অগ্রহায়ন মাসের শেষের দিকটা। আমন ধানের মৌ-মৌ গন্ধে প্রকৃতি যখন মাতোয়ারা হয়ে ওঠে আর মহাজনেরা তাদের ধান মাড়াই করে একটার পর একটা খড়ের পালা দিয়ে যায় তখন সাবিত্রী মরমুরও মনটা আনচান করে ওঠে। না হোক তার নিজের ধান তবু তার ঘরে বসে থাকতে আর ইচ্ছে করে না। কোঠা ঘরটা হয়ে ওঠে যেন আস্ত একটা বন্দিশালা। জগ-মানঝির নিকট হতে ধান আসার শুধু এই সময়টাতেই নারীদের পাড়ার বাইরে যাবার অনুমতি মেলে। বছরের বাকী সময়গুলোতে নারীদের বাইরে যাওয়া কঠোর ভাবে নিষেধ। তারা সাঁওতাল পাড়ার নারী। দল বেঁধে কোমড়ে ডালি, কুলা আর ছোট্ট একটা ঝাড়ু হাতে নিয়ে রওনা দেয় মহাজন পাড়ার দিকে। ঝাঁট-পাট দিয়ে, মহাজনদের খড়ের গাঁদার নিচে বে-খেয়ালে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট ধানটুকু সিং বোঙ্গা-র পরম প্রসাদ ভেবে তুলে নেয় নিজেদের ডালিতে। কোন দিন ২ সের তো কোন দিন ৫ সের। সারা বছরের খোরাকী জোগানোর ক্ষুদ্র একটা প্রয়াস। যদিও খোরাকী সংগ্রহ নিয়ে সাবিত্রী মরমু কোন কালেই বিচলিত ছিলনা বরং গাঁও-গেরামের বিচিত্র রকম সুন্দর সব মানুষের দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে মজা পায় সে। কি সুন্দর সব বাবুদের মেয়েরা। দুধে-আলতা গায়ের রঙ, কি সুন্দর তাদের চুল। মন ভূলানী, একেবারে মন কাড়ানী। শুধু ‘মহাজনের ব্যাটা’ গুলাই যেন একটু কেমন। ষোড়শী অসাড় এই দেহটার উপরই তাদের নজর। একটু একা দেখলেই ধান সাধে, টাকা সাধে। নিরুত্তর সাবিত্রী যেন তাদের প্রতি পরিহাসের হাসি হেসে চলে। সুন্দর মুখোশের আড়ালে ভদ্দরনোকরুপী এসব বাবুরা কোনদিন জানতেও পারেনা যে, পিতামাতা-স্বামী-পরিজনহীন এই অভাগিনীর ক্ষুধা আর যৌনতার উপর রয়েছে নিদারুন নিয়ন্ত্রণ, ক্ষুধা-যৌনতা যে তারই আজ্ঞাবহ দাস। দূরে কোথায় জানি ঢাকের বাদ্য বেজে ওঠে। মাদলের তালে তালে পা নাচাতে ইচ্ছে করে সাবিত্রী মরমুরঃ
মুরুৎ বাহা বাহায়েনা
বাহা বঁগা ফাগুন চাঁদো সেটেরেনা।
দারেরে মাতদম সারেড়না
আতো রে কড়া কুড়িল রিঝৌওয়েনা।
বাহা পরবটা কেন বছরে একবারই আসে এটা নিয়ে তীব্র আপত্তি রয়েছে সাবিত্রি মরমুর। অন্তত এই একটা দিনে ইচ্ছেমত হাড়িয়া খেয়ে নেচে-গেয়ে জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট গুলো ভূলে থাকা যায়। দুঃখ কষ্টের আরেক নাম সাবিত্রী মরমু। সাবিত্রীর যখন জন্ম হয় তখন বাবা-কাকারা স্থানীয় জোতদারদের অবৈধ দখল নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল-'হামার মাটি হামার মা, ছিনে লিতে দিব না।' ফলাফলটা ছিল খুব ভহাবহ। স্থানীয়রা সম্মিলিত ভাবে সকল কাজে হোরদের নিয়োগ বন্ধ করে দেয়, কাজের অভাবে হোর পাড়ায় নেমে আসে আঁকাল। মাত্র চার বছর বয়সে পিতা-মাতাকে হারিয়ে আত্মীয় পরিজনহীন হয়ে যায় সাবিত্রী মরমু। জগ-মানঝি আট বছর বয়স পর্যন্ত পালবার পর পবন হেমব্রমের সাথে তার বিয়ে করিয়ে দেয়। 'ডাঙুয়াবাপলা'য় সাবিত্রীর কোন আপত্তি না থাকলেও ঘোর আপত্তি ছিল পবনকে নিয়ে। পবন ছিল একটা পাড় মাতাল, কুড়ে এবং তার থেকে প্রায় বছর চল্লিশেক বড়। জগ-মানঝির হুকুম অমান্য করবার সাহস হোর পল্লীর কারোরই নেই। তার কথাই এখানে আইন। তার কথাই সংবিধান। বিয়ের মাত্র দুই বছরের মাথায় হাড়িয়া খেয়ে সেই যে পবন বেহুঁশ হল, এরপর তার আর হুঁশ ফেরে নাই। তার পর থেকেই সাবিত্রী আবারো একা।
পঙ্গু অনন্ত দাদার বাড়ি হতে কান্নার তীব্র চিৎকারে ঘোর কাটে সাবিত্রীর। হাড়িয়ার নেশায় চুর অনন্ত দাদার পিতা-মাতাহীন দু-দিনের অভুক্ত একমাত্র ভাইঝিটা ক্ষুধায় চিৎকার করে তার কাকার নিকট খাবার চেয়ে চলেছে আর তার সহায়হীন কাকা নির্বাকঃ
- কাকা! তু হামাক ছাতু দে। ফ্যান দে কাকা। বড়ই ক্ষুধা কাকা!
