবার জন্য যুলকারনাইন এত কাতর হতে কাউকে দেখে নাই। এই কাতরতা অন্য ধাঁচের, যাকে উপেক্ষা করবার শক্তি বোধ করি যুলকারনাইনের মাঝে ছিলনা। ভয় ছিল, ডিসি, এসপি সাহেবগন যদি তাকে খুব করে চেপে ধরে বসে তবে সে না করতে পারবেনা। আর যে ঘটনার বর্ণনা তারা দিচ্ছেন তা যদি সত্য হয় তবে সেই রহস্য উন্মোচন বেশ সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার। মাঝ খানে তার নিউইয়র্কের কনফারেন্স বাতিল।
"তোমার জন্য দুই মিনিট সময় অংসুথাই, এর মাঝেই শেষ করতে হবে!"- গাড়ির গ্লাস অর্ধেক নামিয়ে অংসুথাইকে একটা সুযোগ করে দেয় যুলকারনাইন। পাহাড়িরা খুব সম্ভবত পাহাড়ি ছাড়া আর কারো নিকট ঠিক-ঠাক মত তাদের আবেগ-অনুভূতি জাহির করতে পারেনা। জাহির করতে পারেনা নাকি তাদেরকে কেউ বুঝতে চেষ্ঠা করেনা সেটাও একটা বিষয়। যেমনটা কিনা বুঝতে পারছিলনা যুলকারনাইন নিজেও! এবার বিজ্ঞান, ধর্ম কিংবা ইহলৌকিক-পরলৌকিক কোন প্রশ্ন নয় বরং অংসুথাই তার জন্য বরাদ্দকৃত দুই মিনিট সময়ে, তার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছিল যুলকারনাইনকে এটা বোঝাতে যে তার বিদেশে কনফারেন্স এটেইন করার চেয়ে পাহাড়িদের মৃত্যু মিছিল থামানো বেশী জরুরী কারন পাহাড়টা যে তার দেশের অংশ, পাহাড়িরাও যে তার স্বজাতি। পুঁচকে একটা পাহাড়ি ছেলের এমন প্রেজেন্টেশনে কতক্ষন হতভম্ব হয়ে হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে যুলকারনাইন। বরাদ্দকৃত দুই মিনিট কখন আট মিনিট অতিক্রম করে দশের ঘরে পৌছেছে সে বলতে পারেনা।
অংসুথাইর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে নিয়ে পুনরায় ডিসি সাহেবের কক্ষের দরজার সামনে এসে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে যুলকারনাইন জিজ্ঞেস করে, "অর্থ-কড়ির বিষয় নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে কি!"
(চলবে)