কামালপুর মুক্তিযুদ্ধ সৃতিস্তম্ব
মহাখালি থেকে রাত ১০ টায় রউমারীর বাসে চেপে বসলাম বকশীগঞ্জের উদ্দেশ্যে, সঙ্গী সাথে আরও তিনজন হাসনুল ভাই, শহীদুল্লাহ ও আলম। ও আমার আরও দুইজন প্রাণহীন সঙ্গী, ক্যামেরা যে কিনা আমার ভ্রমনের সৃতিগুলোকে আগলে রাখে এবং জিপিএস যে কিনা আমার অন্যতম পথ প্রদর্শক। খুব তাড়াহুড়া করেই রওনা হয়েছিলাম বাসা থেকে মহাখালি বাস টার্মিনালে, সাত রাস্তা পার হয়ে প্রচণ্ড জ্যামে মিনিট পনের সিএনজিতে বসে থেকে অবশেষে সিএনজি ছেড়ে কিছুটা পায়ে হেঁটে সামনে থেকে একটা রিক্সা নিলাম, বাস ছাড়ার ঠিক দুই মিনিট আগে যেয়ে পৌঁছলাম রাজিব পরিবহনের কাউন্টারে। যথাসময়ে বাস ছাড়ল রউমারীর উদ্দেশ্যে।
গারো পরিবার
অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের উত্তরের গারো পাহাড় এলাকায় ট্রেকিং এ যাওয়ার। যদিও কোথায় থাকব, কিভাবে থাকব, কি খাব কিছুই জানি না। থাকবার জন্য শুধু একটি তাবু নিয়েছি সাথে, যেটাতে চাপাচাপি করে বড়জোর দুই থেকে তিনজন থাকা যায়। আর খাওয়ার জন্য একটা পাউরূটি, কয়েকটা ডিমসিদ্ধ, মেওনেস, টমেটোসস ও কয়েক প্যাকেট ইনস্ট্যান্ট নুডুলস। যদি ঐ এলাকাতে কিছুই না পাই তাহলে প্রথমদিন পাউরূটি, ডিমসিদ্ধ ও মেওনেস দিয়ে পার করব আর পরের দুইদিন টমেটোসস ও ইনস্ট্যান্ট নুডুলস দিয়ে, আর বাকীটা আল্লাহ্ ভরসা। উল্লেখ্য আমরা চারজনই ঐ এলাকায় একদম নুতন, তাছাড়া বাকি তিনজনই সম্পূর্ণ আমার উপর ভরসা করে রওনা হয়েছে। পুরো ব্যাপারটাই একটা এডভেঞ্চার বলা যায়।
লাউচাপরা যাওয়ার পথ
কয়েকদিন আগে থেকেই গুগোল আর্থ ঘেঁটেঘুটে মোটামুটি একটা রুট প্ল্যান মনে মনে তৈরি করেছিলাম এবং আমার গাইড জিপিএসকেও সেইভাবে রেডি করেছি। জামালপুরের বকশীগঞ্জ থেকে আরম্ভ করে লাউচাপরা ইকো পার্ক হয়ে শেরপুরের শ্রীবরদির কর্ণঝোড়া হয়ে ঝিনাইগাদির গাজনি অবকাশ কেন্দ্র (ইকো পার্ক) হয়ে নালিতাবাড়ির মধুটিলা ইকো পার্ক হয়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট পর্যন্ত। এক ট্রেইলে তিনটা ইকো পার্ক, তিনদিনে তিন জেলার মোট পাঁচটি উপজেলা ট্রেক করব।
লাউচাপরা যাওয়ার পথে
রাত প্রায় সাড়ে ১২ টার দিকে বাস ময়মনসিংহের কিছুটা আগে একটি হোটেলে ১৫ মিনিটের জন্য যাত্রা বিরতি করল। এরই মধ্যে একজনের সাথে আলাপ হোল তিনি একজন বিজিবি কর্মকর্তা একই বাসে রউমারী যাচ্ছেন। তাঁর কাছে জানতে পারলাম যে দুইদিন আগে রউমারী সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ গুলিতে একজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে তাই ঐ দিকে সীমান্ত এলাকা কিছুটা উত্তপ্ত।
কামালপুর বাজারে পণ্য নিয়ে যাওয়া
