পুরাকালে বাদশাহদের দরবারে আলেমদের খুব কদর ছিল। এক বাদশাহ দ্বীনী বিষয় নিয়ে তার দরবারে এক আলেমের সাথে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি একটি শিশুকে নিয়ে এসে সেই আলেমের খেদমতে আরজ করলো: ''হুজুর, আমার এই ছেলেটির পেট ফেঁপেছে, ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছে। দয়া করে কিছু করুন যেন আল্লাহ পাক আরোগ্য দান করেন।''
উক্ত বুযুর্গ আলেম শিশুটির পেট লক্ষ্য করে একটি ফুঁক দিলেন এবং বললেন: ''যাও, নিয়ে যাও। ইনশাআল্লাহ ভাল হয়ে যাবে।''
বাদশাহ বিষয়টি লক্ষ্য করলেন, কিন্তু সন্তষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বুযুর্গকে বললেন: ''হযরত! আমি আপনাকে জ্ঞানী ব্যক্তি ভেবেছিলাম! কিন্তু আপনি যা করলেন তার কোন যুক্তি দেখি না। শিশুটি যন্ত্রনায় কাতর অথচ তার চিকিতসার কোন ব্যবস্থা না করে শুধুমাত্র একটি ছু করে দিলেন। এই ছু করাতে কী যায় আসে? রুগ্নদের প্রতি দয়া দেখানোই তো মহত ব্যক্তির লক্ষন।''
বুযুর্গ বললেন: ''বাদশাহ আপনার লক্ষন বেশি ভাল নয়। দেশের লোক আপনার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছে। তারা আপনার বদনাম ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। জনগনের অসন্তুষ্টি মঙ্গলজনক হয় না।''
বাদশাহর মুখমন্ডল কালো হয়ে একেবারে যেন নূয়ে পড়লো।
বুযুর্গ বললেন: ''তবে দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরাই শুধু বদনাম ছড়ায়। কারন দুষ্টদের দমনের জন্য আপনার কঠোরতায় তারা সন্তুষ্ট হতে পারে না। এতে প্রকৃতপক্ষে আপনার মর্যাদাই বৃদ্ধি পাবে।''
বাদশাহর মুখ এবার হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আনন্দে মুখে কথার খৈ ফুটতে লাগলো।
বুযুর্গ বললেন: ''কিন্তু দেশে দুষ্ট লোকের সংখ্যাই অধিক। এরা বিদ্রোহ করলে আপনার ক্ষমতা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।''
একথা শুনে বাদশাহর মুখমন্ডল লাল হয়ে উঠলো। ক্রোধে তিনি ফেটে পড়লেন। আসন ছেড়ে উঠে দুই হাতের আস্তিন গুটাতে গুটাতে বললেন, ''কে আছে আমার সঙ্গে বিদ্রোহ করবে? আমার সৈন্য আছে, অস্ত্র আছে, বিদ্রোহ দমন করতে হয় কিভাবে তাও আমার জানা আছে ......।"
বুযুর্গ বললেন: ''দুষ্ট লোকেরা সংখ্যায় অধিক হলেও তাদের সাহস কম থাকে। বিদ্রোহ করার মত মনোবল তাদের নেই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার মত ন্যায়পরায়ন বাদশাহ ইনশাআল্লাহ শান্তিতে থাকবেন এবং দেশেও শান্তি বিরাজ করবে।"
এই কথা শুনে বাদশাহ শান্ত সুবোধ বালকের মত আসনে বসে পড়লেন। তার চেহারায় প্রশান্তির ভাব ফিরে এলো। যেন তার কিছুই হয় নি।
এবার বুযুর্গ বললেন: "দেখুন বাদশাহ! আমি আপনাকে চারটি কথা বলেছি। এর দ্বারা আপনার অবস্থা চার বার পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম কথায় লজ্জায় অপমানে আপনার চেহারা কালো হয়ে পড়লো। দ্বিতীয় কথা দ্বারা আপনি আনন্দিত হলেন। তৃতীয় কথায় আপনার মুখমন্ডল ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো, আপনি আসন ছেড়ে উঠে ছটফট করতে লাগলেন। চতুর্থ কথায় আপনার মুখমন্ডলে শান্ত ভাব ফিরে এলো। আপনি নিশ্চিন্তে আসন গ্রহন করলেন।"
বুযুর্গ আলেম বলে চললেন:
''দেখুন, আমি আল্লাহ পাকের নগন্য এক বান্দা। আমার কথা যদি আপনার উপর এতটা প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তবে মহান আল্লাহর কথায় কি কোন প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া নেই? তাঁর পবিত্র বানীর প্রভাবে কি পাহাড় চূর্ন হয়ে যেতে পারে না? তাঁর কথা কি মানুষের দেহের উপর প্রভাব বিস্তার করে না? রোগের উপশম হয় না? তবে কেন আপনার এই ধারনা জন্মালো যে শিশুটির দেহের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা পবিত্র কুরআনের বানী তার উপর কোন আছর করবে না, তার রোগ উপশম হবে না?"
বাদশাহ এবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হলেন এবং তওবা করলেন, জীবনে আর এরূপ কথা বলবেন না।
নোট: উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম হাকিমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহ আলাইহির খলিফা হযরত কারী মুহাম্মদ তাইয়েব রহমাতুল্লাহ আলাইহির ওয়াজ থেকে সংগৃহীত অতি মূল্যবান এই ঘটনাটি। ১৯৬১ ইং সনে করাচী জুন মার্কেটের দারুল কোরআন মাদ্রাসায় এক মাহফিলে তিনি এই বয়ানটি করেন। আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১০:৪৬