বয়স কম থাকলে পৃথিবী রঙীন দেখায়। জীবন নিয়ে আমার উপলব্ধিগুলোর মধ্যে এটা একটা।
কৌরব-পাণ্ডবের পিতামহ ভীষ্মের জীবনের মধ্যে কী যেনো আছে। মনের গহীনে একটা চোরকাঁটার মতন বিঁধে আছে তাঁর জীবন। বয়স বেশি হলে জীবন যে বেরঙীন হতে থাকে এটা বোধ হয় আমার মধ্যে সেঁটে দিয়েছেন এই মহাবীর। অবশ্য বিষয়টিকে সত্যিকারের উপলব্ধিতে এনেছে আমার বাবার মৃত্যু— জীবনের ‘স্বান্ত্বনাহীন শোক’। ‘স্বান্ত্বনাহীন শোক’ শব্দটা তপন রায় চৌধুরীর থেকে ধার করলাম।
ভীষ্মের সাথে পরিচয়ের আগে কবর কবিতার দাদুর বেরঙীন জীবন দেখেছিলাম। তখন কবিতার দু:খটা ছুঁয়েছিল শুধু, অর্থটা না। ভীষ্ম নাম্নী দেবব্রতর জীবনের সুতো ধরেই পরে জসীম উদ্দীনের ডালিম গাছের তলা দেখিয়ে ভেঙে পড়া বৃদ্ধের কথাও মনে আসে।
‘বন্দি’ নামে আমার নিজের লেখা একটা গল্প আছে। মূল চরিত্র এক অশিতীপর। জীবন তার কাঁধে পাথরের মতন চেপে বসে। জীবন-পাথর নিয়ে মৃত্যুর পুকুরে টুপ করে ডুবে যেতে চায় বৃদ্ধ। কিন্তু আত্মহনন করতে পারে না বৃদ্ধ আস্তিক। তাই, সালাতুল হাজতের নামায পড়ে নিজের মৃত্যু কামনা করে।
গল্পের শেষে বৃদ্ধের মৃত্যু লেখা নেই। একটা ছোটো স্বপ্নের কথা আছে। স্বপ্নের অর্থ নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন তারা হয়তো বিষয়টা রিলেট করবেন।
কৈশোর পেরোনোর পর থেকেই স্বপ্নের বই ফালনামা খাবনামা নিয়ে আগ্রহ ছিল। ১৯৯৮ সাল, নাইনে পড়ি। তখন আমার এক খালার বাসা থেকে চটিমতন একটা খাবনামার বই এনেছিলাম। ক’টা পাতা ছেঁড়া। সেটি আজও আমার কাছে আছে। ওই দিয়ে শুরু।
তারপরে, কত্ত ফালনামা, খাবনামা খোঁড়াখুঁড়ি করলাম! ড্রিম এবং এর মিনিং নিয়েও গুঁতোগুঁতি চললো! একই স্বপ্নের ইসলামিক ব্যাখ্যা একরকম তো ভারতীয় বা হিন্দুমতে আরেক রকম আবার খ্রীস্টান মতে অন্য অর্থ।
স্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যায় প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে বেশ ফারাক। শুধু বিশ্বাস বা সংস্কৃতি ভেদে নয়, একই স্বপ্নই ব্যক্তি ভেদেও ভিন্ন হয়।
স্বপ্ন নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানও বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। মনোবিশ্লেষকরা স্বপ্নকে বাস্তবের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। আধ্যাত্মবাদী ও বিশ্বাসীরা বাস্তবকে স্বপ্নের আলোকে ব্যাখা করতে চান। একপক্ষের বাস্তবের মধ্যে ঢুকে গেছে স্বপ্ন, আরেকপক্ষের স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গেছে বাস্তব।