রাত প্রায় সাড়ে ৩ টার দিকে বাস আমাদের বকশীগঞ্জের কামালপুর বাজারে নামিয়ে দিল। কুয়াশাছন্ন শীতের মাঝরাতে গ্রাম্য বাজারে নামতেই চতুরদিকের নীরবতা যেন আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাল। ঘুম কাতুরে শহীদুল্লাহ ও আলম পাশে টংঘরের ফাঁকা দোকানে ব্যাকপেকটাকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে পরল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই কামালপুর বাজারকে নাক দিয়ে যেন তাদের আগমনের বার্তা জানাতে শুরু করল। হাসনুল ভাইও কিছুটা বিশ্রামের আশায় পাশের আরেকটা বেঞ্চিতে গা হেলিয়ে দিলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে হাসনুল ভাইও তাদের সাথে সুর মিলিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করলেন। আমি না ঘুমানোর জন্য আশেপাশে পায়চারী করতে থাকলাম। এরই মধ্যে বাজারের নাইড গার্ডের সাথে দেখা হল, আলাপ প্রসঙ্গে তাঁর কাছ থেকে আমাদের ট্রেকিং এর পথটা সম্বন্ধে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, এবং জিপিএসে তুলে আনা রুটটা সম্বন্ধে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিলাম।
লাউচাপরা যাওয়ার পথে
প্রায় ভোঁর হয়ে আসছে, বাজারের পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আযান শুনা যাচ্ছে, হাসনুল ভাই আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালেন বললেন নামাজে যাবেন, আমিও সাথে যোগ দিলাম। নামাজ শেষে বাজারের আশেপাশে একটু ঘুরাঘুরি করতে করতে কামালপুর মুক্তিযুদ্ধ সৃতিস্তম্বের কাছে এসে দাঁড়ালাম, এক পলক তাকিয়ে থেকে মনে হলো বাকি দুইজনকে নিয়ে আসি। দেরী না করে আবার ফিরে এলাম এবং তাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে তারাতারি রেডি হয়ে নিতে বললাম। পাশের খাবার হোটেল মাত্র খুলেছে, জানতে চাইলাম তাদের সকালে নাস্তার মেন্যু কি করবে। লম্বা একটা মেন্যু শুনে বুজতে পারলাম যে তারা শহরের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পরোটা, ডিম ভাজি এবং চায়ের অর্ডার দিতেই বলল কিছুক্ষণ সময় লাগবে মাত্র দোকান খুলেছে। সময়টা কাজে লাগানর জন্য আমরা এই সময়ের মধ্যে কামালপুর মুক্তিযুদ্ধ সৃতিস্তম্বের কাছে থেকে ঘুরে আসলাম। অপূর্ব সুন্দর একটি সৃতি চিহ্ন এই কামালপুর মুক্তিযুদ্ধ সৃতিস্তম্বটি। ধানুয়া কামালপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শহীদ মুক্তিযুদ্ধাদের স্মরনে নির্মিত এই সৃতিস্তম্বটি। মার্বেল পাথরে খোদাই করে ঐ এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ কালীন ম্যাপ এবং প্রতিটি বীর শহীদের নাম উল্লেখ করা।
লাউচাপরা ইকো পার্ক
ফিরে এসে পরোটা, ডিম ভাজি এবং চা দিয়ে তারাতারি নাস্তা সেরে ট্রেকিংয়ে বের হলাম। দুই পাশের সবুজ ধানের ক্ষেত, দূরে পাহাড়ের হাতছানি, যতই সামনে এগোচ্ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। মনে হচ্ছে পাহাড় টিলাগুলো আস্তে আস্তে আমাদের নিকটে চলে আসছে, একসময় লক্ষ্য করি যে আমরা তো পাহাড়ি পথের মধ্য দিয়াই হাঁটছি। মাঝে মাঝে দুই একজনের সাথে পথে দেখা হয়, কারো কাঁধে সবজি বা অন্যকিছু চাপিয়ে চলছে বাজারে, কারোবা সাইকেল বা ভ্যানে করে নিয়ে চলছে বাজারে তার সামগ্রী বিক্রির জন্য। পুরো পথে ছোট ছোট কয়েকটা চায়ের দোকানে যাত্রা বিরতি করে বেলা ১১টার সময় আমরা লাউচাপরা ইকো পার্কে পৌঁছেলাম। জিপিএসে দেখলাম প্রায় ৬ কিমি পথ পারি দিলাম ঘণ্টা দুই এর মধ্যে। যদিও আমাদের ঘণ্টায় ৪ থেকে ৪.৫ কিমি হাটা দরকার, কিন্তু পথিমধ্যে বার বার ছবি তোলা ও চায়ের যাত্রা বিরতির কারনে অনেকটাই পিছিয়ে আছি তবে এই নিয়ে কারো কোন তাড়া নাই, যেখানে রাত সেখানে কাত এই আশাতে সবাই এগোচ্ছি।
