প্রাককথন:
আমাদের জাতীয় কবি, দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য যেমন, বাংলা সাহিত্যের জন্যও এক মহাসম্পদ। কালের আয়নায় তাকালে নজরুলকে দেখি নিত্য সত্য। নজরুল চির কিশোর, চির তরুন, চির যুবক। বুড়িয়ে যান না কখনো। তাঁর বিশাল সাহিত্য সম্ভারও অবিনাশি যেীবন মদিরে সিক্ত। কাজী নজরুলের জন্ম বাঙালী মুসলিম পরিবারে। যে সমাজ-পরিবারে আশৈশব তিনি যুগপত ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মের অবাধ কৃষ্টি কালচার প্রত্যক্ষ করেছেন। আর তাইতো তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে এই দুই ধর্মের অনুসারীদের জন্যই অসংখ্য অবিস্মরনীয় কবিতা, গান এবং গজল। তিনি যেহেতু মনে প্রানে পরিপূর্ন একজন মুসলিম, সব মহৎ শিল্পী-সাহিত্যিকদের মত তিনিও স্ব-জাতি মুসলমানদের জাগরন-জাগৃতি-উন্নয়ন চিন্তা তাঁকে আজীবন ভাবিয়ে গেছে। বিশেষ করে বাঙালী মুসলিম সমাজের জন্য তাঁর কলম ছিল ক্ষুরধার। তিনি যে কতটা ইসলাম ধর্মে অন্তপ্রান ছিলেন, আত্মসত্ত্বাকে বিলীন করে ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর যে কী পরিমান বিনীত প্রেম আর প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল তা প্রত্যক্ষ করা যায়- তিনি নিজের বিনীত পরিচয়ে “খাদেমুল ইসলাম নজরুল ইসলাম” লিখতেও এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি তাঁর লিখনীতে মুসলমানদের নবী বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, করুণার মূর্ত প্রতীক হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি যে বর্ণনাতীত ভালোবাসা, প্রেম ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তা হয়তো আর কোন বাঙালী সাহিত্যিক দেখাতে সক্ষম হননি। কি তাঁর গান, কি কবিতা সব জায়গায় তিনি রাসূল প্রেমের অনবদ্য এক দ্যূতি ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। যার আলোকোচ্ছটা আজো এই উপমহাদেশের কোটি কোটি মুসলমানদের জাগিয়ে তোলে, প্রানের পরম স্পর্শে রাসূল প্রেমের ফল্গুধারা বইয়ে দেয় বাংলা ভাষাভাষি কোটি কোটি মানুষের প্রানের গহীনে। আজও নজরুলের রাসূল স্তুতিতে লেখা অসংখ্য গজল আর কবিতারা এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে ফেরে। এ যেন সকলের হৃদয়ের কথা, প্রাণের কথা, মন ও অন্তরের কথা। সবাই যেন এমনটাই চেয়েছিলেন। লিখতে পারেননি। নজরুল যেন সকলের পক্ষ হয়ে সকলের অন্তরের গহীনে লুকিয়ে থাকা নবীপ্রেমের প্রকাশ ঘটিয়েছেন মাতৃভাষায়, পরম মমতায়-প্রগাঢ় ভালবাসায়-প্রভূত আন্তরিকতায়। এই ধারার লিখনিতে দৃষ্টিপাত করলে নজরুলকে আমরা পাই, রাসূল প্রেমে মত্ত, মশগুল এবং আকন্ঠ নিমজ্জিত এক মহান সাধক ও মগ্ন নবী প্রেমিক হিসেবে। যেন তিনি তাঁর সবকিছু নবী প্রেমে সঁপে দিয়েছেন আর ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নগন্য এবং একজন বাধ্য শিষ্যরূপে নিজেকে পরিচয় দিতে।
বিশ্বময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বরকতপূর্ন নামে মানুষ কিরূপ শ্রদ্ধা ও পূর্ণভক্তি সহকারে দরুদ পড়েন তার উল্লেখ দেখতে পাই কবি নজরুলের কবিতায়। তিনি লিখেন-
উরজ্ য়্যামেন্ নজ্দ হেজাজ্ তাহামা ইরাক শাম
মেসের ওমান্ তিহারান-স্মরি’ কাহার বিরাট নাম,
পড়ে- “সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম”
কবি এখানে ইয়ামেন, নজদ, হিজাজ, ইরাক, ইরান, মিসর, ওমান ও তেহরানসহ বিশ্বব্যাপী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম বরকতপূর্ন নামে মানুষ কিরূপ শ্রদ্ধা ও পূর্ণভক্তি সহকারে দরুদ পড়েন তার উল্লেখ করেন।
কবি আরো বলেন-
“আমার সালাম পৌঁছে দিও নবীজীর রওজায়”
সৃষ্টির প্রাণ:
নজরুল তাঁর কবিতায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টিজগতের দম বা প্রাণ বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁর ইনতিকালের পর মক্কা ও মদিনার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি বলেন-
মক্কা ও মদিনায় আজ শোকের অবধি নাই।
যেন রোজ-হাশরের ময়দান, সব উন্মাদ সম ছুটে !
