সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলামের নির্দেশনা
ইসলাম একমাত্র মনোনীত দীন ও জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের আদর্শ শাশ্বত ও সার্বজনীন। মুসলমান আর অমুসলমানের মধ্যে এখানে কোনো বিভাজন নেই। পরমতসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলামের ভূমিকা ও নির্দেশনা কালজয়ী আদর্শ হিসেবে বিশ্ব সভ্যতায় একটি স্বীকৃত বিষয়। ইসলামে অপরের কল্যাণ সাধন উপযোগিতা একটি জাতি ও আদর্শের টিকে থাকার মূলমন্ত্র। অস্তিত্বের এই শাশ্বত দর্শনের উল্লেখ করে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে—
وَأَمَّا مَا يَنفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الأَرْضِ
‘আর যা মানুষের জন্য কল্যাণকর যা মানুষকে উপকৃত করে তা টিকে থাকে পৃথিবীতে। (সূরা রাদ : ১৩:১৭)
অপরের কল্যাণ সাধন তথা পরমতসহিষ্ণুতার পরিধি ইসলামে কত ব্যাপক ও বিস্তৃত, এর কিঞ্চিৎ ধারণা আমরা প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর একটি বাণী থেকে পেতে পারি। তিনি বলেন—
‘দয়াশীলদের ওপর দয়া করেন দয়াময়। যারা দয়াপরবশ হয়, রাহমানুর রাহিম আল্লাহ তাআ'লা দয়া করেন তাদের প্রতি। পৃথিবীবাসীর ওপর তোমরা দয়াপরবশ হও, আকাশে যিনি আছেন তিনি তোমাদের ওপর দয়াপরবশ হবেন।’ (আবু দাউদ)
মহান আল্লাহ তাআ'লা মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ করেননি। সুতরাং, মানুষের প্রতি দয়াদ্রতার মনোভাব সৃষ্টি না হলে পরমতসহিষ্ণুতা ও সামাজিক সম্প্রীতি কখনো সম্ভব নয়। একজন মুমিনের কাছে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি বস্তুই বড় আপন এবং বড় আদরের। কারণ সে জানে ও বিশ্বাস করে—
‘সব সৃষ্ট বস্তুই হলো আল্লাহ তাআ'লার পরিবার-পরিজন।’
ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন— ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ হিসেবে। সারা বিশ্বের যেখানে যত কিছু আছে সবার জন্যই তিনি রহমত। অপরিমেয় করুণা এবং পরমতসহিষ্ণুতার আঁকর ছিলেন তিনি। ইরশাদ হয়েছে :
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ
'আমি আপনাকে সারা জাহানের (দ্যুলোক ভূলোক, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে যা কিছু আছে সবার) জন্য রহমতস্বরূপ, করুণাস্বরূপ প্রেরণ করেছি। (সুরা আম্বিয়া-২১:১০৭)
পরমতসহিষ্ণুতার এক অনন্য প্রতীক ছিলেন তিনি। যেসব অমুসলিম সদা তাকে অত্যাচার করেছে, নিপীড়ন চালিয়েছে, দন্ত মোবারক ভেঙে দিয়েছে, হাড্ডি গুঁড়া গুঁড়া করে দিয়েছে, ক্ষিপ্ত কুকুর ও পাগলদের লেলিয়ে দিয়েছে তাঁর পেছনে, স্ত্রী-সন্তানদের তুহমতের নিশানা বানিয়েছে, পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে, এমনকি সিজদারত অবস্থায় মৃত পশুর নাড়িভুঁড়ি মাথায় চাপিয়ে দিয়েছে, সেই নির্মম ও পাষণ্ডদের প্রতিও অপার সহিষ্ণুতার আদর্শ প্রদর্শন করেছেন তিনি। কোনো দিন কারও প্রতি তিনি প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন না। পরমতসহিষ্ণুতা তার মধ্যে এতটাই প্রবল ছিল যে, যারা একদিন তাকে ঘরছাড়া করেছিল, হিজরত করে যাওয়ার পরও নিরাপদ শান্তিতে থাকতে দেয়নি, আবহমানকালের রেওয়াজ থাকার পরও প্রস্তুতি নেওয়া সত্ত্বেও ‘পবিত্র কাবাঘরের তাওয়াফ দৃশ্যত অপমানজনক চুক্তির বন্ধনে ছেড়ে দিতে হয়েছিল, সেই দুরাচারীদের পবিত্র মক্কা বিজয়ের দিবসে পূর্ণ কব্জায় পেয়েও পরমতসহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন তিনি। অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী প্রত্যক্ষ করল মানবতার, ক্ষমার, উদারতার, পরমত সহিষ্ণুতার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নজির! একজন দাস পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে, বিনয়ে গ্রীবা ছুঁইয়ে দিয়ে ওয়াহদানিয়াতের জিকির করতে করতে প্রবেশ করছেন বিশ্ব নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!’ প্রিয় মাতৃভূমিতে আশ্বাসের বাণী, সহিষ্ণুতার বাণী, মুক্তির উচ্চারণ ব্যঙ্গময় হয়ে উঠল তার কণ্ঠে—
‘আজ তোমাদের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন।’
এ অনন্য ঘোষণার মাধ্যমে তিনি চিরশত্রু অমুসলিম অবিশ্বাসী ও মক্কার সব অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করে পরমতসহিষ্ণুতা এবং সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