লাউচাপরা ইকো পার্কের ওয়াচ টাওয়ারে জিপিএস রিডিং
ইকো পার্কের টিউবওয়েলের পানিতে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার সেরে আবার রওনা দেয়ার সিধান্ত হল, কেউবা আবার গোসল সেরে নিতে চাইল। আমি এই সুযোগে একটু বিশ্রামের আশায় একটা বেঞ্চিতে গা হেলিয়ে দিলাম। সারা রাত ঘুমাইনি তাই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি, ঘণ্টাখানেকের একটা ভাল ঘুম হল। এরই মধ্যে অন্যরা ফ্রেশ হয়ে আমাকে ডাকাডাকি শুরু করল। আমিও উঠে টিউবওয়েলের পানিতে গোসল সেরে নিলাম। কিযে আরাম লাগছিলো তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মনে হচ্ছিল আরেকটা ঘুম দিয়ে ইকো পার্কে সারাদিন কাটিয়ে দেই। পাউরূটি, ডিমসিদ্ধ, মেউনেস ও টমেটোসস দিয়ে সেন্ডউইছ বানিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম সবাই। স্থানীও গ্রামবাসী বেশ কৌতুহল নিয়ে আমাদের কার্যকলাপ দেখছিল। অনেকে জানতে চাইল পিঠে বোজা (ব্যাকপেক) নিয়ে কোথা থেকে এসেছি কোথায় যাব। কামালপুর বাজার থেকে হেঁটে এসেছি, গাজনি পর্যন্ত হেঁটে যাব শুনে কয়েকজন অবাকও হল। জানাল গাজনি মেলা দূর আমরা কোন ভ্যান নিয়ে আসলে ভাল করতাম। এর আগে আমাদের মত কোন শহরের পাগলদের এই পথে হাঁটতে দেখে নাই। ভালই লাগছিলো তাদের কথাগুলো শুনতে।
ইকো পার্কের ওয়াচ টাওয়ার থেকে ভারতের পাহাড় দেখা
লাউচাপরার বনাঞ্চল
জানতে পারলাম যে আমাদের যাত্রা পথে সামনে একটা বাজার পরবে যার নাম শয়তান বাজার। বাজারের পরেই নদী, পায়ে হেঁটেই পাড় হতে হবে প্রায় হাঁটু পরিমান পানি নদীতে। জানতে চাইলাম এই বাজারের নাম শয়তান বাজার কিভাবে হল বা কেন হল? কিন্তু কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর পেলাম না। তাদের কাছে আশেপাশে দেখারমত জায়গা সম্বন্ধে জানতে চাইলাম। দুরদুরানি নামে এক গ্রামের কথা জানাল, সেখানে নাকি একটা বড় গাছের নিচ থেকে অলৌকিকভাবে সারা বৎসর পানি বের হয়, এবং এই পানি গরমের সময় ঠাণ্ডা ও শীতের সময় গরম থেকে, লোকজন এই পানি নিয়ে পবিত্র পানি হিসাবে ব্যাবহার করে। আশেপাশের কয়েকশ একর জমির সেচের কাজ এই পানিতে হয়, এখানে কখনও কোন ডীপ টিউবওয়েল বা কোন পাম্পের প্রয়োজন হয় না। ঐ গাছের পাশেই একটি খুব পুরান কবর আছে, কার কবর তা তারা বলতে পারে না। তবে তাদের বিশ্বাস এটা কোন কামেল লোকের কবর এবং এই কবরের কারনেই সেখান থেকে অলৌকিকভাবে সারা বৎসর পানি বের হয়। দূরদূরান্ত থেকে এমনকি ঢাকা থেকেও লোকজন যেয়ে কবর জিয়ারত করে, মানত করে, সেই পানি নিয়ে যায়। মানত (ইচ্ছা) পূরণ হলে সেখানে দান খয়রাত করে, শিরণী দেয়। সবশুনে যাওয়ার কৌতুহল হল।
দূরদুরানির পথে
দূরদুরানিতে শিরণীর খিচুড়ি বিতরণ
