“হামরা হচি বাহে অচ্ছুতের এমন অচ্ছুত
যে হামাক দেখি, কুকুরগুলা পর্যন্ত ঘাউ ঘাউ করি উঠে’’
(আমরা হচ্ছি বাবা এমন অচ্ছুতের অচ্ছুত, যে আমাদেরকে দেখে কুকুর গুলো পর্যন্ত ঘেউ ঘেউ করে উঠে)
কথা গুলো বলছিলেন বৈদ্যনাথ মন্ডল। যিনি পেশায় একজন শুকর পালের রাখাল। বর্ষার শুরু হলেই শুকরগুলোর চারণভূমি পানিতে তলিয়ে যায় এবং দেখা দেয় খাদ্য সংকট। শুকরদের আর ঘরে রাখা যায় না সেসময়। বৃষ্টির পানিতে তখন ‘শূকর রাখালগন’ তাদের একপাল শূকর নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তারা শূকর চড়িয়ে বেরান এই পাড়া সেই পাড়া, এই জেলা সেই জেলা, এই অঞ্চল সেই অঞ্চল। বৈদ্যনাথ মন্ডল তাদেরই একজন। যিনি কিনা শূকর পাল নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েছেন। ঠিক জানেন না, এবার তিনি কোথায় যাবেন। গতবার তিনি রংপুর থেকে গিয়ে ঠেকেছিলেন সাতক্ষীরা পর্যন্ত। পুরো দেশ জুড়ে খেয়ে চলা এসব শূকরেরা এই পালের মধ্যে একটা আরেকটার সাথে যৌন সঙ্গম করে, তারা গর্ভবতী হয়, বাচ্চা প্রসব করে, শাবকেরা বড় হয় আর কেউ কেউ বিক্রি ও হয়ে যায়।
রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের বাসিন্দা বৈদ্যনাথ মন্ডলের এবারের যাত্রায় তার একমাত্র সঙ্গী হল শূকর নামক নিকৃষ্ট জীবগুলো, একটা ছড়ি আর সাথের একটা পোটলা। ছড়ি ঘুড়িয়ে তিনি শূকর পালকে কমান্ড করেন। আর তার প্রতিটা কমান্ড অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে এই শূকর সন্তান গুলো। তারা জানে কোন কমান্ডে তাদের রাস্তায় উঠতে হবে আর কোন কমান্ডে নামতে হবে চারন ভূমিতে কিংবা কখন তাদের বিশ্রামের সময়। কমান্ডের বাইরে কারো যাবার জো নেই। এক অর্থে তিনি একজন দক্ষ কমান্ডারও বটে। যেখানে রাইত সেখানে কাইত নামক তত্ত্বে যেখানেই রাত নামে সেখানেই ‘শূকর রাখাল’ তার তাবু (আসলে পলিথিন) ফেলে শুকরের সাথে রাত্রী যাপন করেন। তাদের সাথে থাকা পোটলায় থাকে খাবার-দাবার, সরঞ্জাম আর পলিথিন। খাবার দাবার মূলত মালিকেরাই দিয়ে দেন আর সেই সাথে বেতন হিসেবে প্রদেয় হয় প্রতি মাসে ৫০০০ টাকা। এই সামান্য কিছু টাকার দিকে মুখিয়ে থাকে অভাব আর দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত শূকর রাখাল পরিবারগুলো। পরিচালিত হয় ‘শূকর রাখালে’র আস্ত একটা পরিবার। উত্তরন সেখানে অসম্ভব, ‘শূকর রাখালে’র ঘরে জন্ম হয় আরেক ‘শূকর রাখালে’র। আর মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় অল্প বয়সে, হয়তোবা আরেক শূকর রাখালের সাথে।
পতিত জমিতে শূকর চরালে জমি উর্বর কিংবা জমির আগাছা দমন হলেও বংশানুক্রমিক এই পেশাটি সমাজের ‘ভদ্র লোকেদের’ কাছে বিবেচিত হয় শূকরের মত নিকৃষ্ট হিসেবে। অনেক গৃহস্থ ঘর মাঝে মাঝে তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে পর্যন্ত দেয় না এসব অচ্ছুতদের। বেশ ঘৃন্য একটা কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়, সকলে তাদের এড়িয়ে চলে। অথচ সমাজের অনেক সম্মানিত মুসলমানও রয়েছেন এই শূকর পালের মালিক। শূকর বিক্রির টাকা দিয়ে তারা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরন করেন। এতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না, যত সমস্যা এই শূকর রাখালদের।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১২:০৬