শুধু আরব ভূমিতেই নয়, বহির্বিশ্বে ক্রমান্বয়ে যখন ইসলামের পতাকা উড্ডীন হচ্ছে তখন সব বিজিত অঞ্চলে অমুসলিম ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সদাচরণ করার এবং পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শকে কঠোরভাবে পালন করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পরমতসহিষ্ণুতা ইসলামের অন্যতম বিষয় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দরুন এক্ষেত্রে যেসব শর্ত বাস্তবায়নে ইসলাম দায়বদ্ধ মনে করে থাকে তার উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—
ক. শত্রুর হাত থেকে অমুসলিমদের রক্ষা করা হবে।
খ. অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখা হবে।।
গ. তাদের ধন-সম্পদ ও প্রাণের নিরাপত্তা দান করা হবে।
ঘ. স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তাদের হাতেই ন্যস্ত থাকবে।
ঙ. পূজা-অর্চনা থেকে পাদ্রী-পুরোহিতদের পদচ্যুত করা হবে না।
চ. তাদের ধর্মীয় প্রতীক (ক্রুশ ও মূর্তি) বিনষ্ট করা হবে না।
ছ. তাদের কাছ থেকে উশর নেওয়া হবে না।
জ. তাদের অঞ্চলে অভিযান প্রেরণ করা হবে না।
ঝ. তাদের ধর্মীয় চেতনার ওপর আঘাত করা হবে না।
ইসলামে মদিনার সনদের চেতনাই হলো, কারও উপর জোরজবরদস্তি নয়। চাপ প্রয়োগ বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা স্পষ্টভাবে নিষেধ। অমুসলিমদের প্রতি মানবিক আচরণ এবং সম্প্রীতির সম্পর্ক পৃথিবীর সব ভূখণ্ডে ইসলামের শান্তিকামিতার আদর্শকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। পরমতসহিষ্ণুতার এত বাস্তব উদাহরণ ইসলাম ব্যতিত অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদে কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে—
وَلَوْ شَاء رَبُّكَ لآمَنَ مَن فِي الأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُونُواْ مُؤْمِنِينَ
‘আপনার রব ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে সবাই ঈমান আনতো, তবে কি আপনি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষের ওপর জোরজবরদস্তি করবেন?’ (১০:৯৯)
ইসলাম ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
দ্বীন বা ধর্ম মানে মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি বা জীবনব্যবস্থা। দুনিয়ার প্রথম নবী হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সব নবীই মানবতার বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। পাশাপাশি প্রত্যেক নবীই তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নবী ও ধর্ম সম্পর্কে কিছু না কিছু বলে গেছেন। কোরআন-হাদিসের বাণী ও রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বাস্তব পদক্ষেপ থেকেই অন্য ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী, তা উজ্জ্বল সূর্যের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একজন মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হলে তাকে সর্বপ্রথম যে কালিমা শিক্ষা দেওয়া হয় তা হলো—
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’
অর্থ : ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নেই। মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত প্রতিনিধি।’
আস্থাসহকারে এ কালেমা তাইয়েবা পাঠ করলেই একজন মানুষ মুসলিম হয়ে যায়। কিন্তু তাকে পূর্ণ মুসলিম হতে হলে আরো কয়েকটি বিষয়ে পূর্ণ ঈমান আনতে হয়। পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসসহকারে তাকে বলতে হয়,
‘আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, প্রেরিত রাসুলগণ, কিয়ামত, তকদির ও মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ—এসবের ওপর আমি ঈমান আনলাম।’
ইসলামের এ প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বোঝা যায়, একজন মানুষ পূর্ণ মুসলিম হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো, তাকে পূর্ণ বিশ্বাসী হতে হবে পূর্ববর্তী নবীগণ ও ঐশী গ্রন্থগুলোর ওপর। এখান থেকেই মূলত: একজন মুসলিম ব্যক্তির পরধর্ম এবং পরমত সহিষ্ণুতার শিক্ষার গোড়াপত্তন। বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্য ধর্মের প্রতি, অন্য মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ইসলামের মৌলিক সৌন্দর্য্যগুলোর অন্যতম একটি।