গোসল, খাওয়া দাওয়া ও গল্পগুজব করে প্রায় ঘণ্টাদেড়েক পার হয়ে গেল। ইকো পার্কটি একটু ঘুরে দেখে, সবশেষে ওয়াচ টাওয়ারে উঠে চতুর দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। দূরে ভারতের পাহাড়গুলো দেখে আফসোস হচ্ছিল, পাহাড়গুলো কেন বাংলাদেশে পড়লনা। জিপিএসে ওয়াচ টাওয়ারটি মার্ক করে কিছু ছবি তুলে ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে রওনা দিলাম দূরদুরানির পথে, মিনিট ত্রিশের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। পৌঁছে দেখা গেল কোন একজন মানতকারির মানতের শিরণী অর্থাৎ খিচুড়ি বিতরণ হচ্ছে, নুতন অতিথি হিসাবে আমাদেরও আপ্যায়ন করা হল। শিরণীর খিচুড়ি বলে নয়, খিচুড়িটা আসলেই খুবই মজা হয়েছিল। যাইহোক সেখানে কিছুক্ষণ থেকে আবার পা বাড়ালাম।
শয়তান বাজারের পথে
শয়তান বাজারের পথে
প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে আমরা পৌঁছলাম শয়তান বাজার। সুন্দর একটা নদীর পাশেই ছোট্ট সুন্দর এই বাজারটির নাম কেন শয়তান বাজার হল তার কোন কারণই খুঁজে পেলাম না। একটু বিশ্রামের জন্য একটা চায়ের হোটেলে বসলাম। খুব ছোট ভাঙ্গাচুরা হোটেল ঘরটি নদীর পাশেই বালির উপর তৈরি, একটা ছোট নড়বরে টেবিলের দুই দিকে দুইটা বেঞ্চিতে চাপাচাপি করে মোটামুটি চারজন বসা যায়। পাশের আরেকটা টেবিলে বড় থালাতে পিয়াজু, ছোলা বাজি ও সিঙ্গারা রাখা। আরেকটা কাঠের ভাঙা আলমিরাতে বড় দুইটা বোলে রসে ডুবানো লালচে রং এর এবং প্রায় মার্বেলের সাইজের মিষ্টি, এবং অন্য থালাতে পরোটা ও সবজি বাজি রাখা ছিল। চায়ের অর্ডার দিয়ে টেস্টের উদ্দেশ্যে একটা সিঙ্গারা নিয়ে খেতে আরম্ভ করলাম। অজপাড়া গাঁয়ে এই রকম ভাঙ্গাচুরা দোকানে এত মজার সিঙ্গারা হয়, না খেলে বিশ্বাস করবেন না। অন্যদেরও খাওয়ার জন্য বললাম, কিন্তু তাদের মুখের চেহেরা দেখে মনে হল তারা মোটেও আগ্রহী নয়, বরং তারা অস্বস্তি বোধ করতেছে। একজনতো বলেই বসল যে হোটেলটা মোটেও হাইজেনিক না, খেলে নাকি পেট খারাপ হবে। বললাম না খেলে পরে আফসোস করতে হবে। শুনে দুইজন দুইটা সিঙ্গারা নিয়ে খেতে আরম্ভ করল। খেতে খেতে ঐ দুইজন একই সাথে বলে উঠল না খেলে পরে আফসোস করতে হবে। এই শুনে তৃতীয়জন ও খাওয়া আরম্ভ করল। ঠিক কয়টা খেয়েছি মনে নাই তবে প্রত্যেকেই অন্তত ৪/৫ টা করে খেয়েছিলাম। মিস্তিগুলো কি মিষ্টি, কেমন মিষ্টি জানতে চাইলাম। বলল রসগোল্লা, খেতেও নাকি খুব ভাল কোন ভেজাল নাই। শুনে একটা দিতে বললাম। লালচে ছোট্ট মার্বেল সাইজের রসগোল্লা দেখতে সুন্দর না হলেও খেতে এতো মজা ছিল যে বলে বুজানো যাবে না। এখনও মনে হলে জিবে পানি আসে। একটা খেতে খেতে আরও দুইটা দিতে বললাম। অন্যদেরকে বললাম যে জীবনে যদি কেউ বড় কোন মিস্ করতে না চায় তাহলে যেন এই মিষ্টিটা একটা হলেও খেয়ে দেখে। সবাই আমরা প্রায় ৪/৫ টা করে মিষ্টি খেলাম। যতটুকু মনে পড়ে সেইদিন ঐ হোটেলে চারজনের চা, সিঙ্গারা এবং মিষ্টির জন্য প্রায় দুইশ টাকা বিল দিয়েছিলাম। মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে জীবনে একবার হলেও এই শয়তান বাজারে আবার আসব অন্তত এই হোটেলে সিঙ্গারা ও রসগোল্লা খাওয়ার জন্য। খাওয়া দাওয়া শেষ করে শয়তান বাজারকে বিদায় জানিয়ে আবার রওনা হলাম।