ডায়না দীর্ঘদিন ফিরে-ফিরে একটি স্বপ্ন দেখতেন। পতনের স্বপ্ন। মনে হতো, কেউ তাকে ফেলে দিচ্ছে। খুব ভয় পেতেন। স্বপ্নের মধ্যেই। ভাবতেন, পড়ে গেলে কেউ কি তাকে ধরবে? ডায়নার স্বপ্নের কথাটা তাঁকে নিয়ে নির্মিত এক সিনেমায় পেয়েছিলাম। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এই স্বপ্নটাই ডায়না ভিন্ন ভাবে দেখতেন। সেটাও পতন দৃশ্য। কিন্তু তখন, সেই পতনের অনুভূতিতে, তিনি আর ভয় পেতেন না। ওটাকে আর পতনও মনে হতো না তাঁর। মনে হতো, যেনো উড়াল। তখন, মনে হতো, স্বপ্নের মধ্যেই, উনি একধরনের আনন্দ পাচ্ছেন।
পতন দৃশ্যে ভয় না পাবার ঘটনাটা ঘটবার আগে ডায়নার জীবনে একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। পাকিস্তানী ডাক্তার হাসনাতের প্রেমে ডুবেছিলেন। হাসনাতও তাকে গভীর ভালোবাসত। রাজবধূ ততদিনে একা। সমগ্র ভুবন তার পায়ে অঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হলেও ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন ভীষণ একা, বিষণ্ন আর ভালোবাসা কাতর।
চার্লসের সাথে বিয়েটা ভাঙতে চাননি। কিন্তু ভাঙলো। এমনি বোধহয় জীবনের খেল। একদিকে, তামাম দুনিয়া হাঁটু গেঁড়ে বসতে প্রস্তুত তার পায়ের কাছে, আরকদিকে ভালোবাসাহীনতায় নিজের ভেতর কুঁকড়ে মরেছেন তিনি। এমন এক বাস্তবতায় হাসনাতের সাথে প্রেম। প্রেমকে পরিণয়ে নিতে ডায়না আকূল ছিলেন। পাকিস্তান সফরের উছিলায় হাসনাতের পরিবারের সাথেও সময় কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু ওই যে! বিধি বাম!
ভুবনজোড়া খ্যাতি, নাম, পরিচয়, রাজবধূর রাজটিকা! ওগুলো সব মিলিয়ে হাসনাতের পরিবার ডায়নাকে মেনে নিতে চায়নি বলেই গুঞ্জন।পরিবারের অমতে যেতে আমতা-আমতা করে হাসনাত। তাই, এই প্রেমটাও টেকেনি। সেই মনোকষ্টও বুঝি নীলনয়নাকে দোদির দিকে ঠেলেছিল।
এই যে স্বপ্নের মধ্যে তার আর ভয়টা ছিল না, বরং তিনি উড়ালের আনন্দ পেতেন, সেটা কি ছিল তার বাস্তব জীবনের ‘ঝড়কে আমি করবো মিতে, ডরবো না তার ভ্রুকুটিতে’ বোধেরই প্রতিচ্ছবি? গভীর ভালোবাসার শেষ মানুষটিকেও হারিয়ে ‘কুছ পরোয়া নেহি’ বলে পতঙ্গের মতন জীবনের অগ্নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুভূতিটাই কি তার স্বপ্নে ফিরে আসছিল? আমি বোঝার চেষ্টা করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফ্রয়েডের সাথে পরিচয়। সাংবাদিকতা বিভাগেও হাল্কায় ফ্রয়েডকে চেনানো হয়েছিল। বিভাগের আগেই জিগমুন্ড সাহেবের সাথে মোলাকাত।পরে ইয়ুং-এর সাথে। স্বপ্নের সাইকোএনালিটিকেল ব্যাখ্যা আর সোলেমানি খাবনামার অর্থ এক না।
স্বপ্ন নিয়ে মানুষের কৌতুহল চিরপুরাতন। মায়ানদেরও স্বপ্নের ব্যাখা পাওয়া যায়। ইসলামে মুমিনের স্বপ্নকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। মাওলানা রুমির মনমহাজন বা আধ্যাত্মিক গুরু শামস নাকি স্বপ্ন দেখতেন না। স্বপ্ন না দেখার মনোজগতও একটা দারুণ ব্যাপার।