- ভগবানক ডাক মরমু! ভগবানক ডাক।
- ভগবান! আরে ঊ ভগবান? তু যদি হামাক খাওয়াবার-ই না পারবু তাইলে গরীব বানালু ক্যানে? আর গরীব-ই যদি বানাবু তাইলে ছোট বানালু ক্যানে? ছোট বানালু ক্যানে?
অতটুকুন মেয়ের গগন বিদারী চিৎকারে কেঁপে ওঠে সাবিত্রীর অন্তরাত্মা, কেঁপে ওঠে পুরো সাওতাল পাড়া। বিলাসীর এই কান্না শুধু বিলাসীর কান্না নয় বরং সারা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের হাজারো সাঁওতাল শিশুর কান্না। জন্মই যাদের আজন্ম পাপ। সাবিত্রীর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, তার যদি অনেক খাবার থাকত তবে এই পৃথিবীর কোন প্রানীকেই সে অভুক্ত থাকতে দিত না। কাউকে অভুক্ত রেখে নিজে খাবার খাওয়া যে অন্যায়, ঘোর পাপ। পুরো ঘর তল্লাসী চালিয়ে দু-মুঠো চালের জোগাড় করতে পারে সাবিত্রী মরমু। তাই ভেজে নিয়ে হাজির হয় বিলাসীর সামনে। চালভাজা! ক্ষুধা রাক্ষসকে তুষ্ট করতে এর জুড়ি নেই। আয়োজনটাও যৎ-সামান্য লাগে। গরম হাড়িতে ফেলে শুধু ভেজে নাও, তেল-লবন-পেয়াজ-রসুনের কোন বালাই নেই।
পরদিন প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠে ঘরের কাজ সেরে বোংগার পূজা দিয়ে ডালি, কুলা আর ঝাড়ুটা সাথে করে নিয়ে ছোট একটা দলের সঙ্গী হয়ে যায় সাবিত্রী। খোঁপায় একটা ফুল গুজবার সাধ ছিল আজ অনেক কিন্তু বাহা পরবের আগে সাঁওতাল নারীর ফুল স্পর্শ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। ঘর হতে বের হবার সময় বিলাসীটা এসে কানের কাছে চুপি চুপি বলে গিয়েছে, ‘ ও পিসী আসবার সময় হামার জন্য অনেক গুলা খোড়াক লিয়ে আসবি কিন্তু’। সাঁওতালদের, নিজ গোত্র ছাড়া অন্য গোত্রের পানি পর্যন্ত ছোওয়া নিষেধ। আর বাবুরা দিতেও চায় না, হোর-দের তারা অশুচি জানে। তবু সাবিত্রী চিন্তা করে রেখেছে চেয়ে-চিন্তে অথবা কাজের বিনিময়ে হলেও সে লুকিয়ে মহাজনদের কাছ থেকে বিলাসী-র জন্য খোড়াক নিয়ে তবেই আজ ঘরে ফিরবে। ক্ষুধা নিবৃত্তির চেয়ে বড় কোন ধর্মকার্য আর ইহধামে থাকতে পারে না।
এবার ধান একটু কম পাওয়া যাচ্ছে। মহাজনেরা এখন আর তেতুল কাঠের পিড়িতে পিটিয়ে ধান মাড়াই করে না, তেতুল কাঠের পিঁড়িটার জায়গায় এখন বসেছে ধান মাড়াই কল। একবার কলের চাকায় ধানের আটি যাওয়া মাত্র ছ্যাড়-ছ্যাড় করে সব ধান বের করে নেয় যন্তর রাক্ষস্টা। একটা খাস্তান পর্যন্ত আস্ত রাখে না। খড়ের মধ্যে আর ধান লেগে না থাকার কারনে উচ্ছিষ্টও খুব একটা পাওয়া যায় না। সারাদিন খেটে-খুটে সন্ধ্যা নাগাদ বড় জোর এক সেরের কিছু বেশি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। সঙ্গীরা ঘরে ফেরার তাগাদা দেয় সাবিত্রীকে। খুঁড়িয়া শাক তোলবার কথা বলে সঙ্গীদের সামনের দিকে এগুতে বলে চুপিচুপি সাবিত্রী গিয়ে ঢোকে গ্রামের জোতদার বলে খ্যাত সরকার বাড়িতে। সুন্দর সেই বড় বাড়িটা, যেটার দিকে যাওয়া-আসার পথে এতদিন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত সাবিত্রী।
- কি লো! তুমি সাতারনি (সাঁওতাল-নি) মিয়াটা না?