পাকা ধান নিয়ে কৃষকের ঘরে ফেরা
অস্তগামী সূর্যের সোনালি আভায় মেঘাদলের বনাঞ্চল
তখন প্রায় বিকেল, আমরা হাঁটু পানির নদী পার হয়ে মেঘাদল পৌঁছলাম। নদী পার হতেই আছরের আজান ভেসে আসছে। নদীর পারে মেঘাদলের মসজিদে হাসনুল ভাই নামাজ পড়ে নিতে চাইলেন। ওনার নামাজের সময়টাতে আমরাও পাশের স্কুলের মাঠে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার রওনা হলাম। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আলোয় তখন সমস্ত প্রকৃতি লাল হয়ে আসছিল, স্থানীয় কৃষকেরা পাঁকা ধান কেটে ঘরে ফিরছে, আমরাও সামনের দিকে পা বারিয়েছি। দূরের লালচে সবুজ পাহাড় টিলার পাশে সোনালি ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে লালাভ মেঠো পথে অপূর্ব কিছু মুহূর্তকে সৃতিতে ধরে রাখবার জন্য ক্যামেরাটাকে হাতে নিয়ে এগুচ্ছিলাম। এরই মধ্যে কয়েকজন স্থানীয় কৃষকের সাথে দেখা, আমরা কোথায় যাচ্ছি জানতে চেয়ে বলল সামনে বিপদ, না আগানটাই ভাল হবে। জানালো যে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে হাতি নামতেছে, হাতির সামনে পরলে মহাবিপদ। আরও জানালো যে সামনে ৪/৫ কিমি এর মধ্যে বন জঙ্গল ছাড়া কোন ঘর বাড়ি বা লোকালয় নাই। তাই আমরা যেন পিছনের গ্রামে থেকে যাই, আর তা না হলে খুব দ্রুত এগিয়ে যেতে। শুনে সবাই একটু আঁতকে উঠল, ক্যামেরাটা হাতে নিয়েও ছবি তোলার তেমন কোন সুযোগ পেলাম না, সবার তাড়া খেয়ে রীতিমতো দৌড়ের উপরেই এগুতে হচ্ছে। অন্ধকার নেমে এসেছে সাথে সাথে নিস্তব্ধতা, নিজেদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আঁকাবাঁকা পথে চোখ, কান সজাক অবস্থায় খুব দ্রুত এগুতে হচ্ছে, মাঝে মাঝে একটু টর্চ মেরে পথটা ও আশেপাশের জঙ্গলটা একটু দেখে নিচ্ছি।
সোমেশ্বরই নদী, বালিঝুরি
এইভাবে প্রায় ঘণ্টাদেড়েক হেঁটে আমরা একটা গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছি, দূরে গ্রামের ঘর বাড়ির মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে, মাঝ পথে একটা কালভারটের উপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আস্তে আস্তে গ্রামে ঢুকলাম। ঢুকতেই গ্রামের বাজার, বাজারে একটি ছোট চায়ের হোটেলে আমরা বসলাম। হাসানুল ভাই মাগরিবের নামাজের জন্য পাশেই বাজারের মসজিদে গেলেন। চা খেতে খেতে গ্রামবাসীর সাথে কুশল বিনিময় হোল। জানতে পারলাম গ্রামটির নাম বালিঝুরি। এর পরে সোমেশ্বরই নদী, নদীর পরের গ্রাম তাওয়াকোঁচা, এরপর দুধনাই, এরপর ছোট গাজনি এবং এরপর বড় গাজনি। এই বড় গাজনিতেই গাজনি অবকাশ কেন্দ্র, সব মিলিয়ে প্রায় ৮/১০ কিমি পথ হবে। আশা করা যায় দুই আড়াই ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছাতে পারবো। ট্রেকিংয়ের এই প্রথম রাতটা গাজনি অবকাশে বা তার আশেপাশে কোথাও কাটানোর ইচ্ছা। সবাই চা খেয়ে উঠে রওনা দিতেই হোটেলে থাকা জনৈক একজন জানতে চাইলেন আমরা কোথায় যাব, ওনাকে জানালাম যে আজ বড় গাজনি পর্যন্ত যেয়ে রাতটা গাজনিতে কাটাতে চাই। তিনি সামনে