ধান ভানতে শিবের গীত ধরেছি। স্বপ্ন বা স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে বলা উদ্দেশ্য নয়। বয়স বাড়তে থাকলে যে মানুষ জীবনের রঙ হারিয়ে ফেলে সেকথা বলতে গিয়েই শিবের গীত এলো।
শুরু করেছিলাম ভীষ্ম দিয়ে। থেমেছিলাম আমার একটা গল্পে। যেখানে জীবন বেরঙীন হয়ে যাবার পর এক বৃদ্ধ সালাতুল হাজতের নামায পড়ে নিজের মৃত্যু কামনা করে। গল্পের নাম বন্দি। গল্পের শেষে একটা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নে ওই বৃদ্ধ বিয়ে করতে যাচ্ছে। গ্রামের শেষ প্রান্তের বিলে নৌকায় নববধু সেজে বসে আছে বৃদ্ধের মৃত স্ত্রী। নওশাহ বেশে এখন বৃদ্ধের যাবার পালা।
সুফিজমে মৃত্যু মানে পরম প্রভুর সাথে মোলাকাত। আর আমাদের ময়-মুরুব্বিদের দেখেছি, তাদের জনপ্রিয় বিশ্বাস হচ্ছে, খুব বয়োবৃদ্ধ লোক যখন স্বপ্নে নওশাহ বেশে বিবাহ করতে যায় বা বিবাহের প্রস্তুতি নেয় এর অর্থ হলো মৃত্যু সমাসন্ন।
যাই হোক, জীবনের বিষাদে ফিরি। এই বলে শুরু করেছিলাম যে, বয়স কম থাকলে জীবন রঙীন লাগে। জমিদার তনয় তপন রায় চৌধুরীও তার আত্মচরিত বাঙালনামায় এমনি বলেছেন। রায়বাবু লিখেছেন, ‘সব কিছুরই রং যেনো বেশি উজ্জ্বল ছিল। সব কিছুই অন্তহীন বিস্ময়ের আকর। বাগানের কোনায় কোনায় লাল-সাদা চন্দনের ফোঁটার মতো চিহ্নে ভরা কচুপাতার জঙ্গল। তার উপর বৃষ্টি বা শিশিরের জল টলটল করত। সত্যিই মনে হত মস্ত বড় মুক্তোর দানা। [...] প্রথম শৈশবে সব বর্ণাঢ্য জিনিসেরই রং যেমন খুব উজ্জ্বল দেখায়, তেমন অনেক জিনিসই আকারে খুব বড় মনে হয়।’
পরে অক্সফোর্ডে ছাত্র থাকার সময় এক গবেষকের গিনিপিক হয়ে মেস্কালিন সেবন করেন চৌধুরী সাহেব। মেস্কালিনের গুণে তাঁর কাছে ক্ষণিকের জন্য শৈশবের সেই ঔজ্জ্বল্য ফিরেছিল বলে তিনি লিখেছেন। ‘যে-ঔজ্জ্বল্যের কথা ভুলে গিয়েছিলাম, মেস্কালিন প্রভাবে সেই ঔজ্জ্বল্য আবার কিছুক্ষণ চোখে দেখি। ফলে, আমার ধারণা জন্মায় যে, আমাদের কিছু কিছু ইন্দ্রিয়বোধ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোঁতা হয়ে আসে। শিশুর ‘অকারণ পুলক’ এর কারণ বোধ হয় তার চোখে পৃথিবীর উজ্জ্বলতা।’
বয়স বাড়তে থাকলে ক্রমে এত ব্যথা এত ক্লেদ জমে যে, মহাবীর ভীষ্ম আর অনুল্লেখ্য গ্রামের বয়োবৃদ্ধের জীবন একই দাগে বেরঙীন হয়ে মিলায়।
জীবনের বিবর্ণতা নিয়ে লিখছি বলে ভেবে বসবেন না আমার জীবনও বেরঙীন হয়ে আছে। রং-রস ফুরোয়নি। জীবনের প্রতি আগ্রহও অটুট। সব কিছু ধূসর লাগার বয়সও হয়নি। তবে, উজ্জ্বলতা কমেছে। উজ্জ্বলতার প্রশ্নে রায়বাবুকে দোহাই মানি। উজ্জ্বলতার প্রসঙ্গে অবশ্য উডি এলেনকেও জরুরি তলব করা যায়।
এলেনের ‘এনি হল’ আমার বেশ প্রিয় সিনেমা। সেখানে বয়স বছর দশের কম ছেলে আলভিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় তার ত্যাক্ত-বিরক্ত মা। ডাক্তার আলভিকে জিজ্ঞেস করে, কেন তুমি বিষাদগ্রস্থ?