কাঁপে ঘন ঘন কাবা, গেল গেল বুঝি সৃষ্টির দম টুটে !
আর মিরাজের রজনীতে সৃষ্টিজগতের সেই প্রাণ আল্লাহ পাকের কাছে সৃষ্টি জগতের উর্ধ্বে লা মাকামে যাওয়ার কারণেই পৃথিবীর সবকিছু ছিল অচল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরশে আজীম থেকে ফিরে এসে দেখেন, তাঁর যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে সম্পন্ন করা অযুর পানি তখনো গড়িয়ে যাচ্ছে, বিছানাটা তখনো উষ্ণ। অথচ ঘুরে এসেছেন অসীম জগতের সুবিস্তৃত পথ ও মঞ্জিল।
আয়াতের কাব্যানুবাদে রাসূল স্তুতি:
আমপারার দু'টি আয়াতে আল্লাহ পাক বিশেষভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন।
وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ
'আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি।' সূরাহ আল ইনশিরাহ, আয়াত-৪
নজরুল তার কাব্যিক অনুবাদ করেছেন এইভাবে-
“করিনি কি মহীয়ান মহিমা-বিথার?”)
অপর আয়াত-
وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى
'আপনার পালনকর্তা সত্বরই আপনাকে দান করবেন, অতঃপর আপনি সন্তুষ্ট হবেন।' সূরাহ আদ্দুহা, আয়াত-৪
নজরুলের কাব্যানুবাদ-
“অচিরাৎ তব প্রভু দানিবেন, (সম্পদ) খুশী হইবে যাতে।”
বায়রনের যেমন গ্রীসের প্রতি হৃদয়ের একটা টান ছিল নজরুলের ছিল তেমনি “জাজিরাতুল আরব” এর প্রতি। এই আকর্ষণের কারণ যে ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মভুমি তাতে সন্দেহ নেই। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি নজরুলের সীমাহীন অনুরাগ প্রদর্শন। ‘খেয়াপারের তরণী’ কবিতায় নজরুল এই মহামানবের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রথম প্রদর্শন করেন। এ কবিতায় তিনি বললেন, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদক্ষতম কান্ডারী, সুতরাং যাঁরা ইসলাম-তরণীর আরোহী, তাদের শত ঝড়-ঝঞ্ঝায় কোন বিপদের আশঙ্কা নেই। সমস্যা-সঙ্কুল এই পৃথিবীর তমসাকীর্ণ সময় ততক্ষণ নির্ভয়ে পাড়ি দিতে পারবে যতক্ষণ তারা হযরতের নির্দেশিত পথে চলবে।
মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ:
১৯৩০ খ্রীস্টাব্দের দিকে নজরুল যখন ইসলামী গান লিখতে শুরু করেন, তখন হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর প্রশস্তিমূলক না'ত (হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শানে রচিত কবিতা বা পদ) রচনার সময় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে নজরুল একটি কাব্যগ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় নজরুল এই কাব্যটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। নবীর জীবনী