হাতির আক্রমণের বিপদের কথা স্মরন করিয়ে বিনয়ের সাথে আমাদেরকে ওনার অতিথি হয়ে ওনার বাড়িতে থাকার অনুরোধ করলেন। আলাপে জানতে পারলাম উনি বালিঝুরি এলাকার মেম্বার সোহরাব সাহেব। বিপদের আশঙ্খা দেখে রাজি হলাম ওনার অতিথি হয়ে থাকতে, তবে ওনার বাড়িতে না থেকে খোলা কোন মাঠে তাঁবু খাঁটিয়ে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। কিন্তু সেটাতেও তিনি অসম্মতি জানিয়ে মুক্ত স্থানে থাকা মোটেও নিরাপদ নয় জানালেন। উপায়ান্তর না দেখে অন্য কোথাও অর্থাৎ কোন স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা থাকার ব্যাবস্থা করে দিতে অনুরোধ করলাম। তিনি এলাকার হাই স্কুলের বিল্ডিংয়ের ক্লাসরুমে থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন।
তাওয়াকোঁচার পথে
অনেকক্ষণ উনার সাথে খোলামেলা আলাপ হোল, যদিও প্রথমে আমাদের সাংবাদিক ভেবেছিলেন। আলাপ প্রসঙ্গে তিনি বিভিন্ন সময়ে হাতির অত্যাচারের বিভিন্ন ঘটনা আমাদের সাথে শেয়ার করলেন। অনুরোধ করলেন যদি সম্ভব হয় তাহলে যেন আমরা এই বিষয়টি কোন ম্যাধ্যম বা মিডিয়াতে তুলে ধরার চেষ্টা করি। দুঃখজনক হোল যে ভারতের এই হাতিগুলো ভারতের পাহাড় জঙ্গল ছেড়ে খাদ্যের সন্ধানে আমাদের দেশে প্রবেশ করে এবং এই দেশের সাধারণ কৃষকের ঘর বাড়ি ও জমির ফসল নষ্ট করে। সাধারনত ধান পাঁকার মৌসূমে এই হাতিগুলো বেশী আসে। এবং এরা দলগতভাবে এসে আক্রমন চালায়, এক এক দলে প্রায় ৭০/ ৮০টি হাতি থাকে, অনেক সময়ে এরা দলে ১০০ থেকে ১৫০ টিও হয়ে থাকে। স্থানীয় গ্রামবাসী মানবিক কারন ছাড়াও আইনগত কারনে এইগুলোর কোন ক্ষতি করতে পারে না। শুধু এইগুলোকে ভয়ভীতি দেখানোর জন্য দূর থেকে মশাল জ্বালিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে তাড়া করে। এইজন্য প্রচুর পরিমানে কেরোসিন তেলের প্রয়োজন হয়। সরকারীভাবে তেলের বরাদ্ধ থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য, তাও আবার ঠিকমতো পাওয়া যায় না। কোন সরকার কখনও স্থায়ীভাবে এর প্রতিকারের জন্য সীমান্ত এলাকায় কোন পদক্ষেপ নেয়নি, যদিও সব সরকারেরই স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচনের পূর্বে গ্রামবাসীকে নানা রকম আশার বাণী শুনিয়ে থাকেন। স্থানীয় গ্রামবাসী বাঁচার তাগিতে ও নিজেদের আত্মরক্ষার স্বার্থে যতটুকু সম্ভব এই অত্যাচারকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে।
দুধনাইএর পথে
আলাপে আলাপে অনেক সময় পেড়িয়ে গেল রাতের খাওয়ার সময় হয়ে আসছে, সোহরাব ভাই তাঁর বাড়িতে আমাদের খাওয়ার অনূরোধ করলেন, আমরা ঝামেলা না করে কোথাও একটু রান্নার ব্যাবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করতেই হোটেল মালিক তাঁর হোটেলের চূলা এবং একটি কড়াই আমাদের ব্যাবহারের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন। মাটির চূলায় বিরাট সাইজের একটি কড়াইয়ে (যাতে কিনা ১৫/ ২০ জনের রান্না হয়) আমাদের রান্নার ব্যাবস্থা হলো। স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচা মরিচ ও কয়েকটা