- জ্বি দিদি! হামার নাম সাবিত্রী আছে। হামি অল্প কয়টা খোড়াক চাইছি দিদি। কোন কাজ থাকলে হামি করে দিতেও রাজী আছি দিদি!
- তুমি সাতারনি মিয়া! তোমাকে দিয়ে কোন কাজ তো আমি করাতে পারব না বাপু।
- বড়ই ক্ষুধা দিদি! দু-দুটা দিন না খেয়ে আছি। যে কোন কাজ হামি করে দিতে রাজী আছি।
অবশেষে আধ সের চাল আর কয়টা আলুর বিনিময়ে পুরো বাড়ি ধোয়া-মোছার কাজে সাবিত্রীকে নিয়োগ দিতে রাজী হয় গৃহকর্ত্রী। পুরো দালান ঘর, রসুই ঘর, গোয়াল ঘর ঝাট-পাট দিয়ে সাফ সূত্র করছিল তখন মহাজন গোত্রীয় পঞ্চাশোর্ধ লোকটা সাবিত্রীকে দেখে উঁকি ঝুকি মারছিল। তারপর একটা সময় সাবিত্রীকে একা পেয়ে গিন্নীর অনুপস্থিতি নিশ্চিত করে, লোকটা একটা কড়কড়ে একটা বিশ টাকার নোট তার হাতে আচমকা গুঁজে দিল।
- কিসের টাকা মহাজন?
- তোকে খুশি হয়ে দিলাম রে!
- খুশি হয়ে টাকা তো হামি লিতে পারব না মহাজন। কোন কাজ থাকলে বলেন।
- কাজ! হ্যাঁ কাজ তো আছে রে। চাইলে আরো বিশ টাকা পাবি।
- কি কাজ মহাজন?
- বুঝিস নি!
- না বাবু।
- কাউকে যদি না বলিস তবে বলি।
- ঠিক আছে বাবু। হামি কাউকে বলব না।
- সত্যি তো?
- হ্যাঁ সত্যি বলছি বাবু।
- তোর নাম কি রে?
