"মাছি মারা কেরাণী" সঙ্ক্রান্ত গল্পটা হয়তো অনেকেই জানেন। কেরাণীদের বুদ্ধির স্বল্পতা ও চিন্তার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে তামাশা করার জন্য গল্পটার উৎপত্তি। কিন্তু বাস্তবেও যে মাছি মারা কেরাণী থাকতে পারে তা নিজের অভিজ্ঞতায় ধরা না পড়লে বুঝতে পারতামনা।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানানোর আগে আসুন মাছি মারা কেরাণীর গল্পটাই আরেকবার রোমন্থন করি। কেরাণীদের কাজ হলো তাদের বসদের হুকুম পালন করা। বসরা যা করতে বলেন তা করা। এক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের বুদ্ধি নতুন করে খাটাননা। যা বলতে বলা হয়েছে তাই করেন চিন্তা ভাবনা করা ছাড়া। কোন কাজের দায়ভার নিজের কাঁধে নেয়ার মত মানসিকতা, সাহস ও ক্ষমতা কোনটাই তাদের নাই।
এরকম এক কেরাণীকে তাঁর বস একবার এক ফাইল কপি করতে দিলেন। বেচারা কেরাণী নিজের হাতে ঐ ফাইল কপি করে যাচ্ছেন। তখনকার দিনে ফটোকপি, সাইক্লোস্টাইল বা স্ক্যানিং, কম্পিঊটার কিছুই ছিলনা। তিনি ফাইলের কাগজগুলোর নকল (কপি) তৈরী করা প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। শেষ পাতায় দেখলেন একটা মাছি মরে লেগে আছে। তিনি ভাবলেন, "এটা কীভাবে কপি করা যায়?" আর আপনারা যারা চেষ্টা করেছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন মাছি মারা বা ধরা খুব সোজা কাজ নয়। কেরাণী ভদ্রলোককে ফাইল নকল করতে হবে। তাই মাছি মারা ছাড়া কোন উপায় নেই। তিনি অনেক কষ্ট করে একটা মাছি মেরে নকল ফাইলটাতে জায়গামতো সেঁটে দিলেন। সেই থাকে বাংলায় "মাছি মারা কেরাণী" কথাটার শুরূ।
কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমাকেই যে এক মাছি মারা কেরাণীর মুকাবেলা করতে হবে তা কে জানত? ১৯৯২ সালের কথা। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে নতুন কিছু শেখা। Communication Law & Ethics কোর্সটা নিলাম। শিক্ষক সাইয়েদ শওকত আলী শাহ্। ভদ্রলোক তাঁর কড়া মেজাজের জন্য গোটা ফ্যাকাল্টির ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পরিচিত। আমি কমুনিকেশন মেজর হওয়ার পরও তাঁর সাথে কোন কোর্স নেইনি কারণ সিনিয়ররা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল তাঁর মেজাজ এবং নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে কৃপণতার কথা বলে। এদিকে তিনিই writing কোর্সগুলো পড়ান। বাধ্য হয়ে ৩য় সেমিস্টারে তাঁর সাথে একসাথে তিনটা কোর্স নিতে হল। এর মধ্যে দু'টো কোর কোর্স। Reporting & Writing for Mass Media-I এবং Communication Law & Ethics। এদিকে তিনি আবার পান- থেকে চুন খসলেই ক্ষেপে যান। এসাইনমেন্ট - ২য় কোর্সটির জন্য একটা টার্ম পেপার লিখতে হবে যা অবশ্যই টাইপ করা ১০ থেকে ১২ পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
তখন আবার এত GUI কম্পিঊটার ছিলনা। ছিল DOS বেইসড পি.সি.। শেখার কষ্টে তখনো ভাল করে শেখা হয়নি। এজন্য এসাইনমেন্ট হাতে লিখে আমরা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কেরাণীদের দিয়ে টাইপ করিয়ে নিতাম। প্রতি পৃষ্ঠার (ডাবল স্পেইস, ১২ ফন্ট সাইজ) জন্য ১ রিংগিত করে পে করতাম ঐ কেরাণীদেরকে। আমার এসাইনমেন্টাও হাতে লিখে এক কেরাণীর কাছে দিয়ে এলাম টাইপ করার জন্য। হাতে লিখা এসাইনমেন্টটা ছিল ১৫ পৃষ্ঠা। স্বাভাবিকভাবে টাইপ করলে পৃষ্ঠা কমবে। কোনভাবেই ১২ পৃষ্ঠা হওয়ার কথা নয়। আমি হাতে লিখাটার শেষ পাতায় লিখে দিয়ে এসেছিলাম "Please Try to Confine the paper within 10 to 12 pages"।
নির্দিষ্ট দিনে টাইপ করা এসাইনমেন্টটা ফেরত আনতে গিয়ে দেখি সে ১৫ পৃষ্ঠাই টাইপ করেছে এবং আমার দেয়া ইন্সট্রাকশন "Please Try to Confine the paper within 10 to 12 pages" কথাটাও টাইপ করে রেখেছে।
হাসব না কাঁদব? একদিকে মিঃ সাইয়েদ শওকত আলীর ইন্সট্রাকশন, এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার ডেডলাইন আর অন্যদিকে তার মেজাজ। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তবে বাস্তবের একজন মাছি মারা কেরাণীর দেখা পাওয়া গেল বলে একটু কষ্টের হাসিও হাসা গেল।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০০৮ সকাল ১০:৪০