বর্ণনামূলক এই দীর্ঘ প্রবন্ধ কাব্যের ১৭ টি পরিচ্ছেদ কবি সম্পন্ন করেন, কিন্তু ১৮ তম পরিচ্ছেদটি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেন নি। “সাম্যবাদী” নামে এই পরিচ্ছেদের মাত্র ষোলটি পংক্তি রচিত হয়েছিল। নজরুলের আকস্মিক রোগাক্রান্ত এবং নিশ্চল হওয়ার দরুণ “মরু-ভাস্কর” অসমাপ্ত থেকে যায়। মরুভাস্কর গ্রন্থের ভুমিকায় কাজী নজরুল ইসলামের স্ত্রী প্রমীলা বলেন:
“বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনী নিয়ে একখানি বৃহৎ কাব্যগ্রন্থ রচনার কথা তিনি প্রায়ই বলতেন।”
কবি এ কাব্যগ্রন্থে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাল্যকালের প্রায় পুরো সময়টাকেই সুচারুরুপে এক কাব্যিক অলংকার দিয়ে বর্ণনা করেছেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শিশু অবস্থায় যখন মা ‘আমিনা’ বাবা আব্দুল্লাহর কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে নিয়ে যান। ফিরে আসার সময় পথিমধ্যে মা ‘আমিনার’ ইন্তিকালের হৃদয় বিদারক কাহিনী তুলে ধরেন এভাবে-
“কিছু দূর আসি’ পথ-মঞ্জিলে আমিনা কয়-
বুকে বড় ব্যথা, আহমদ, বুঝি হ’ল সময়
তোরে একলাটি ফেলিয়া যাবার! চাঁদ আমার,
কাঁদিসনে তুই, রহিল যে রহমত খোদার!”
আমরা দেখি যে, কবি নজরুল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শিশুবেলার দুঃখে দুঃখিত ও ব্যথিত হয়েছেন এবং কবি তার বিভিন্ন কবিতায় এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন। কবির হৃদয়ে ছিল শিশু এতিম নবীর প্রতি এক অকৃত্রিম আবেগ আর ভালোবাসা। কবি উক্ত কবিতায় লিখেন-
“সব শোকে দিবে শান্তি যে- শৈশব তাহার
কেন এত শোক-দুঃখময়?”
অর্থাৎ, যিনি এসেছেন পুরো বিশ্বজাহানের সকলের দুঃখ ঘুচাবার তরে আর তিনিই কিনা এত দুঃখ, ব্যাথা নিয়ে শৈশব পার করেছেন। এ সৃষ্টিকর্তার এক অপার মহিমার লীলাখেলা, যেন এক প্রেম খেলা। বন্ধুর সাথে বন্ধুর, হাবিবের সাথে মাহবুবের, প্রেমাস্পদের সাথে প্রেমিকের। যা বুঝবার ক্ষমতা হয়তো কেবল চক্ষুষ্মান প্রিয় প্রেমিক বান্দারাই রাখেন।
আরব সূর্য:
কাজী নজরুল দয়ার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরবের উদিত সূর্য বলে উল্লেখ করে তাঁর গুণগান গেয়েছেন। সূর্য যেমনি করে সমস্ত জগতকে আলো দেয় তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে কল্যাণ ও রহমতের এক ঐশী আলো নিয়ে এসেছেন। কবির রচনায় এসেছে:
জেগে ওঠ্ তুই রে ভোরের পাখী, নিশি প্রভাতের কবি !
লোহিত সাগরে সিনান করিয়া উদিল আরব-রবি।
তিনি আরো বলেন:
নহে আরবের, নহে এশিয়ার, বিশ্বে সে একদিন,
ধূলির ধরার জ্যোতিতে হ’ল গো বেহেশত জ্যোতিহীন !
