সাংবাদিক দম্পতির নৃশংস হত্যা দেখে স্থির হয়ে থাকতে পারছি না। এইসব লেখালেখি করে কি হয় জানি না। হয়ত কিছু না করে বসে থাকার চেয়ে ভালো। তাই আবারও লিখতে বসলাম।
এ পর্যন্ত যা যা লিখেছি, তা ছিল মোটামুটি ব্যক্তিগত পর্যায়ের কারণগুলি। আজকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি কারণগুলি লেখার চেষ্টা করব।
আগে নিচের ভিডিওটা দেখা যাকঃ
হার্ভার্ডের সাইকাইয়াট্রিস্ট ডঃ জেমস গিলিগান-এর এই বক্তৃতাটি আমি বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছি এখানে (ভিডিও স্ট্রিমিং-এর ঝামেলা এড়াতে)ঃ
"ভায়লেন্স বা হিংস্রতার প্রধান প্রধান কারণ (সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণগুলি) বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে সেই কারণগুলি, যা জনসংখ্যাকে ভাগ করে নিচুশ্রেণীর এবং উঁচুশ্রেণীর ভিতরে, শক্তিমান ও শক্তিহীন, দরিদ্র ও ধনীর ভিতরে। কোনও সমাজ যতটা বেশী অসামঞ্জস্যপূর্ণ (unequal), সে সমাজে হিংস্রতা তত বেশী। "The more unequal a society is, the higher the rate of violence."
উদাহরণ হিসাবে বলে যায়, খুন বা হত্যার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাবক হিসাবে দেখা যায় (এটা অনেক গবেষণায়ই প্রমাণ হয়েছে) কোনও সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে কতটা প্রভেদ (gap) আছে সেটা। সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে যত বেশী পার্থক্য (অর্থনৈতিক ও অন্যান্য পার্থক্য), সে সমাজে খুনের হার (murder rate) তত বেশী। অর্থাৎ সমাজে যত ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য কম, সে সমাজে খুনের হার তত কম।
যেমন আজকের বিশ্বে যেসব দেশে খুনের হার সবচেয়ে কম তা হল, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি। অবাক হওয়ার কিছু নেই, এসব দেশে অর্থনৈতিক সামঞ্জস্য (equality)-ও অন্যান্য দেশের থেকে অনেকগুন বেশী।
আবার উন্নত দেশগুলির ভিতরে আমেরিকায় হত্যার হার অন্যান্য উন্নত দেশগুলির তুলনায় ৫ থেকে ১০ গুন বেশী। একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, এখানে অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যও অন্য উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশী।
তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলির দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে জনসংখ্যা দুইভাগে বিভক্ত। অল্প কিছু মানুষ যারা সমাজের অতি উঁচুতলার, তাদের হাতেই দেশের প্রায় সকল অর্থ-সম্পদ। আর বাকি বিশাল জনগোষ্ঠীর হাতে প্রায় কিছুই নেই (উদাহরণ কি প্রয়োজন আছে?)। তাদের মধ্যে আমেরিকার চেয়ে অনেকগুনে বেশী সহিংসতা রয়েছে। বলে রাখা দরকার, এখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক সংঘর্ষ ইত্যাদিও অন্তর্ভুক্ত, শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত সহিংসতা নয়।
সমাজের বিভিন্ন স্তর বা লেভেলগুলির ভিতরে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভেদ কমিয়ে আনা একারণে অত্যাবশ্যক।" (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
নিচের ছবিটি জাতিসংঘের সাইট থেকে প্রাপ্তঃ
একইসাথে নিচের ছবিটায়ও এর সত্যতা পাবেনঃ
রিচার্ড উইলকিনসন (Richard Wilkinson) একজন ব্রিটিশ গবেষক। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহ্যাম-এর প্রফেসর ছিলেন এবং আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তিনি গবেষণা করেছেন আজীবন সহিংসতার সামাজিক কারণসমূহ নিয়ে। তাঁর ভিডিওটি দেখুন এখানেঃ
আরেকটি ইন্টারভিউ পাবেন এখানেঃ
দুটো ভিডিওতেই তিনি প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। আমি সংক্ষেপে কিছুটা অনুবাদ করছি এখানেঃ
" আমরা সবাই কমবেশি অনুমান করতে পারি, সমাজে বৈষম্য অনেক ধরনের সামাজিক ও ব্যাক্তিগত সমস্যার তৈরি করে। আমি আপনাদের এখানে কিছু পরিসংখ্যান দেখাব যাতে এই ধারণা আরও পরিষ্কার হবে।
মানুষের গড় আয়ুর ক্ষেত্রে একই দেশে বিশাল পার্থক্য দেখা যায় অর্থনৈতিক পার্থক্যের ভিত্তিতেঃ
যেখানে দেখা যাচ্ছে, ইংল্যান্ডের নিম্ন আয়ের মানুষদের গড় আয়ু বেশ কম উচ্চ আয়ের মানুষদের থেকে।
উপরের ছবিতে আমরা দেখলাম, বিভিন্ন দেশে উঁচুতলার ২০% মানুষ কতগুন বেশী ধনী নিচুতলার ২০% এর চেয়ে। এখন দেখা যাক তার প্রভাবটা কি পড়ে সমাজে।
উপরের গ্রাফে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, বৈষম্যপূর্ণ দেশগুলিতে সামাজিক ও শারীরিক সমস্যা অনেকগুনে বেশী। এই সমস্যাগুলো হচ্ছেঃ
- Life Expectancy
- Math & Literacy
- Infant Mortality (শিশু মৃত্যু)
- Homicides (হত্যা)
- Imprisonment
- Trust
- Teenage Birth
- Mental Illness (যাতে ড্রাগ, অ্যালকোহল, বিষণ্ণতা ইত্যাদি যুক্ত)
ইত্যাদি।"
এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই একই রকম গ্রাফ দেখা যায় আলাদা আলাদাভাবে। তবে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় আমি একটি গ্রাফের বেশী দিলাম না এখানে।
কিন্তু তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, বৈষম্যপূর্ণ দেশগুলিতে কিভাবে এই ধরনের সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়?
