তাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় যে, বুখারি শরীফে না থাকলে কী তারা সেই মাসআলা পরিত্যাগ করবেন? মানবেন না?
বুখারি শরীফে মাত্র নয় হাজার বিরাশিটির মত বর্ণনা এসেছে। এর মানে কি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ তেইশ বছরের নবুওয়াতের জীবনে কওলি ও ফে'লি (বলা ও করা) সকল শরয়ী বিধানাবলী বুখারি শরীফেই সীমাবদ্ধ?
হায় হায়! এমন ধারণা করাতো হাদীস অস্বীকারেরই নামান্তর।
যদি বুখারি শরীফেই সব হাদীস থাকে, তাহলে অন্যান্য হাদীসের কিতাব লেখারই বা কী দরকার ছিল?
বুখারি শরীফ থাকার পরেও ইমাম বুখারী রহ. এর ছাত্র ইমাম মুসলিম রহ. আবার সহীহ মুসলিম লিখতে গেলেন কেন?
অন্যান্য হাদীসের কিতাবগুলো কেন লেখা হল?
দু:খজনকভাবে হাদীসের বিশাল ভান্ডার সম্পর্কে অজ্ঞ এই শ্রেনির লোকেরাই আবার নিজেদের 'হাদিসওয়ালা', 'আহলে হাদিস', ইত্যাদি নামে পরিচিত করাতে চায়। এদের প্রতি প্রশ্ন, যদি বুখারি শরীফেই সব মাসআলার সমাধান থেকে থাকে, তাহলে নামায সংক্রান্ত মাত্র দশটি মাসআলার সমাধান একটু বুখারি শরীফ থেকে দেখান তো দয়া করে:
১. বুখারি শরীফ থেকে দুই রাকাআত নামাযের পূর্ণাঙ্গ তরীকা দেখান।
২. নামাযের সব ক’টি সুন্নাত বুখারি শরীফ থেকে দেখান।
৩. নামাযের সব ক’টি ওয়াজিব বুখারি শরীফ থেকে দেখান।
৪. নামাযের সব ক’টি মুস্তাহাব বুখারি শরীফ থেকে দেখান।
৫. তাশাহহুদের শব্দাবলী কী? তাশাহহুদের শব্দাবলী বুখারি শরীফ থেকে দেখান।
৬. ঈদের নামাযের পূর্ণাঙ্গ তরীকা বুখারি শরীফ থেকে দেখান।
৭. জানাযা নামাযের পূর্ণাঙ্গ তরীকা বুখারি শরীফ থেকে দেখান।
৮. কী শব্দে আজান দিবে? শব্দাবলী বুখারি শরীফ থেকে দেখান।
৯. কী শব্দে ইকামত দিবে? শব্দাবলী বুখারি শরীফ থেকে দেখান।
১০. ঈদের তাকবীর কয়টি হবে? বুখারি শরীফ থেকে দেখান।
নামায সংক্রান্ত মাত্র দশটি প্রশ্ন এখানে একত্রিত করা হল। আপনি আসুন, আপনার দাবি মতে, অন্যান্য হাদিসের কিতাব বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বুখারি শরীফই যদি শরীয়তের সকল প্রশ্নের উত্তর হয়ে থাকে, তাহলে উপরোক্ত মাসআলাগুলোর সমাধান দয়া করে বুখারি শরীফ থেকে দেখান। হাদিসের অন্য কোন কিতাব থেকে দেখানো যাবে না।
আসলে এমন সব উক্তি ও মন্তব্য হাদীস অস্বীকারকারীদের নতুন আরেক চালাকী।
আসল কথা হচ্ছে, বুখারি এবং মুসলিম শরীফ ছাড়াও সহীহ হাদীস সংকলন করা হয়েছে এমন অনেক হাদীস গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বুখারি এবং মুসলিম শরীফের মূলনীতি অনুপাতেই যেসব হাদীস সহীহ। এমন হাদীস যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের স্ব স্ব কিতাবে আনেননি। কিন্তু তা বুখারী ও মুসলিমে আনা হাদীসের মতই সহীহ। এমন হাদীস একত্র করে “মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন” নামে আলাদা কিতাবও রচিত হয়েছে। যা এক সুবিশাল কিতাব। যে কিতাবে আট হাজার আটশত তিনটি হাদীস রয়েছে। যার কোনটিই বুখারি এবং মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়নি।
এসব হাদীসকে সহীহ হওয়া থেকে বের করে দেয়া পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কী হতে পারে?
ইমাম বুখারী রহঃ নিজেই বলেছেনঃ
فَقَدْ رُوِّينَا عَنِ الْبُخَارِيِّ أَنَّهُ قَالَ: ” مَا أَدْخَلْتُ فِي كِتَابِي (الْجَامِعِ) إِلَّا مَا صَحَّ، وَتَرَكْتُ مِنَ الصِّحَاحِ لِحَالِ الطُّولِ
ইমাম বুখারী রহঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ আমি আমার কিতাবে [সহীহ বুখারীতে] সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য হাদীস আনিনি। কিন্তু আমি অনেক সহীহ হাদীস আমার কিতাবের কলেবর বড় হবার শংকায় বাদ দিয়েছি। [মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ-১/১৯]
ইমাম মুসলিম বলেছেনঃ
وَرُوِّينَا عَنْ مُسْلِمٍ أَنَّهُ قَالَ: ” لَيْسَ كُلُّ شَيْءٍ عِنْدِي صَحِيحٌ وَضَعْتُهُ هَاهُنَا – يَعْنِي فِي كِتَابِهِ الصَّحِيحِ –
ইমাম মুসলিম থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেছেনঃ আমার কাছে “সহীহ” হিসেবে গণ্য সব হাদীসই আমার কিতাবে আনিনি। [মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ-১/২০]
এ বিষয়ে ইবনুস সালাহ রহঃ এর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্যঃ
وَقَدْ قَالَ الْبُخَارِيُّ: ” أَحْفَظُ مِائَةَ أَلْفِ حَدِيثٍ صَحِيحٍ، وَمِائَتَيْ أَلْفِ حَدِيثٍ غَيْرِ صَحِيحٍ “، وَجُمْلَةُ مَا فِي كِتَابِهِ الصَّحِيحِ سَبْعَةُ آلَافٍ وَمِائَتَانِ وَخَمْسَةٌ وَسَبْعُونَ حَدِيثًا بِالْأَحَادِيثِ الْمُتَكَرِّرَةِ. وَقَدْ قِيلَ: إِنَّهَا بِإِسْقَاطِ الْمُكَرَّرَةِ أَرْبَعَةُ آلَافِ حَدِيثٍ،
ইমাম বুখারী বলেছেনঃ আমার এক লাখ সহীহ হাদীস মুখস্ত। আর দুই লাখ গায়রে সহীহ হাদীস মুখস্ত।
অথচ সহীহ বুখারীতে তাকরার [এক বর্ণনা একাধিকবার উল্লেখকরণ]সহ মোট হাদীস সংখ্যা হল, সাত হাজার দুইশত পঁচাত্তরটি। আর কেউ কেউ বলেছেনঃ তাকরার ছাড়া হাদীস সংখ্যা হল চার হাজার। [মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ-১/২০]
আর তালীক ও তাকরারসহ হাদীস সংখ্যা হল নয় হাজার বিরাশিটি।
এখন প্রশ্ন হল, ইমাম বুখারী রহঃ বলেছেন, তার সহীহ হাদীসই মুখস্ত ছিল এক লাখ। বুখারীতে উল্লেখ আছে মাত্র নয় হাজার। তাও তাকরারসহ। বাকি একানব্বই হাজার সহীহ হাদীস গেল কোথায়?
সুতরাং বুঝা গেল, যারা শুধু বুখারীর হাদীস হলেই মানার দাবী করেন, তারা মূলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের সুবিশাল ভান্ডারকে ইচ্ছা করেই অস্বীকার করার হীনপ্রচেষ্টায় লিপ্ত। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি রহম করুন। সহীহ হাদীস অস্বীকারের ভয়ানক মানসিকতা থেকে তওবা করার তাওফিক দান করুন। আমাদের প্রতি রহমতের দরিয়াকে অবারিত করুন।
নিবন্ধটি তৈরিতে কৃতজ্ঞতা, আহলে হক মিডিয়ার প্রতি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৮ সকাল ১০:৩৮