কবি তাঁর অন্য কাব্যগ্রন্থে লিখেন:
“উঠেছিল রবি আমাদের নবী, সে মহা-সৌরলোকে,
উমর, একাকী তুমি পেয়েছিলে সে আলো তোমার চোখে!”
বিশ্বনবীর আগমনী সংবাদ:
আরবী ভাষায় একটি প্রবাদ আছে যে, “মান আহাব্বা সাইয়্যান আকছারা জিকরাহু” অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন কিছু ভালবাসে সে সব সময় শুধু ঐ বিষয় নিয়েই কথা বলে। আমরা দেখতে পাই, কবি নজরুল তাঁর অসংখ্য লিখনীতে প্রিয়তম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে বিভিন্নভাবে প্রশংসায় মেতে উঠেছেন। তাঁর আগমনের কথা বলেছেন, কখনো আবার এতিম বালক নবীজীর করূণ কাহিনী বর্ণনা করেছেন, আবার কখনো তাঁর অনুপম চরিত্রের জয়গান গেয়েছেন। কবি যেন নবীজীর আগমনে সারা দুনিয়ায় খুশির পয়গাম ছড়িয়ে দিচ্ছেন। কবির ভাষায়-
১. “ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।
২. “আসিছেন হাবিব-এ খোদা আরশ্-পাকে তাই উঠেছে শোর।”
৩. “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
মধু পূর্ণিমারি সেথা চাঁদ দোলে
যেন ঊষার কোলে রাঙা-রবি দোলে।
‘মুহাম্মদ’ মোবারক নামের প্রশংসা:
কবি নজরুল বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামকরণের ইতিহাসও মরু-ভাস্কর কবিতায় তুলে ধরেছেন। রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম রেখেছেন তাঁর দাদা তৎকালীন মক্কার কুরাইশ দলপতি আব্দুল মুত্তালিব। তিনি তা এভাবে বর্ণনা করেন যে-
“কহিল মুত্তালিব বুকে চাপি’ নিখিলের সম্পদ-
‘নয়নাভিরাম! এ শিশুর নাম রাখিনু ‘মোহাম্মদ’।”
নজরুল তাঁর কবিতায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম মুবারকের প্রশংসায় মেতে উঠেছেন। এ যেন এক সত্য প্রেমিক, যে প্রমিক তার প্রেমাস্পদের সবকিছু নিয়েই বলতে চায়। প্রেমাস্পদের সবকিছু নিয়েই যেন তার বলতে হবে, নতুবা প্রেমিক মনের পরিপূর্ণ তৃপ্তি হয় না। কবি বলেন:
গুঞ্জরি ওঠে বিশ্ব-মধুপ- “আসিল মোহাম্মদ!”
অভিনব নাম শুনিল রে- ধরা সেদিন- “মোহাম্মদ!”
এতদিন পরে এল ধরার- “প্রশংসিত ও প্রেমাস্পদ!”