আলভী মাথা নিচু করে বসে থাকে। তার হয়ে ডাক্তারের সাথে সওয়াল-জওয়াব করে তার মা। মা বলে, সে পত্রিকায় জানি কী একটা পড়েছে। কৌতুহলী ডাক্তার বলে, ওহ! কিছু একটা পড়েছে! তখন আলভী জানায়, ‘দি ইউনিভার্স ইজ এক্সপান্ডিং’।
এই উত্তরে গরম তাওয়ায় পানি পড়ার মতন ছ্যাৎ করে ওঠে মা। ডাক্তার ভাবলেশহীন। এমতাবস্থায় আলভী ব্যাখ্যা দিয়ে বলে, দেখো ব্রহ্মাণ্ডইতো সবকিছু। সম্প্রসারিত হতে-হতে একদিন এটা ভেঙে পড়বে। আর তখন তো সব কিছুরই সমাপ্তি।
ব্রহ্মাণ্ড সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাই, পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছে শিশু আলভী।
ব্রহ্মাণ্ড সম্প্রসারিত হওয়ার মাথা নষ্ট করা উত্তর জেনে আলভীর মা ক্ষিপ্ত স্বরে বলে, ব্রহ্মান্ডের সাথে তোর কী সম্পর্ক! তুই আছিস ব্রুকলিনে। ‘ব্রুকলিন ইজ নট এক্সপান্ডিং’।
ডাক্তার অবশ্য আরেকটু শমিত ভাষায় আলভীকে মহাজগত থেকে জাগতিক লাইনে আনার চেষ্টা করে। তাকে বুঝিয়ে বলে, [ব্রুকলিন] এটা আরো কোটি কোটি বছর ধরে এমনি থাকবে। সম্প্রসারিত হতে-হতে ভেঙে পড়বে না। অতএব, যতদিন আমরা এখানে [ব্রুকলিন/পৃথিবী] আছি আমাদের আনন্দে বাঁচার চেষ্টা করাই শ্রেয়।
উডি এলেনের আলভী অতি অল্প বয়সে গভীর সত্য জেনে ফেলায় তার জীবনের রং পাল্টে যায়। এখানে বয়স একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বয়স বাড়তে থাকার সাথে সাথে আমরা ইনোসেন্স হারাতে থাকি। আমাদের আত্মার বিশুদ্ধতা ক্ষয়ে যেতে থাকে। তখন, আমরা কায়দা শিখে যাই। ছল করে জতুগৃহে পাঠানো এবং কল করে জতুগৃহ পালানো সবই আয়ত্তে আনার কায়দা শেখায় সময়। কায়দা করে বেঁচে থাকা, কায়দা করে বড় হওয়া, কায়দা করে অর্জন— সব আমাদের সয়ে যায়। কিন্তু নির্মলতার দিনগুলোতে আমরা সবাই গ্রেটা থুনবেরি। স্কুল বয়কট পরবর্তী লাভ-লসের হিসেব না কষে একলাই প্রতিবাদে বসে যাই।
জীবনের এই যে দশা এটিই কি ভালোবাসা ও জীবন সম্পর্কে কাহলিল জিবরানীয় সত্য? ‘To be wounded by your own under-standing of love;/ And to bleed willingly and joyfully’. নিজেরই বোঝাপড়া বা চেতনার ঘায়ে মানুষ বিদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় যিশুর মতন কাঁধে বয়ে চলে ক্রুশ কাঠ?
জীবন ও জীবনের ব্যাখ্যাও অনেকটা স্বপ্নের মতই। একই স্বপ্ন দেখলেও ব্যক্তিভেদে— পাপাচারী দুরাত্মা ও পূণ্যবান— স্বপ্নের অর্থ আলাদা হয়। তাই, ভীষ্মের মতন ত্রিকালদর্শী না হয়েও এককাল না-পেরোনো আলভীর জীবনের বেরঙীনত্বও সত্য।
আলভির মতই যাদেরকে ধরে ফেলে এম্পটিনেস অফ এক্সিসটেন্স বা অস্তিত্বের নিগূঢ় শূন্যতা তাদেরকে রায় সাহেবের মেস্কালিন দিয়ে দেখা যেতে পারে। ‘অকারণ পুলক’ যদি আবার হঠাৎ ফেরে!