- হামার নাম সাবিত্রী মরমু আছে মহাজন।
- শোন সাবিত্রী আমি তোকে আরো বিশ টাকা দেব। বিনিময়ে তুই একবার শুধু আমাকে দিবি। শুধু একবার। আমি পথের ধারে চালকির ভিটাটায় থাকব, তুই কাজ শেষ করে চলে আসবি।
গৃহকর্তার এমন প্রস্তাব নতুন কিছু নয় সাবিত্রীর জন্য। পুরুষ মানুষ মাত্রই এই, শুধু ছোক ছোক করে। নারী দেহ মাত্রই তাদের নিকট যৌবন জ্বালা মেটানোর অনুসঙ্গ বৈ আর কিছু নয়। সদ্য গোপনাঙ্গে লোম গজানো কিশোর থেকে শুরু করে বিছানায় শয্যাশায়ী মুমূর্ষু বৃদ্ধ কিংবা চার্চের ফাদার যে কিনা সিং বোঙ্গার অবস্থানে 'গড' কে বসিয়ে সারাদিন ধর্মকথা শোনান। কেউ এর বাইরে নয়। আর নারীটা যদি হয় নিচু কুলের তবে তো সে গনিমতের মাল, সে পতিতা। কেউ প্রকাশ্যে প্রস্তাব দেয় আবার কেউ দেয় গোপনে, চুপি চুপি। গতবার যখন কৃষ্ণপুরে তারা ধান কুড়োতে গেল তখন তো কিছু ছেলে তাদের পথ রোধ করে রীতিমত পুরো দলকে হোর-দের ভাষাতেই বলে বসল, 'দেবের দেবের কিতেয়া?' উঠতি বয়সের এসব তরুনেরা জানতই না সভ্য ভাষায় এই বাক্যটা অনুবাদ করলে এর অর্থ কতটা ভয়ানক, কতটা লজ্জ্বার হয়ে ওঠে। কোন এক হোরের সাথে হাড়িয়া খেতে খেতে হয়তোবা তাদের শিক্ষা এতটুকুনই। কিন্তু তারা শুধু হোর নয় বরং পুরো মানব সমাজ হতে এই শিক্ষাটা গ্রহন করতে ব্যার্থ হয়েছে যে একজন নারী শুধু কাম-পিপাসা মেটানোর বস্তু নয় বরং সমাজে একজন নারী একজন জননী-ভগিনী-জায়া-পত্নী।
কড়কড়ে বিশ টাকার নোটটা সাবিত্রী মহাজনের মুখের উপর ছুড়ে মেরে হনহন করে বেরিয়ে চলে আসে। সুন্দর এসব মানুষেরা যে এতটা অসুন্দর হতে পারে তা সাবিত্রীর কল্পনাতেও ছিলনা। এইসব ভদ্দরনোকেরা সাঁওতালদের দিয়ে কাজ করাতে পর্যন্ত ঘেন্না করে অথচ তাদের শরীরটা নিয়ে আদিম খেলায় মেতে উঠতে জাত-পাত বলতে তখন আর কিছু থাকেনা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে। ঘন, নিকশ-কালো সে রাত। পারিশ্রমিকের আধ সের চাল আর আলু আচলে বেঁধে ঘরের দিকে হাটা দেয় সাবিত্রী মরমু।
হাড়িয়ায় মত্ত্ব গোদারপাড়া সাঁওতাল পল্লীর কোন পুরুষ সাবিত্রীর ঘরে না ফেরার খবর সে রাতে রাখেনি। বিলাসীটা শুধু ঠায় দাঁড়িয়েছিল এটুকুন আশা নিয়ে যে পিসি ফিরবে, সাথে করে অনেকগুলো খোড়াক লিয়ে। পরদিন সকালে সাবিত্রীর লাশ পাওয়া যায় রসুলপুরের চালকীর ভিটায়। ক্ষত-বিক্ষত, বিবস্ত্র আর কুকুরে কামড়ানো। ছড়ানো-ছিটানো চাল আর আলুর সাথে মাখামাখি বিবস্ত্র রক্তাক্ত একটা নারীদেহ। পুলিশ বলেছে মার্ডার আফটার রেইপ। বড়ই জটিল কেইস। এমনই জটিল যে, গোদারপাড়ার লোকেরা পর্যন্ত লাশ শনাক্ত করতে আসে নাই। মামলা-মোকদ্দমা, টাকা-পয়সা সে বিরাট ঝামেলার ব্যাপার। অবশেষে গ্রামের জোতদার হাসান সরকার দয়া-পরবশ হয়ে এগিয়ে আসলেন। তিনি পুলিশের হাতে হাজার পাঁচেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিষয়টির একটি সুরাহা করে গোদারপাড়ার সাঁওতালদের হাতে লাশ হস্তান্তর করলেন। লাশ নিয়ে ফেরার সময় সাঁওতালেরা ‘জয় হাসান মহাজনের জয়’ রব তুলতে তুলতে প্রস্থান করিলেন।
সাঁওতালী ভাষায় ব্যবহ্রত নির্দেশক শব্দ সমূহের বাংলা অর্থঃ
রাঢ়াঙ- দূরাগত মাদলের ধ্বনি
জগ-মানঝিঃ সহকারী গ্রাম প্রধান
ডাঙুয়াবাপলা- অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী সাঁওতালি সমাজে যে বিয়ে হয়
বোঙ্গা- সূর্য্য দেবতা
কোঠা ঘর- কাঁদা মাটি দিয়ে তৈরি ঘর
বাহা- প্রধান ধর্মীয় উৎসব
হাড়িয়াঃ স্থানীয় মদ বিশেষ
ছাতু- গম অথবা জবের গুঁড়া
খোড়াক- ভাত
দেবের দেবের কিতেয়া- আমাকে তোমার সাথে যৌন সঙ্গম করতে দিবে?
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:৪৮