এই লেখাটি সারা বিশ্বে দলাদলি, বিভেদ ও বৈষম্যর কারন ও পদ্ধতি বিষয়ে একজন অ-বিশেষজ্ঞের চিন্তার প্রতিফলন। অগুনতি কাটা, ছেঁড়া আর আচড়ে ক্ষতবিক্ষত ও বিভাজিত এই বিশ্ব-সমাজ আমাদের নিজেদেরই তৈরি। চারিদিকে যুদ্ধ, আক্রমন, বোমাবাজি আর জাতিবিদ্বেষ দেখলে - বৈচিত্র্য নিয়ে আধুনিক বুলিগুলোকে খুবই হাস্যকর লাগে। যেন শুধু বলার জন্য বলা। জাতিবিভেদের কারন বারবার অনুসন্ধান না করলে আমরা সত্যিকারের সহনশীলতা আর বৈচিত্র্যর খোঁজ কোনদিনই পাবো না।
ইংরেজিতে মূল লেখাটি প্রকাশিত হয় 'Alochonaa' ব্লগে।
১। অন্যভীতি: আমার থেকে অন্য
জাতি, গাত্রবর্ণ, জাতীয়তা, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি ভেদে "অন্য" (other) কে সন্দেহ, ভীতি আর ঘৃণার করাটা মানুষের মৌলিক চরিত্রের অংশ। প্রাচীন মানুষ যখন দলে দলে শিকার করে বেরাতো, তখনও সম্ভবতঃ আরেকটি দলের সামনে পরে গেলে তাদের মনে ভয়ভীতি, আশংকা, ঘৃণা ইত্যাদি জন্ম নিতো। আসলে আমরা এমনই: আমাদের থেকে আলাদা, দেখতে আলাদা, কথায় আলাদা, ভাষায় আলাদা, বিশ্বাসে আলাদা - এমন কাউকে দেখলেই আমরা তাকে 'অন্য' হিসেবে ভাবতে শুরু করে দিই। আজকের উত্তরাধুনিক যুগেও কিন্তু এমন বহু গোষ্ঠী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে: বিদেশী, নাস্তিক, সমকামী, বিষমকামী থেকে শুরু করে আদিবাসী, অভিবাসী, হিজরা, বামন পর্যন্ত বহু এমন গোষ্ঠী কোন কারন ছাড়াই ভয়, ঘৃণা, সন্দেহের পাত্রে পরিনত হয়। এই অকারন ভয়ভীতি বা সন্দেহের কিন্তু একটি নাম আছে:
Xenophobia (জেনোফোবিয়া)
অর্থাৎ, আগন্তুক বা বিদেশীদের প্রতি অযৌক্তিক ভীতি বা ঘৃণা।
খুঁজলে দেখা যায়, এমন ভীতির মূলে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের অভিজ্ঞতায়। মানুষ তখনই দলে দলে বাস করা শুরু করেছিলো যখন তারা বুঝতে পারে যে এতে করে তাদের লাভ হবে। খাদ্য সংগ্রহ, বন্য প্রাণী শিকার করা থেকে শুরু করে সঙ্গী নির্বাচনে নিজেদের মধ্যে একধরনের বোঝাবুঝির কারনেই আদিম সমাজের প্রস্তরলিপি স্থাপিত হয়। তাই কেউ অন্য একদলের মুখোমুখি হয়েছে, তখনই তার নিজের দলের নিয়মগুলো আর খাটতো না। তখন তার লাভ থেকে লোকসান হওয়ার আশংকাই বেশি প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
তবে এটা এখানেই বলে নেয়া ভালো যে, সাধারনভাবে এমনটাই মনে হয় যে জেনোফোবিয়া খুব মারাত্মক কোন ব্যাপার নয়। এটি সবার মাঝেই অল্পবিস্তর বিদ্যমান। তবে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে এটা বাড়তে বা কমতে পারে। শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, শিল্প, ভ্রমনের মত বিষয়ে মনের এই বৈষম্যগুলো অনেকাংশে কমে আসতে পারে।
তাহলে এটা বলা যায় যে, প্রতিটি মানুষের মাঝেই 'অন্য' সম্পর্কে একধরনের সচেতনতা থাকে। আর যখনই আমরা অন্যরকম কাউকে দেখি, তখন আমাদের প্রথম কাজ হয় নিজের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দেখা: তারা কি আমার/আমাদের থেকে খাটো? তাদের গায়ের রং কি ফর্সা? তারা কি বেশি জোরে কথা বলে? তারা কি আমাদের মতই স্বপ্ন দেখে আর গান ভালোবাসে? তারা কি আমাদের নিয়মনীতি মেনে চলে? তারা কি আমাদের খোদাকে বিশ্বাস করে?
১৯৭০ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় আমরা ছোট ছোট বিষয়ে - যেমন কারো শার্টের রঙে - প্রভাবিত হই এবং তাকে হয় নিজের বা প্রতিপক্ষ দলের মনে করতে শুরু করি। ইউরোপিয়দের উপর করা আরেকটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, নিজ জাতির তুলনায় তাদেরকে কালো চামড়া / আফ্রিকানদের ছবি দেখলে তাদের মস্তিস্কের অ্যামিগডালায় (ভয়ভীতির কেন্দ্রস্থল) বেশি উত্তেজিত হচ্ছে। জাতি, গোত্র এবং ধর্মীয় পার্থক্যে এই দলাদলি ও ভীতির পরিমান সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
এসবকিছুর ফলে মানুষ যেটা স্বত:স্ফূর্তভাবে করতে শেখে তা হলো: স্টিরিওটাইপিং (stereotyping)। তার মানে, অন্যের যেকোন একটি বৈশিষ্ট্যর (যেমন, গায়ের রং বা ভাষা) উপর ভিত্তি করে তার সম্পর্কে কিছু গতবাধা ধারনা করে ফেলা। (বিশেষতঃ পশ্চিমা) এসব গতবাধা ধারনা অনেক কিছুর উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়, যেমন: চুলের রং (সোনালী চুলের মেয়েরা বোকা হয়), পেশা (উকিলরা ধূর্ত হয়), আর্থসামাজিক অবস্থা (গরীব মানুষ আসলে অলস) ইত্যাদি। যদিও 'অন্য'কে বুঝতে এমন মোটা দাগের ধারনার দরকার আছে, সাধারনত এগুলো ভুলভ্রান্তির ভিত্তিতে তৈরি বলে আসলে বৈষম্যের সূত্রপাত করে। আর এখানেই শুরু হয় 'জাত্মাভিমান': নিজের জাতি অন্য সবার থেকে সেরা, এমন বদ্ধমূল ধারনা।
২। অন্যকরন: সৎমায়ের ভূমিকায় শাসকগোষ্ঠী
যুগ যুগ ধরে মানবসমাজ নিজেকে বুঝতে, ব্যাখ্যা করতে 'অন্য'কে দেখে আসছে। যদিও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী জাত্মাভিমানে দুষ্ট, অন্যভীতিতে পরিপূর্ণ, তাও অন্যর রং, আচার, ব্যবহার, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও আচরন দেখেই আমরা নিজেদেরকে চিনতে শিখেছি। (যেমন, মুসলিম বিশ্বে অনেকেরই একটি বদ্ধমূল ধারনা হলো যে তারা পশ্চিমাদের থেকে বেশি ধর্মপরায়ণ। পশ্চিমে বসবাসকারী অনেকেরই ধারনা তারা পূবের মানুষদের থেকে বেশি বিজ্ঞানমনস্ক)। এ ধারনাগুলো যতই পক্ষপাতদুষ্ট হোক না কেন, দিন শেষে এগুলোই একটি সমাজের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর অবতারনা করে।
যতই যতই মানুষের দল বড় হয়ে গোত্র, আর গোত্র বড় হয়ে জাতিতে রূপান্তরিত হতে লাগলো, ততই এমন 'অন্য' কে খুঁজে পাওয়া জরুরি হয়ে উঠতে লাগলো। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীরত্বগাঁথা আর পরিচয় পাকাপোক্ত করতে প্রয়োজন হয়ে পরলো এমন সব 'অন্য'দের, যারা তাদের থেকে আলাদা। সত্যি কথা বলতে, জাতিগোষ্ঠীর নেতাগণ সবসময়ই 'অন্য'-এর এই ধারনার উপর ভর করেছে। শুধু তাই না, তারা প্রায় সময়ই এমন 'অন্য'দেরকে তৈরিও করেছে। প্রাচীন রোমে, বাইরের সকলকে 'অসভ্য' (barbarian) অ্যাখ্যা দেয়া হতো। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা স্থানীয়দেরকে 'নেটিভ' ডাকলেও, তাতে মেশানো ছিলো একধরনের অপমান। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রিটিশরা ডাকতো 'সন্ত্রাসী' বলে।
এটাকেই আমরা 'অন্যকরন' (otherization / othering) বলবো। এটি করার সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে যে এতে করে একদলকে যে দমিয়ে রাখা যায় শুধু তাই না, বরং মূল দল (অর্থাৎ শাসক নিজে যেই দলের অন্তর্ভুক্ত) কে আরো সুসংহত করাও সম্ভব। আরেকটি গোষ্ঠীর তুলনায় "আমরা বেশি সভ্য, বেশি ধার্মিক, বেশি সহনশীল, বেশি শিক্ষিত, বেশি ঐতিহ্যবাহী" - এমন হাজারো পার্থক্য তৈরি করে নিজ গোষ্ঠীকে চাঙ্গা রাখার কৌশল সমাজে নতুন নয়। আমেরিকার ব্ল্যাক কোড (১৮৬৫), জার্মানীর নুরেমবার্গ ল (১৯৩৫), দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য নীতি (১৯৪৮), রাশিয়ার সমকামী বিরোধী নীতি (২০০৫) - এ সবই অন্যকরনের পদ্ধতি।
স্বাভাবিকভাবেই, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের বিরূদ্ধেই অন্যকরন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ দাসপ্রথা সমর্থক শাসকগোষ্ঠী বলতো কৃতদাসদের কোন 'আত্মা নেই'। হিটলারের জার্মানীতে "রক্তের বিশুদ্ধতা" বিচারে অন্যকরন করা হয়েছিলো ইহুদিদেরকে। রওয়ান্ডাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ 'হুটু' উপজাতি দাবি করেছিল (বিপক্ষ) 'টুটসী' উপজাতীয়দের কোন ধরনের 'মানবীয় গুনাবলী' নেই। পাঠক, খেয়াল করুন যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভেদের কারনগুলো কিন্তু অত্যাচারীদের মহিমান্বিত করতে সাহায্য করেছে। এটাই অন্যকরন।
আমার মতে, অন্যকরন করা হয় চারটি আলাদা ধাপে। এগুলো হলো:
১। বৈষম্য তৈরি করা (discrimination)
২। পিশাচীকরন (demonizaton)
৩। অমানবিক (মানুষের থেকে কম) প্রতিপন্ন করা (dehumanization)
৪। প্রভুত্ব স্থাপন (domination)
যেখানেই আমরা অন্যকরন দেখবো, তাতে এইধাপগুলো দেখা যাবে বলে আমার ধারনা। হয়তো কখনো একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে যাবে, বা একটি খুব সংক্ষিপ্ত হবে। তবে, ছোট নৃগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য স্থাপনে এই প্রক্রিয়াটির ব্যবহার অব্যাহত থাকবে বলেই আমার ধারনা।
(পর্ব-২ আসছে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১৫ ভোর ৬:১৮