ভীষ্মের মতন ত্রিকালদর্শী নই। আলভীর মতন এককালেও নেই। ঘটনার ঘনঘটায়, অভিজ্ঞতার ঘাতে মানুষের দেখবার চোখ খোলে। আবার অভিজ্ঞতার ঘাতেই মানুষ হারায় ‘অকারণ পুলক’-এর উজ্জ্বলতা।
আমিও কি আলভী হয়ে ওঠছি? মাঝে মাঝে নিজেকে এই প্রশ্ন করি। উত্তর আসে, ‘উঁহু’। তবে, রায়বাবুকে অস্বীকারের উপায় নেই। উজ্জ্বলতা ক্ষয়েছে।
আমিও কি আলভী হয়ে ওঠছি? এই প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য মাঝে-মাঝে ‘উঁহু’ বলবার জোর কমে যায়। তখন নীরবতা হীরন্ময়। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে জুতো কয়েকদিন এক কোণায় পড়ে থাকলে তাতে শ্যাওলা জন্মায়। ওই জুতোই রোদে শুকালে শ্যাওলা মরে ভূত। এক্কেবারে উধাও। শ্যাওলার কি কোনো স্বর্গ-নরক আছে?
জুতার শ্যাওলার সাথে আমার মৌলিক ফারাক কোথায়? ফারাক খুঁজে না পাওয়াটা কি অস্বাভাবিকতা? যেমন আস্বাভাবিক ছিল মহাকাশের সম্প্রসারণের সাথে আলভির ‘হোম ওয়ার্ক’ না করার সম্পর্ক? ‘এনি হল’ চলচ্চিত্রে আলভী সম্পর্কের সত্যের অন্বেষণ করতে চেয়েছে। খুঁজেছে ভালোবাসার প্রকৃত চরিত্র। সেখানে যদিও নর-নারীর প্রেমই মূখ্য। কিন্তু অনেকগুলো বসন্ত ও শীত ধরে আমিও কি খুঁজিনি মানুষের সম্পর্কের সত্য? করিনি কি মানুষের ভালোবাসার প্রকৃত চেহারা সন্ধান?
আসলে স্বপ্নের ব্যাখ্যা বা ডায়না বা আলভীর কথা বলতে এই লেখার সূত্রপাত নয়। সত্যি বলতে অত কথা যে বলা হবে, লেখা শুরু করবার সময় এসবের কিছুই মাথায় ছিল না। লিখতে চেয়েছিলাম বছর শেষের উপলব্ধি।
২০২০। পৃথিবীর হৃৎপিণ্ডে কামড় বসানো বছর। কয়েক হাজার বছরের কথা বলছি না। ততদিন পৃথিবীতে আরো বড় বড় বিপর্যয় নিশ্চয়ই আসবে। আজকের ভৌগলিক-রাজনৈতিক-সামাজিক পৃথিবীও আর এমন থাকবে না। তবে, কয়েক শ’ বছর ধরে ২০২০ সালকে মনে রাখবে আগামীর পৃথিবী। এমনটাই অন্তত ইউভাল নোয়াহ হারারির মত।
মহামারীর মধ্যে বসে কাটানো বছর নিয়ে দু’কথা মনের মধ্যে বুদ্বুবুদ্বিয়ে উঠেছিল। তাই, ধান ভানা— মানে লেখার শুরু।
মহামারীর মধ্যে কত জীবন চিরতরে বিবর্ণ হয়ে গেছে! পরিজন হারিয়ে কত মানুষের বুকে বসেছে চিরস্থায়ী ক্ষত। শোকের রঙে একাকার হয়ে গেছে ইতালি-চীন-আমেরিকা-ইংল্যান্ডের মানচিত্র।
২০২০। ঘরের ভিতরে বাবার লাশ পড়ে আছে। বডি সরাতে মা পাগলের মতন চাইছে কারো সহায়তা। স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যস্ত। প্রতিবেশীরাও বেরোচ্ছে না প্রাণভয়ে। লাশ সরানোর লোক মিলছে না। ছোট্ট শিশু লাশের সাথে এক ঘরেই কাটাচ্ছে একাধিক দিন। চোখের ভেতর এই ধূসরতা নিয়ে বড় হবে পৃথিবীর যে সন্তান তার চোখের রং কে ফিরিয়ে দেবে?