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো-বায়োলজির অধ্যাপক রবার্ট সাপলস্কি বলেন, "আমাদের সমাজ দ্বারাই আমরা রুপায়িত। অনেকটা মোটা দাগে চিন্তা করলে কোনও সমাজকে বলা যায় ব্যাক্তিস্বতন্ত্র, আবার কোনও কোনও সমাজকে বলা যায় একত্রিত বা জোটবদ্ধ। তাই ভিন্ন ভিন্ন সমাজে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারা দেখা যায়, মতাদর্শ দেখা যায় এবং আমার মনে হয় ভিন্ন ভিন্ন মস্তিষ্কের ধরণও দেখা যায়।
সংজ্ঞা অনুসারেই, এক সমাজে সামাজিক বিভেদ যত বেশী, সে সমাজে আরও কমসংখ্যক মানুষ থাকে যার সাথে আপনি সুস্থ, হৃদ্যতাপূর্ণ এবং সুষম সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবেন। তাই যেই সমাজে সামাজিক বিভেদ যত বেশী, সে সমাজে উদারতা, মায়া-মমতা এবং পারস্পরিক সহমর্মিতা তত কম, সামাজিক অস্থিরতা তত বেশী।"
আগের দুটি ব্লগের সাথে মিল রেখে এখানে সংক্ষেপে বলা যায় ডঃ গাবোর ম্যাটের বক্তব্যঃ
"আমাদের সমাজে মিথ বা ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, মানুষ জন্মগতভাবেই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী, যে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সহিংস হয়ে পড়ে, অপরাধ করাই মানুষের প্রকৃতি। তাই যদি হতো, তাহলে সব সমাজেই সমান হারে অপরাধ, সহিংসতা ঘটত। সোশ্যাল, বায়োলজিক্যাল এবং সাইকোলজিক্যাল প্রত্যেকটি জিনিস বিচার করলে স্পষ্টতই দেখা যায়, প্রতিটা মানুষেরই কিছু নির্দিষ্ট চাহিদা আছে জীবনের প্রতিটা ধাপেই। এই ধরনের চাহিদাগুলি যদি পরিপূর্ণ হয়, তাহলে এক ধরনের আচরণ গড়ে ওঠে, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের আচরণ দেখা যায় যদি তা মানুষ না পায়।
এই চাহিদা পূরণ হলেই দেখা যায়, এক সমাজে মানুষ গড়ে ওঠে পারস্পরিক সহমর্মিতার, সহযোগিতার ভিত্তিতে এবং সেই সমাজে অন্যের প্রতি সহানুভূতিও থাকে অনেকগুন বেশী। স্বাভাবিকভাবেই, উল্টোটা দেখা যায় বৈষম্যপূর্ণ সমাজে।"
উইলকিনসনের মতে, সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে, কিছু মানুষ চিকিৎসা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী হয়ে থাকে, সুষমভাবে বেড়ে ওঠার কোনও সুযোগ থাকে না এসব মানুষের। এ ধরনের সমাজে তাই খুন, হত্যা, ধর্ষণ, সহিংসতা, অপরাধ, দুর্নীতি অনেক গুনে বেশী হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
যেমন দুর্নীতির ক্ষেত্রে নিচের ছবিটি দেখুনঃ
ধর্ষণের পরিসংখ্যানও দেখতে পাবেন এখানেঃ
সুতরাং, এত এত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে খুব সহজেই বোঝা যায় আমাদের করনীয় কি। তবে সেটা নিয়ে বিস্তারিত পরের পর্বে।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
*** আমার পুরানো কিছু ব্লগঃ
আত্মহত্যাঃ কিছু মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ ও স্পেশালিষ্টদের মতামত
দাম্পত্য কলহ এবং সন্তানের ওপর প্রভাব
ধর্ষণঃ কি, কেন, কিভাবে -২