পিঁয়াজ কিনে নিজেরাই ইনস্ট্যান্ট নুডুলস রান্নার ব্যাবস্থা করতে লাগলাম। রান্নার কোন অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও অতি সহজে ইনস্ট্যান্ট নুডুলস রান্নার দায়ভারটা আমাকেই নিতে হোল। অজপাড়া গাঁয়ের বাজারের হোটেলে এইভাবে আমাদের রান্না করতে দেখে অনেকেই আমাদের কৌতূহল ভরে পর্যবেক্ষণ করছিল, বিশেষ করে হোটেল মালিকের ৯/১০ বৎসর বয়সী ছেলেটির সেই কৌতূহলি চোখ দুটু। যা কিনা হয়ত মনে করছিল যে আমরা বিশ্বের অন্যতম কোন সুস্বাদু খাবার রান্না করছি। এতো বড় করাইতে ৪ জনের রান্না করতে যেয়ে অনুমান সঠিক না হওয়ায় ও অতিরিক্ত পানির জন্য সেটা নুডুলস রান্নার পরিবর্তে নুডুলস স্যুপে পরিনত হোল। যাইহোক সেটাই আমরা বেশ তৃপ্তি সহকারে খেলাম, সাথে থাকা সোহরাব ভাই, হোটেল মালিক ও তাঁর ছেলেকে দেয়া হোল কিন্তু তাদের চেহারা দেখে মনে হোল না যে তারা এইটা পছন্দ করেছে।
পরদিন সকালে এই হোটেলে কোন নাস্তার ব্যাবস্থা হবে কিনা জানতে চাইলে, হোটেল মালিক জানালো যে সকালের নাস্তায় পরদিন সকালে খিচুড়ি থাকবে। পরদিন সকালে তাঁর হোটেলে আমাদের নাস্তার ব্যাবস্থাটা পাকা করে সেই রাতের জন্য স্কুলের পথে পা বাড়ালাম। সাথে মেম্বার সোহরাব ভাই, স্কুলের দারোয়ান ও দপ্তরী এগিয়ে দিল। স্কুল ঘরে এসে সোহরাব ভাই দারোয়ান ও দপ্তরীকে দিয়ে ২/৩ টা বেঞ্চিকে একসাথে করে আমাদের চারজনের জন্য চারটা উঁচু সিঙ্গেল খাটের ব্যাবস্থা করে দিলেন। অতএব আমরা চারজন খুব আরামেই চারটা সিঙ্গেল খাটে ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিনের পরিস্রমের পর রাতে বেশ ভালই ঘুম হোল।
গাজনির পথে
রাতের অন্ধকারে স্কুলে ঢুকে ছিলাম তাই স্কুলটি লক্ষ্য করা হয়নি। সকালে স্কুলটি দেখে খুবই ভাল লাগল। স্কুল ঘরটির সামনে খেলার মাঠ ও তাঁর পাশেই নদী বয়ে চলেছে, দেখলে যে কেউই ও মুগ্ধ হবে। ফ্রেশ হয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম নাস্তার জন্য। পথিমধ্যে সোহরাব ভাইএর সাথে দেখা, ওনাকেও আমাদের সাথে নাস্তার আমন্ত্রন জানালাম, তিনি নাস্তা করে এসেছেন বলে জানালেন। হোটেলে খিচুড়ি নামক হলুদ রং এর ভাত খেলাম, খিচুড়ির কোন স্বাদ পেয়েছি বলে মনে পরে না। সোহরাব ভাই আমাদের এইগুলো খেতে দেখে জানালেন যে এই ভাত উনারা হাঁস মুরগিকে খাওয়ান পথ্য হিসাবে। সোহরাব ভাইকে নিয়ে চা খেয়ে নাস্তা শেষ করলাম। তিনি জানালেন যে গতরাতে নাকি হাতি উনাদের এলাকায় এসেছিল, এবং এখনও আছে তবে সীমান্তের কাছাকাছি। আমরা যদি দেড় দুই মাইল পশ্চিমে ফিরে যাই তাহলে দেখতে পারবো। সময়ের স্বল্পতার জন্য রাজি হলাম না, উনাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গাঁজনির পথে পা বাড়ালাম।
গাজনির পথে
শীতল ঝিরি, গাজনি