২০২০। হাসপাতালের হিমঘরে আর লাশ রাখবার জায়গা নেই। বাথরুমে একের পর এক মৃতদেহ স্তুপিকৃত করে রাখছে শীতপ্রধান দেশের যে স্বাস্থ্যকর্মীর দল তাদের জীবনে রং লাগানোর মতন উজ্জ্বল বসন্ত কবে আসবে?
২০২০। কবরের স্থান সংকটে পড়ে গণকবরে শেষশয্যা ভাগাভাগি করেছে যে ধনী ও গরীব, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী, সেই গল্প কবে লিখতে সমর্থ হবে কোন এরিক মারিয়া রেমার্ক?
মহামারীর ঝটকায় লাখ লাখ মানুষের জীবন ঝড়ে পড়া নৌকার মতন উল্টে গেছে। ডুবে যাওয়া তরণীর শঙ্কিত যাত্রীদের এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনের জন্যে চোখ বুজে মৌন থাকি কিছুক্ষণ। তাদের রঙ-হারানো প্রাণের উদ্দেশ্যে পাঠাই কিছু শুভাশীষ। ব্যাখ্যাতীত ব্রহ্মাণ্ডের কোনো এক জাদুর বলে যদি এ শুভাশীষ তাদের প্রাণে পৌঁছায়!
মহামারীর দিনগুলোতে জীবনের কাছে আরো নতজানু হতে চেয়েছি। জীবনের জন্য মা প্রকৃতিকে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলতে চেয়েছি, ধন্যবাদ। আমার জন্য অপেক্ষা করবার মতন প্রিয়জনেরা আছে, দেখবার জন্য আমার চোখ আছে, হেঁটে চলবার মতন শারিরীক সুস্থ্যতা আছে, মাথার উপর ছাদ আছে, টেবিলে খাবার আছে। অতএব এই তো সময়। নিজেকে বলি, ভালো আছি! জিবরানের ভাষায় বলা যেতে পারে, নব প্রভাতে নতুন করে আবারো প্রেমময় একটি দিন পাওয়া গেলো বলে ধন্যবাদ দাও। ‘ To wake at dawn with a winged heart and give thanks for another day of loving’।
যা বলতে চেয়ে লেখার শুরু তার অর্ধেক বলা হলো। আরেক পিঠ বাকি। সে পিঠেই কি আছে নিখিল জীবনের নৈরাশ্য ও অর্থহীনতা?
স্কুলে থাকতে বছর শেষে সবসময় কবিতার খাতায় সংখ্যা গুণতাম। ৯৮ থেকে ব্যাপারটার শুরু। তখন ক্লাশ নাইন। ইউনিভার্সিটিতেও অভ্যাসটা ছিল। স্কুলে থাকতে লিখতাম লাল-নীল-হলুদ-সবুজ-বেগুণী রঙের ছোটো হোয়াইট প্রিন্ট খাতায়।
এমন কিছু মহার্ঘ্য সেগুলো ছিল না। দুনিয়ার কাছে তুচ্ছ ছত্রগুলোই ছিল আমার অমূল্য সম্পদ। সেগুলোকে বছর শেষে নেড়েচেড়ে দেখতাম। কলেজে উঠতে-উঠতে ডায়রীতে কবিতা তোলা শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়েও তাই ছিল। দূর ইউরোপের এক দেশে যাবার সময়ও সাথে ছিল কবিতা ও দিনলিপির ডায়রী। কিন্তু কবে যে ডায়রীতে কবিতা তোলা বন্ধ হয়েছে তার দিনক্ষণ আজ আর মনে নেই। কবে? শেষ কবে ডায়রীতে কবিতা ওঠেছে? কবে শেষ হাত পড়েছে দিনলিপির খাতায়?