কবি যেন এই ‘মুহাম্মদ’ নামটির প্রেমি পড়ে গেছেন। এখন শুধু এই নামটি জপাই কবি হৃদয়ের প্রশান্তি। তিনি বলেন-
“নাম মোহম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল
যে নাম নিয়ে চাঁদ-সেতারা আসমানে খায় দোল।”
(নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ, সম্পাদনা- রশিদুন নবী, প্রকাশনা- নজরুল ইন্সটিটিউট, পৃষ্ঠা-১৭১)
“মোহাম্মদ নাম যত জপি, তত মধুর লাগে
নামে এত মধু থাকে, কে জানিত আগে।”
(নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ, রশিদুন নবী কর্তৃক সম্পাদিত, নজরুল ইন্সটিটিউট, ২০১৪ খ্রি., পৃষ্ঠা-১৭৩)
কবি তাঁর “অনাগত” কবিতায় আরো বলেন:
“মোহাম্মদ এ, সুন্দর এ, নিখিল- প্রশংসিত,
ইহার কন্ঠে আমার বাণী ও আদেশ হইবে গীত।”
বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনে ধন্য হয়েছিল মক্কা, মদিনা, আরব, এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্ব। কেননা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআন মাজীদে ইরশাদ ফরমান-
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ
“নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত সরুপ প্রেরণ করেছি”। সূরাহ আল আম্বিয়া, আয়াত-১০৭
কবি বলেন:
“ধন্য মক্কা, ধন্য আরব, ধন্য এশিয়া পুণ্য দেশ,
তোমাতে আসিল প্রথম নবী গো, তোমাতে আসিল নবীর শেষ।”
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ পাক দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছেন সকল প্রকার ভেদাভেদ, হানাহানি-মারামারি ভুলিয়ে মানুষের মাঝে প্রেম-প্রীতি আর ভালোবাসা কায়েম করার জন্য। তিনি এই ধরায় এসে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের মত নিকৃষ্টতম এক বর্বর যুগের মানুষদের পরিনত করলেন পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে সোনার মানুষে। কবির কবিতায় সেকথারই জয়গান দেখা যায়-
“দেখিতে দেখিতে তরুণ নবীর সাধনা-সেবায়
শত্রু মিত্র সকলে গলিল অজানা মায়ায়।”
“মোহাম্মদের প্রভাবে সকলে হইল রাজী,
সত্যের নামে চলিবে না আর ফেরেব-বাজী !”
মক্কার অধিবাসীরা মহনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অসম্ভব রকমের সত্যবাদী বালক হিসেবে জানতো। তারা মনে করতো মুহাম্মদের নিকট যা রাখা হবে তাই আমানত এবং নিরাপদ। সে কখনো মিথ্যা বলেনা। তাই তারা তাঁর নাম দিয়েছিল “আল-আমিন” অর্থাৎ বিশ্বাসী। কবি নজরুলও এ বিষয়টি এড়িয়ে যাননি। তিনি বলেন-
“ক্রমে ক্রমে সব কোরেশ জানিল- মোহাম্মদ আমীন
করে না কো পূজা কা’বার ভূতেরে ভাবিয়া তাদেরে হীন।”
আল্লাহর সাথে নবীজীর উল্লেখ:
কবি নজরুল তাঁর লেখার অনেক জায়গায় যেখানে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা করেছেন সেখানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গুণগাণ গেয়েছেন। যেমনি করে কুরআন মাজীদের অসংখ্য আয়াতের মাঝে আমরা এটা লক্ষ্য করি যে, আল্লাহর নামের সাথে তাঁর প্রিয় হাবিব নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম উল্লেখ আছে। কুরআনের ভাষায়-
১.
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً
''হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।'' সূরাহ আননিসা, আয়াত-৫৯
২.
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
''বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।'' সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত-৩১
কবি এই সমস্ত আয়াতের অনুকুলে কাব্যিক আকারে তাঁর ভাব প্রকাশ করেন।
