ঘড়ির ছোট কাটাটা দশে অংকে আর বড় কাটাটা সাতে অবস্থান করছে।রাত খুব বেশি না। অন্যান্য দিন এই সময়েই কবির সাহেব ঘুমের অতল ডোবায় কাদা মাখামাখি হয়ে থাকেন।তবে আজকে একটু ব্যতিক্রম। মেঝ মেয়ে কুমুকে ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছিলো আজ বিকালে।এই নিয়ে তিন পক্ষ মেয়েটাকে দেখে গেলো।আগের দুই পক্ষ গায়ের রংয়ের অজুহাত দেখিয়ে সটকে পরেছে।এবার যাতে ঐ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য সকালেই ছেলে ছোটটাকে ১ হাজার টাকা দিয়ে কুমুকে নিয়ে পার্লারে পাঠিয়েছেন।মানুষ মনের রং থেকে গায়ের রং -এ বেশি নজর দেয়।কঠিন দুনিয়ার আজব মানুষের অদ্ভুত মানসিকতা। টানাটানির সংসারে যথেস্ট হিসাব করেই পার্লারের বিল পাস করেছেন।আগে নিয়ম করে তিনবেলা সিগারেট ফুকঁতেন।এখন সেটা দুই বেলায় এসে দাড়িঁয়েছে।বেলার শেষ সিগারেট সবে ধরিয়েছেন। তিন মেয়ে এক ছেলে নিয়ে অসাধারন অভাবী সংসার।তার উপর বোনের একটা ছেলে গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো ঝুলে আছে।
-বাবা তোমার কি শরীর খারাপ?? একা বারান্দায় কি করছো?" ছোট মেয়ে ঝুমুর কথায় কবির সাহেবের ঝিমুনি কেটে গেলো।
-না রে মা,শরীর ভালোই আছে।"মাথা একটু কেমন যেনো করছে" অত্যন্ত সুক্ষ্ম ভাবে মিথ্যা বলার চেস্টা করলেন ছোটখাটো মুদি দোকানী কবির হাসান।
-মাথা টিপে দেবো? গলায় ব্যাকুলতা ছিলো ঝুমুর।
-থাক না।তুই বরং তোর মাকে গিয়ে সাহায্য কর।একা মানুষ, কয় দিক দেখবে?!!?
-আচ্ছা বাবা।কিন্তু তোমার মাথা ধরেনি মনটা খুব খারাপ।"বলেই গটগট করে চলে গেলো।
এই মেয়ের কাছ থেকে কিছুই লুকাতে পারেন না কবির।হয়তো মেয়েটা বড্ড ভালোবাসে তার বাবাকে।
কবির খুবই কল্পনা বিলাসী মানুষ।বাস্তবতা থেকে দূরে কল্পনাবিলাসীরা খুবই দুঃখী হোন ব্যাক্তি জীবনে।কবির সাহেব তাদেরই একজন।
-বাবা একটা কথা বলি?" কুমুর কথায় দ্বিতীয় বারের মতো ঝিমুনী চ্যুত হলেন
- বল মা"
-তুমি কি আমার উপর রাগ করে আছো?
-আজব কথাতো!!তুই এমন কি করলি যে রাগ করবো??!!
-এই যে তিনবার তোমার এতগুলা টাকা নস্ট করলাম।
-"তিন বার নয় দুবার।" ভুলটা শোধরাতে পেরে গর্ববোধ হলো কবিরের।
-বাবা!!
-কি বল মা??
-"আজ বিকেলে যারা এসেছিলো, ওরা ফোন দিয়েছিলো" বলেই ডুকরে কেঁদে দৌড়ে পালিয়ে গেলো কুমু।
সবকিছু বিশুদ্ধ জলের মতো পরিস্কার।তৃতীয় বারের মতো মেয়েটি লজ্জিত হলো।এর থেকে বোধহয় নিম পাতার স্বাদটা ভদ্র।তেতো অনুভূতি নিজের ভেতরেই থাকে... আশপাশের কেউ টের পায় না।কিন্তু এই লজ্জার তেতোটা নিজের মধ্যেই সীমায়িত থাকে না,ছড়িয়ে যায় পরিবারে, রটিয়ে যায় প্রতিটি চেনা মুখে।বিধাতার কাছে এমন কি অন্যায় করেছে মেয়েটা,যার প্রতিদান প্রতি পদক্ষেপে দিতে হচ্ছে!!।সত্যি সত্যি মাথাটা কেমন যেনো করছে কবির সাহেবের।গুম ধরে বসে থাকলেন বারান্দায়....যেনো মিশে যেতে চাইছেন রাতের নিরবতায়।তিন মেয়েকে কখনও বোঝা হিসেবে দেখেন নি তিনি।জানতেন একটা ফুলের বাগানের মালি তিনি.... যে বাগানে তিনটি মাত্র ফুল আছে।
-বাবা!!একবার আসবে??" কান্না জড়িত গলায় ছেলের তাগাদা শুনলেন কবির।
-কেনো? কি হলো?? বেশ বিরক্তি ঝরলো কবির সাহেবের গলায়।
-কুমুদী..........ছেলে কথা শেষ করতে পারলো না।তার আগেই কান্নায় ভেংগে পরলো।
যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন কবির হাসান।কিছু না বলে খুব শান্ত ভাবে নিয়মের বাহিরে আরেকটা সিগারেট ধরালেন।খুব আস্তে আস্তে ধোঁয়া বের করছেন...যেনো ভেতরের সব কস্ট -গ্লানি ধোঁয়ার সাথে নির্গত করছেন।
ও হ্যা কবির হাসানের সযত্নে গড়ে তোলা বাগান থেকে একটি ফুল এইমাত্র ঝরে পরেছে।হ্যা এইমাত্রই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩৭