[আরজ আলী মাতুব্বরের লেখা পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়া মুসলিমের সংখ্যা কম নয়। এই সিরিজে আমি তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিব। আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্নকারী মনকে আমি শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তার ইসলামী জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে অনুধাবন করতে পেরে তার প্রতি আমার করুনাও হয়। ]
আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র প্রথম খন্ড সত্যের সন্ধান (দ্বিতীয় প্রস্তাব – ঈশ্বর বিষয়ক) এর প্রশ্নের উত্তর।
প্রশ্ন ১: সর্বব্যাপী আল্লাহতা’আলার স্থায়ী আসনে (আরশে) অবস্থান কিরূপ (অর্থাৎ আল্লাহ্ সর্বব্যাপী হলে তিনি আবার আরশে থাকেন কিভাবে)? বিশ্বজগতের পরিচালনার জন্য ফিরিশতার সাহায্যের আবশ্যক কি?
উত্তরঃ প্রশ্নের প্রথম অংশে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ সর্বব্যাপী নন। কোরআন বা হাদিসের কোথাও এই তথ্য নাই। স্রষ্টার সর্বব্যাপীতা হিন্দু ধর্মের কনসেপ্ট, ইসলাম ধর্মের না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ্র জ্ঞান সর্বব্যাপী, ঠিক যেমন সূর্য আমাদের থেকে অনেক দূরে অবস্থিত কিন্তু সূর্যের আলো ঠিকই আমাদের কাছে পৌঁছায়। আল্লাহ্, তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের গ্রীবাস্থিত ধমনীর চেয়েও কাছে আছেন (আল-কোরআন ৫০:১৬)।
আমরা মানুষরা যে মহাবিশ্বের সাথে পরিচিত সেটা হলো প্রথম আকাশ, এরকম সাতটি আকাশ আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন। এই সাত আকাশকে ঘিরে আছে আল্লাহ্র কুরসী, আর সেই কুরসীকে ঘিরে আছে আল্লাহ্র আরশ, যা কিনা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সর্ববৃহৎ সৃষ্টি। এই আরশেই সমাসীন আছেন মহান আল্লাহ্। আরশে তিনি কিভাবে আছেন তা আমাদের চিন্তাশক্তির বাইরে, তাই আল্লাহ এই ব্যাপারে কিছু বলেন নাই। আল্লাহ্ আমাদের কাছে ততটুকুই তথ্য দিয়েছেন যতটুকু আমরা বুঝতে পারব এবং যতটুকু জানা আমাদের প্রয়োজন। কাজেই, আরশে তাঁর অবস্থান কিরূপ তা অবান্তর প্রশ্ন (ব্যাপারটা অনেকটা যে ছেলে ক খ গ শুধু পড়তে পারে, সে জানতে চাচ্ছে মার্কভ চেইন কিভাবে কাজ করে)।
প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশেও প্রশ্নের মধ্যেই ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ্র সর্বশক্তিমান, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী (আল-কোরআন ৩৫:১), তাঁর সাহায্য সবার প্রয়োজন, আল্লাহ্র প্রয়োজন নাই কারোই সাহায্যের (আল-কোরআন ১১২:২)। কাজেই বিশ্বজগত পরিচালনার জন্য ফিরিশতার কোন সাহায্য আল্লাহ্র প্রয়োজন নাই। আল্লাহ্ ফিরিশতাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। আল্লাহ্র হুকুম তামিল করা ফিরিশতাদের জন্য ইবাদত। প্রতিটা ফিরিশতার জন্য আল্লাহ্ কাজ নির্দিষ্ট করেছেন। যেমনঃ জিব্রাইল(আ) এর কাজ ছিল রাসূলদের কাছে আল্লাহ্র বানী নিয়ে আসা। এখন আল্লাহ্ জিব্রাইল(আ) কে যদি সৃষ্টি না করতেন, তা হলে চাইলে তিনি অন্য উপায়ে (যেমন স্বপ্নের মাধ্যমে) রাসূলদের কাছে তাঁর বানী পৌঁছাতে পারতেন। কিন্তু, আল্লাহ্ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জিব্রাইল(আ) এর মাধ্যমে তাঁর বাণী পাঠাবেন, কারণ এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। আল্লাহর একটি নাম হলো আল-খালেক, কাজেই তিনি সবচাইতে সুন্দর ও সবচাইতে আশ্চর্য জনক বস্তু সৃষ্টি করবেন এটাই স্বাভাবিক। ফেরেশতা আল্লাহর অদ্ভূত সুন্দর সৃষ্টিগুলির মধ্যে একটি।
প্রশ্ন ২: খোদাতা’আলা কি মনুষ্যভাবাপন্ন? খোদাতা’আলার জগৎশাসন প্রণালী বহুলাংশে একজন সম্রাটের মত কেন এবং এত আমলা কর্মচারীর বাহুল্য কেন?
উত্তরঃ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর কিছু গুণ মানুষকে দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর গুনের সাথে মানুষের গুনের মিল শুধুই বৈশিষ্ট্যে, কোয়ালিটি বা কোয়ান্টিটিতে নয়। যেমনঃ মানুষ করুনাময় হতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্ সবচাইতে করুনাময়, মানুষ দয়ালু হতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্ সবচাইতে দয়ালু, মানুষ শাস্তিদাতা হতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্ চরম শাস্তিদাতা (আল্লাহ্র শাস্তিদাতা হওয়াও গুন, কারন তিনি শুধু অপরাধীদেরকেই শাস্তি দিয়ে থাকেন এবং সঠিক অনুপাতে শাস্তি দিয়ে থাকেন)।
আল্লাহ্র চেহারা আছে (আল-কোরআন ৭৫:২৩), যা দেখতে পাওয়া হবে জান্নাতীদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর জাহান্নামীদের সবচেয়ে বড় শাস্তি হবে আল্লাহ্কে না দেখতে পাওয়া। আল্লাহ্র চোখ (৫২:৪৮) আছে, হাত আছে (৩৯:৬৭), পা আছে (৬৮:৪২) । কিন্তু এগুলো কেমন তা আমাদের পক্ষে বুঝা সম্ভব না। কারণ, এই জগতে আমরা যা দেখি বা চিন্তা করতে পারি তার কোন কিছুর সাথেই আল্লাহ্র মিল নাই (আল কোরআন ৪২:১১)।
আল্লাহ্র জগৎশাসন প্রণালী বহুলাংশে সম্রাটের মত নয়, আল্লাহ্ সর্বাংশেই সম্রাট, সকল সৃষ্টি তাঁর দাস, আর তিনি একচ্ছত্র বাদশাহ (আল-কোরআন ৩৫:১০)। আল্লাহর “আমলা কর্মচারীর বাহুল্য আছে” কিনা তা বুঝার আগে আমাদের বুঝতে হবে আল্লাহ কে। যেহেতু, আল্লাহ কে এবং কত মহান তা বুঝার মত ক্ষমতাই আমাদের নাই সেখানে তাঁর “আমরা কর্মচারীর বাহুল্য” নিয়ে কোন মন্তব্য করা নিতান্ত বেকুবের কাজ। আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি যে কোন কিছুতেই আল্লাহ বাহুল্য করেননি, তিনি সবকিছু সঠিক অনুপাতেই সৃষ্টি করেছেন, কোন কিছুই খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেন নাই (আল-কোরআন ২১:১৬)।
আর বাহুল্যের ধারণা তখনই প্রযোজ্য যখন সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকে। যেহেতু, আল্লাহ শূন্য থেকে সব কিছু তৈরী করেন এবং সবকিছুরই বেঁচে থাকা আল্লাহর দেয়া ভরণ-পোষণের উপর নির্ভরশীল, কাজেই আল্লাহর ক্ষেত্রে বাহুল্য শব্দটি প্রযোজ্য নয়।
৩। স্রষ্টা কি সৃষ্টি হতে ভিন্ন? ধর্ম তো স্রষ্টার সর্বব্যাপীতায় সন্দেহ প্রকাশ করে না। তাহলে নোংরা পদার্থেও কি স্রষ্টা আছেন?
এই প্রশ্নটিও সম্পূর্ন ভুল কন্ডিশনের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। আরজ আলী মাতুব্বর সব ধর্মে একসাথে পড়তে যেয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলেছেন। স্রষ্টার সর্বব্যাপীতা হিন্দু ধর্মের কনসেপ্ট। আহলে সুন্নাহ ওয়া আল জামা’ (সুন্নী ইসলাম) বিশ্বাস করে আল্লাহ তাঁর আরশে সমাসীন আছেন, আর তাঁর জ্ঞান সর্বব্যাপী । আরো জানার জন্য ১ নং প্রশ্নের উত্তর পড়ুন।
(চলবে ইনশা আল্লাহ)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৫১