১. “খোদারে আমরা করি গো সেজদা, রুসূলে করি সালাম,
ওরাঁ ঊর্ধ্বের, পবিত্র হয়ে নিই তাঁহাদের নাম,
২. আল্লাহ রসূল বোল্ রে মন আল্লাহ রসূল বোল।
দিনে দিনে দিন গেল তোর দুনিয়াদারি ভোল॥
রোজ কেয়ামতের নিয়ামত এই আল্লাহ-রসূল বাণী
তোর দিল দরিয়ায় আল্লাহ-রসূল জপের লহর তোল ॥
৩. মোহাম্মদ মোস্তফা নামের (ও ভাই) গুণের রশি ধরি
খোদার রাহে সপে দেওয়া ডুববে না মোর তরী ॥
আল্লাকে যে পাইতে চায় হজরতকে ভালবেসে
আরশ কুরসি লওহ কালাম, না চাহিতেই পেয়েছে সে।
রসূল নামের রশি ধ’রে যেতে হবে খোদার ঘরে,
৪. বক্ষে আমার কা’বার ছবি চক্ষে মোহাম্মদ রসুল।
নবীজীর প্রতি কবির আকুতি:
কবি তার কবিতায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে কখনো তার নয়ন-মণি, কখনো গলার মালা, আবার কখনো চোখের অশ্রুর সাথে তুলনা করে কবি মনের আকুল কাকুতি-মিনতি প্রকাশ করেছেন। কবি মনে করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই তার সবকিছু। এমনকি কবি মানবজাতির বহুল আকাক্সিক্ষত বেহেশতের আশাও ছেড়ে দিয়েছেন যদি পান সেই মহান প্রেমাস্পদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। যেমন কবির ভাষায়-
মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি মোহাম্মদ নাম জপমালা।
মোহাম্মদ নাম শিরে ধরি, মোহাম্মদ নাম গলায় পরি,
মোহাম্মদ মোর অশ্রু-চোখের ব্যথার সাথি শান্তি শোকের,
চাইনে বেহেশত্ যদি ও নাম জপ্তে সদা পাই নিরালা॥
একত্মবাদের দিশারী:
কবি তাঁর জীবনে একত্মবাদের দিশারী হিসেবেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে একমাত্র কান্ডারী বলে স্বীকার করেছেন। আমরা তাঁর কবিতায় ও গানে এই বিষয়টির স্পষ্ট উল্লেখ দেখতে পায়। যেমন-
“তৌহিদেরি মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম।”
কবি পরম সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত ও দয়া প্রাপ্তির মাধ্যমও মনে করেছেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। কবি বলেন-
“খোদার রহম চাহ যদি নবীজীরে ধর।”
পথ-প্রদর্শক কান্ডারী:
কবি মনে করেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া অন্য কেউ বেহেশতের সঠিক পথ দেখাতে পারবে না। একমাত্র সহজ-সরল ও সত্যের পথ মানবজাতিকে দেখানোর জন্যই যেন তিনি পরম সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে এ ধরাধামে আগমন করেছেন। তিনি বলেন-
“ইয়া মোহাম্মদ, বেহেশত হতে খোদায় পাওয়ার পথ দেখাও।”
পৃথিবীতে মহান আল্লাহর ঘর বলতে মক্কা নগরীর পবিত্র কাবা শরীফকে বুঝানো হয়ে থাকে। আর হজ্জ ও হজ্জের মৌসুম ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়েও সমগ্র পৃথিবী থেকে দলে দলে মুসলমানরা এই ঘর তাওয়াফসহ পবিত্র জায়গাটি কেন্দ্র করে পূণ্য হাসিলের নিমিত্তে ছুটে আসে। জীবনের একটি পরম আকাক্সক্ষা থাকে কাবার পথে যাওয়ার। কবির মনেও ছিল এইরকম এক সুপ্ত বাসনা। আর তিনি প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছেই প্রকাশ করলেন তাঁর এই গহীন ইচ্ছা। তিনি বলেন-
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! মোরে রাহা দেখাও সেই কাবার।”
শ্রেষ্ঠ নবীর জয়গান:
কবি সমগ্র সৃষ্টিজগতে প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। তিনি মনে করেন তাঁর মতো বিশ্বে দ্বিতীয় মর্যাদাবান ব্যাক্তিত্বের অধিকারী আর কেউ নেই। তিনি বলেন আকাশে সবগুলি তারার মাঝে সূর্য যেমন, সমস্ত নবীর মাঝে আমার নবী তেমন। কবির কাব্যিক ভাষায়-
১. “নবীর মাঝে রবির সম আমার মোহাম্মদ রসুল,
খোদার হাবিব দীনের নকিব বিশ্বে নাই যার সমতুল।”