দিন-তারিখ মনে নেই। ঘটনা মনে আছে শুধু। একসময় হাতে লিখতাম। সংবাদ গল্পও, কবিতাও। পরে, সরাসরি কম্পিউটারে নিউজ রিপোর্ট লিখতে পারলেও কবিতা হতো না। কবিতা হাতেই লিখতাম, কাগজে। কিন্তু কবে যে কম্পিউটারে লিখতে-লিখতে কাগজে লেখার স্মৃতিই ভুলে গিয়েছি সে আর মনে নেই। কাগজ এখন এতটাই অনভ্যেস যে, দশ পাতা লিখতে দেয়া রিমান্ডে নেবার সমতুল।
শৈশবে যেমন কোনো মহার্ঘ কিছু লেখা হয়নি, এই সাঁইত্রিশেও জীবন তেমনি আছে। ফারাক হয়েছে এইটুকু যে, ‘অকারণ পুলক’-এর দিনগুলোর মতই আঙুলের কড়েতে কবিতা গুণবার দিন ফুরিয়েছে। কিন্তু কেন? কেন এমন হয়? অস্বিত্বের অর্থহীনতা টের পেয়ে আলভী তার হোম ওয়ার্ক করা বন্ধ করে দিয়েছিল। অস্বিত্বের অর্থহীনতা টের পেয়ে আমার মন কেন গায়, 'তোমরা যা বলো তাই বলো, আমার লাগে না মনে'? কেন মনে হয়, 'আমার যায় বেলা। বয়ে যায় বেলা'?
অস্বিত্বের অর্থহীনতার মতো নিজের বিলো-এভারেজ বুদ্ধিমত্তা ও সৃষ্টিশীলতাকেও টের পেয়েছি। এটাও কি আমার অকারণ পুলক-এর উজ্জ্বলতা কমার কারণ?
সব মানুষই নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা ভাবে। মনে করে, তার জীবনটাই বুঝি আলাদা। ভাবে, জগতে সেই বুঝি সবার থেকে ভিন্ন। কিন্তু ইউনিভার্সিটির, সম্ভবত, সেকেণ্ড ইয়ারে আমার ওই আলাদাত্বের ভ্রমটা ভেঙে যায়। তখনই প্রথম আবিষ্কার করি, আমি একা আলাদা নই। আমরা সবাই সবার থেকে আলাদা। তাই, আদতে আমরা সকলে কিছুটা সকলের মতন। তাই, আমরা যতই আলাদা হই না কেন, জীবন ছাঁচে বাঁধা।
আমি যে আলাদা নই, অতি সাধারণ ‘গৎ’-এরই এক নিষ্প্রভ অংশ সেটি প্রথম উপলব্ধি করার পর অদ্ভুত বিষাদ ভর করেছিল। ভিটাহারা মানুষের যেমন লাগে, আমারও তেমন লাগতো প্রথম দিকে। পরে ক্রমে সয়ে এসেছে। নিজের সাধারনত্বকে চিনতে চিনতেই কি ‘অকারণ পুলক’-এর আলো নিভে আসে?
নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা নয়। নিজেকে নিজের মুখোমুখি বসিয়ে দিলে যে বিষাদ উৎপন্ন হয় তার স্বাক্ষী আলভী ও ভীষ্ম। তার স্বাক্ষী জিবরানের কবিতা। ‘To be wounded by your own under-standing [...] And to bleed willingly and joyfully’.
তাই, চল্লিশের দিকে এগুতে-এগুতে পৃথিবীর কৃতবীরদের কথা মনে আসে। তাদের প্রণতি জানাই। কৃতবীরের বীজ আলাদা। আমার ভেতরে কবি বা বিপ্লবী নয়, ভীরু এক কেরাণীর বাস; বাস করে এক গড়পড়তা মানুষ; বাস করে এক অর্ন্তমুখী। এনি হল-এর পরিণত আলভীর মতন সেই অর্ন্তমুখীও সার্চিং ফর দি ট্রুথ অফ রিলেশানশিপ। আকাশে যার ঈশ্বর নেই মানুষ ছাড়া সে আর কোন ভজনালয়ে যাবে? আসমানে ও ধরাতলে নাই যার স্বর্গ-নরক, ভালোবাসা ছাড়া তার কিসের বাসনা?