শুধু থিওরি নয়, বাস্তবসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগও দেখিয়েছে ইসলাম
ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শুধু থিওরি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। সমাজ ও রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্রাকটিক্যালি রূপদান করেছে ইসলাম। মদিনায় হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তখন মদিনা ছিল পৌত্তলিক, ইহুদি, মুসলিম—এই তিন সম্প্রদায়ের লোকের একটি আবাসভূমি। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লক্ষ করলেন, এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপিত না হলে মদিনার শান্তি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাই বিশ্ব শান্তির দূত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনাবাসীকে একটি লিখিত শান্তিসনদ দান করেন। সনদে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নেতারা স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এই সনদকে বলা হয় মদিনা সনদ। মদিনা সনদই দুনিয়ার ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি।
ঐতিহাসিক মদিনা সনদের কয়েকটি নীতি হলো—
(১) মদিনার মুসলিম, পৌত্তলিক, ইহুদি—সবাই একই রাষ্ট্রের অধিবাসী। সবার নাগরিক অধিকার সমান।
(২) মুসলিম, পৌত্তলিক, ইহুদি—প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে ধর্ম পালনে বাধা দিতে পারবে না।
(৩) সনদে স্বাক্ষরদানকারী কোনো সম্প্রদায়কে বাইরের শত্রু আক্রমণ করলে সব সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করবে।
(৪) বহিঃশত্রু মদিনা আক্রমণ করলে সব সম্প্রদায়ের সমবেত শক্তি দ্বারা বহিঃশত্রুকে বাধা দিতে হবে।
(৫) কোনো সম্প্রদায়ই বাইরের কোনো শত্রুর সঙ্গে গুপ্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারবে না।
(৬) রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পূর্ব অনুমতি ছাড়া কেউ কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
(৭) ব্যক্তিগত অপরাধের জন্য ব্যক্তিকেই দায়ী করা হবে। তাঁর সম্প্রদায়কে দায়ী করা চলবে না।
(৮) সনদে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মীমাংসার ওপর সবাইকে নির্ভর করতে হবে। (ইসলামের ইতিহাস : হাসান আলী চৌধুরী, পৃ. ৭৪-৭৫)
মদিনা সনদই সাক্ষ্য দেয়, ইসলাম ধর্মে ধর্মে বিরোধ চায় না, শান্তি চায়। মদিনা সনদই সাক্ষ্য দেয়, ইসলাম বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শত্রুতা চায় না, মৈত্রী চায়। মদিনা সনদই সাক্ষ্য দেয়, ইসলাম কট্টরতা চায় না, উদারতা চায়। মদিনা সনদই সাক্ষ্য দেয়, ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার সমান। রাষ্ট্রীয় জীবনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামই দুনিয়ার বুকে সর্বপ্রথম বাস্তব আদর্শ স্থাপন করে, মদিনা সনদই তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
সংকীর্নতা পরিহার করে মুসলিমদের ইসলামের উদারতার ইতিহাস জানা প্রয়োজন
ইসলামের উদারতার উদাহরণ একমাত্র মদিনা সনদই নয়। অন্য ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ইসলামের উদারতার আরো অগণিত প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়। একবার নাজরানের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিস্বরূপ একদল খ্রিস্টান রাসুলুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মদিনায় আসে। উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপে আলাপে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সন্ধ্যা মুসলিমদের মাগরিবের নামাজের সময়।
খ্রিস্টানদেরও সান্ধ্য উপাসনার সময়। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সান্ধ্য উপাসনার জন্য খ্রিস্টানদের মসজিদে নববীতেই স্থান দেন। একই মসজিদে খ্রিস্টানরা পূর্ব দিকে মুখ করে সান্ধ্য উপাসনা করেন। আর মুসলিমরা কাবামুখী হয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। (বিশ্বনবী, পৃ. ৫০৮)
ধর্মীয় ব্যাপারে উদারতার এর চেয়ে বাস্তব উদাহরণ আর কী হতে পারে!
সামাজিক শান্তির জন্য রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নানাভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু তা কখনো ইসলামকে কাটছাঁট করে করেননি। মক্কার পৌত্তলিকরা একবার পৌত্তলিকতা ও ইসলামের মধ্যে কাটছাঁটের মাধ্যমে আপসের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন রাসুলুল্লাহর কাছে। তাদের এ প্রস্তাবের জবাব আল্লাহই ওহির মাধ্যমে জানিয়ে দেন। আল্লাহ পাক বলেন, হে নবী আপনি বলে দিন-
لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ
‘তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম। আমার জন্য আমার ধর্ম।’ (সুরা : কাফিরুন, আয়াত : ৬)
আর একবারের ঘটনা। মক্কার পৌত্তলিক কুরাইশ সর্দাররা একদিন রাসুলুল্লা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে এসে বলল,
‘হে মুহাম্মদ, তুমি যদি সুন্দরী নারী চাও, আমরা তোমাকে পরমা সুন্দরী নারী দেব। তুমি যদি সিংহাসন চাও, তা-ও আমরা তোমাকে দান করব। শুধু তুমি এ ধর্মটি প্রচার করা ছেড়ে দাও।’
উত্তরে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
‘হে কুরাইশরা, তোমরা যদি আমার এক হাতে সূর্য আর অন্য হাতে চন্দ্র এনে দাও, তথাপি আমি যে সত্যের সন্ধান পেয়েছি, তা প্রচার থেকে বিরত হব না।’ [মানুষের নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল জব্বার সিদ্দিকী, পৃ. ৭০]
তাই বলে ইসলামে কাটছাঁটের প্রশ্নই ওঠে না। নিজের ধর্মে অটল থেকে শান্তির জন্য অন্য ধর্মাবলম্বীদের তাদের ধর্ম পালনে সমান অধিকার দেওয়াই রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর আদর্শ। এটাই ইসলাম। এ জন্যই ইসলামের এক অর্থ আনুগত্য, অন্য অর্থ শান্তি। আনুগত্য মানে আল্লাহর আনুগত্য। আল্লাহর আনুগত্য মানে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশিত পথে অটল, অনড় ও অবিচল থাকা। আর শান্তি মানে মানুষে মানুষে সাম্য, জাতিতে জাতিতে মৈত্রী, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সম্প্রীতি।
সত্যিকারের মুসলিম ব্যক্তি কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না
যিনি সত্যিকারভাবে ইসলামকে বুঝতে পেরেছেন, তিনি কখনো অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী হতে পারেন না। যিনি সত্যিকার মুসলিম, তিনি কখনো অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শত্রুতামূলক আচরণ করতে পারেন না। যিনি সত্যিকার মুসলিম, তিনি কখনো দল-উপদলে বিভক্ত হতে পারেন না। কেননা হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে হযরত শিশ আলাইহিস সালাম, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম, হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম, হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম, হযরত মুসা আলাইহিস সালাম, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামসহ শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত আল্লাহ প্রেরিত প্রত্যেক নবী-রাসুলই ধারাবাহিকভাবে যে ধর্ম প্রচার করে গেছেন, তা-ই ইসলাম।
দুনিয়ার প্রথম মানুষ ও নবী হযরত আদম আলাইহিস সালাম যে ঐশী ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা শুরু করেন, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর হাতে এসে সে ধর্মই পূর্ণতা লাভ করেছে। অন্যদিকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর অনুসারীরা যেমন মুসলিম নামে খ্যাত, তেমনি মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর আগের নবীদের অনুসারী যাঁরা ছিলেন, ইসলামের পরিভাষায় তাঁরাও মুসলিম। পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবী পরবর্তী প্রত্যেক নবীর পূর্বসূরি ও পরবর্তী প্রত্যেক নবী পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবীর উত্তরসূরি বা পতাকাবাহী।
তাই বিশ্বাসীদের কথা হলো,
لاَ نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ
‘আমরা আল্লাহর রাসুলদের মধ্যে পার্থক্য করি না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৫)
সুতরাং বলা যায়, নিরপরাধ মানুষ হত্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিছুতেই ধর্মের শিক্ষা নয়। ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধর্ম। কারো ওপর নিজের বিশ্বাস জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। এসব কখনো ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ হতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৮