২. “বাদশারও বাদশাহ্ নবীদের রাজা তিনি।”
সারা বাংলার মানুষের মুখে মুখে সুরের লহরী তোলে কবির জনপ্রিয় যেসব হামদে বারি তা'আলা এবং না'তে রাসূল:
দূরন্ত দামাল নজরুলকে কাল কিংবা স্থানের সীমানায় যেমন আটকে রাখা যায় না, বাংলা ভাষার কবি হলেও তিনি যেমন বিশ্বজনীন, তেমনি বিশ্ব মুসলিমের জন্য তিনি রেখে গেছেন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি কর্ম সম্ভার। ধর্মীয় জ্ঞানে, ইসলামের মৌলিক জ্ঞানে কতখানি ব্যুৎপত্তি থাকলে তাঁর হাত দিয়ে এমন যুতসই, মোক্ষম এবং যথার্থ ইতিহাসের আলোকে সময়ের গন্ডিকে জয় করা অসংখ্য হামদ, না'তসহ ইসলামী সঙ্গীত বেরিয়ে আসতে পারে। নজরুলের একেকটি না'তে রাসূল যেন ইপ্সিত আরাধনার বিনম্র সবক। তাঁর রচিত হামদ যেন প্রভূ পালয়িতার সাথে হৃদ্যতায় আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়ার ব্যতিক্রমী তরিকা। তাঁর ইসলামী সঙ্গিত যেন তাওহিদের শরাব পানে মৃত প্রায় উম্মতের মন ও মননে জাগরন ও জাগৃতির ঢেউ, উত্তাল তরঙ্গ। সারা বাংলার মানুষের মুখে মুখে সুরের লহরী তোলে কবির জনপ্রিয় যেসব হামদে বারি তা'আলা এবং না'তে রাসূল:
১. ''সাহারাতে ফুটল রে ফুল রঙিন গুলে লালা,
সেই ফুলেরই খুশবুতে আজ দুনিয়া মাতোয়ারা।''
২. ''নবী মোর পরশ মনি নবী মোর সোনার খনি,
নবী নাম জপে যে জন সেই তো দোজাহানের ধনী।''
৩. ''হেরা হতে হেলে দুলে''
৪. ''আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ,
যে পথ ধরে চলে যেতেন নূর নবী হযরত।''
৫. ''ত্রি-ভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ....
৬. ''শোনো শোনো ইয়া এলাহী আমারি মুনাজাত রে শোনো আমারি মুনাজাত,
তোমারি নাম জপে যেন হৃদয় দিবস রাত।''
৭. ''আল্লাহকে যে পাইতে চায় কোথা সে মুসলমান।''
৮. ''ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানী তাকিদ।''
৯. ''রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার,
বিচার চাহে না ....।''
১০. ''আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লে জালালু,
শেষ করা তো যায় না গেয়ে তোমার গুনগান।''
১১. ''তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে,
মধু পূর্নিমারই সেথা চাঁদও দোলে।''
১২. ''মসজিদের ই পাশে আমায় কবর দিও ভাই,
যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।''
১৩. ''এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি,
খোদা তোমার মেহেরবানী, খোদা তোমার মেহেরবানী।''
১৪. ''আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি, নাহি, ভয়...।''
১৫. ''আল্লাহ তে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান....।''
শেষের কথা:
প্রিয়তম নবীজীর প্রতি অগনিত দরুদ ও সালাম। আমাদের প্রিয় কবি, জাতীয় কবি, প্রানের কবির আত্মার প্রতি মাগফিরাতের বৃষ্টি বর্ষিত হোক অজস্র ধারায়। তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান বানান মহান প্রভূ পালয়িতা।
এই নিবন্ধটি নজরুল ভক্তদের প্রতি নিবেদিত, যারা নজরুলকে ভালবাসেন জাত পাতের উর্ধ্বে উঠে।
পুনশ্চ:
মো: নিজাম উদ্দিন মন্ডল ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তিনি অনেকগুলো হামদ এবং না'তে রাসূল স্মরন করিয়ে দিয়েছেন। যদিও নিবন্ধটিতে শুধু না'তে রাসূল প্রসঙ্গটিই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত ছিল, কিন্তু তাঁর প্রতি আন্তরিকতা রেখে, মন্তব্যে তার উল্লেখ করা হামদে বারি তা'আলা গুলোকেও পোস্টে যুক্ত করা হলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৮ সকাল ১০:১৬