এনি হল-এ আলভী অনুসন্ধান করেছিল ভালোবাসার প্রকৃত চরিত্র। নীল চোখের ব্যথিত ডায়না জীবনে খুঁজেছিল ভালোবাসা। সম্পর্কের উষ্ণতা প্রশ্নে সে-ও হয়তো ভাবতো ‘অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়’।
কেউ কেউ কবি, সকলেই নয়-এর মতন কেউ কেউ অসাধারণ, সকলেই নয়। এটা বুঝে গেলেই কি বিলো-এভারেজরা অসাধারণ হবার চর্চায় ইতি টানে? নাকি সকল দিয়ে সর্বনাশের আশায় বসে থাকার পর শুরু হয় প্রকৃত ভ্রমণ?
‘ইউনিভার্স ইজ এক্সপান্ডিং’। মহাবিশ্ব সম্প্রসারমান। এ জীবন জুতোয় গজানো শ্যাওলা। শূন্য থেকে ক্ষণকালের জন্ম লয়ে শূন্যে মিলায়।
এই ব্র্যাকেটবন্দী সময়টা রোদন বা প্রতিযোগিতা নয়, শিশুর মতন অকারণ পুলকে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারাই কি তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ? মেস্কালিনে এই উজ্জ্বলতা মিলবে না। উজ্জ্বলতার জাদুর কাঠির নাম ভালোবাসা। মনমহাজন রুমি বলেছেন, ‘দি কিজ দ্যাট ওপেন অল গেটস আর স্ট্র্যাপ্ড টু লাভ’স চেস্ট’।
শুক্রাণুর আগের শূন্যতা থেকে দেহান্তরিত হওয়ার অনন্ত শূন্যতা পর্যন্ত অদৃশ্য সুতোয় আমাদের বেঁধে রাখে প্রেম। ভালোবাসার মধ্যেই আছে আনন্দ, রং ও অসাধারণের ইশারা। রুমির ভাষায় ‘লাভ ইজ দি ওয়ে’। কেননা ‘লাভ ইজ দি মাদার’। ভালোবাসা আমাদের মা। আমরা তার সন্তান। ‘উই আর হার চিলড্রেন। শি শাইন্স ইনসাইড আস, ভিজিবল-ইনভিজিবল, এজ উই ট্রাস্ট অর লুজ ট্রাস্ট, অর ফিল ইট স্টার্ট টু গ্রো এগেইন’।
কিন্তু হাউ টু স্টার্ট টু গ্রো এগেইন? কিভাবে? কেমন করে? এসব মনে ঘোরপাক খায়। আমাদের গৃহকর্মে সহায়তার কেউ নেই। নিজেদের কাজ নিজেরা করি। থালা-বাসন মাজতে-মাজতে, হারপিক ছড়িয়ে কোণায়-কোণায় ঘষে কমোড পরিষ্কার করতে-করতে নিজের অন্দর মহলের কথা ভাবি। কোন হারপিকে ঘুচবে আমার সকল মলিনতা!
কায়দা করে নিজেরে আর কোনোদিন একইঞ্চিও বড় যেনো না দেখাই, মনমহাজন! মেকী বড়ত্বের ভড়ং থেকে মুক্ত করো হে মনমহাজন! পাদপ্রদীপের আলোয় যেতে এই বাড়াবাড়ি কাড়াকাড়ির ময়দান থেকে আমারে লুকাও, হে মালিক! ব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত শূন্যতার মতন অস্তিত্বের যে অর্থহীনতা তাকে মহার্ঘ মেনে বরণের দাও শক্তি! মহামারীর বছর জুড়ে ঘুরে ফিরে বারবার, বারবার এই আমার প্রার্থনা! এইসব কথা বা ভ্রম বা প্রলাপ লিখতে চেয়ে শিবের গীত গাইতে লেগেছি! হায় জীবন! তুমি কি ধান ভানা নাকি শিবের গীত! কোনোদিন জানিও উত্তর।
----
২৯ ডিসেম্বর ২০২০