বালিঝুরির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী সোমেশ্বরি। নদী পার হয়ে পৌঁছলাম তাওয়াকোচা। দুই পাশে ঘন গজারি, সেগুন বিভিন্ন গাছের বন। বনের উঁচু উঁচু গাছের ফাঁক দিয়ে সকালের কোমল রোদ উকি দিচ্ছে। ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে এগোচ্ছি তাই হাটার গতি কম। বার বার অন্যদের থেকে পিছিয়ে পরচ্ছি। এইভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে একটা শুকনো ঝিরি পার হয়ে একজন গারো ব্রিদ্দের চায়ের দোকানে এসে পৌঁছলাম। চা খেতে খেতে জানলাম যে আমরা তাওয়াকোচা, দুধনাই পার হয়ে ছোট গাজনি অবস্থান করছি। অল্প কিছুটা আগালে একটা ঝিরি, যার নাম শীতল ঝিরি। সেটা পার হলেই বড় গাজনি পৌছাব। তারপর আরও কিছুটা আগালেই গাজনি ইকো পার্ক।
গাজনি
বন্য হাতি থেকে রক্ষার উপায়, গাজনি
চা খেয়ে আবার রওনা হলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা সেই সুন্দর শীতল ঝিরির কাছে এসে পৌঁছলাম। হাঁটু পানির অপূর্ব সুন্দর এই ঝিরিটি পায়ে হেঁটে পার হয়ে কিছুটা এগোতেই একটা চৌরাস্তা মোড় চোখে পড়ল। সোজা রাস্তা পূর্ব দিকে চলে গেছে রংটিয়ার দিকে, যা আমাদের পরবর্তী গন্তব্য, আর বাঁদিকে মোড় নিয়ে রাস্তা উত্তরে চলে গেছে গাজনি অবকাশের দিকে, এবং ডানে মোড় নিয়ে নুতন রাস্তা দক্ষিণে চলে গেছে ঝিনাইগাদির দিকে, এই রাস্তাটি তখন পাকা করার কাজ চলতেছিল। আমরা যথারীতি বাঁদিকে মোড় নিয়ে গাজনি অবকাশের দিকে রওনা হলাম। ২০/ ২৫ মিনিটের মধ্যে আমরা অবকাশ কেন্দ্রে পৌঁছে গেলাম। পিকনিকের সময় না হওয়ায় অবকাশ কেন্দ্রটি প্রায় ফাঁকা, স্থানীয় কয়েকজন গারো ছাড়া তেমন কেউকে চোখে পড়ল না। তখন প্রায় দুপুর ১২টা, ঠিক হোল সবাই গোসল করে বা ফ্রেশ হয়ে দিনের খাবার খেয়ে তারপর আবার রওনা দিব। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে অবকাশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকার ফোন নম্বর নিয়ে, তাঁর সাথে আলাপ করে কয়েক ঘণ্টার জন্য একটা রুমের ব্যাবস্থা করা হোল। একে একে সবাই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলো। এরই মধ্যে শহিদুল্লাহ তার নাক ডাকাডাকির শব্দে সবাইকে তার ঘুমের বার্তা জানিয়ে দিল। শহিদুল্লাহর এত ডাকাডাকির মধ্যেও হাসনুল ভাই
ঠিকই জোহরের নামাজ আদায় করে নিলেন এবং আলম মনে হয় কিছুটা রেহাই পাওয়ার জন্য নুডুলসের পেকেট নিয়ে রান্নার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। আমিও এই ফাকে গোসল সেরে নিলাম। শুধু পানিতে সিদ্ধ নুডুলস সস দিয়ে আমরা সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। খেয়েদেয়ে ইকো পার্কটি একটু ঘুরে দেখব বলে বেরিয়ে পড়লাম।
গাজনি অবকাশ কেন্দ্রের ম্যাপ
গাজনি অবকাশ কেন্দ্র
গাজনি অবকাশ কেন্দ্রের ওয়াচ টাওয়ার
গাজনি অবকাশ কেন্দ্রের ওয়াচ টাওয়ারে জিপিএস রিডিং
গাজনি অবকাশ কেন্দ্রের ওয়াচ টাওয়ার থেকে ভারতের পাহাড় দেখা
গাজনি অবকাশ কেন্দ্রের ওয়াচ টাওয়ার থেকে ভারতের পাহাড় দেখা
ওয়াচ টাওয়ারে উঠে চতুর দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। জিপিএসে ওয়াচ টাওয়ারটি মার্ক করে কিছু ছবি তুলে ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে এসে আশপাশটা একটু ঘুরে দেখে আবার রওনা হলাম রংটিয়ার উদ্দেশ্যে। ঘড়িতে তখন প্রায় তিনটা বাজে। দুই পাশে উঁচু উঁচু সেগুন, শাল গাছের বনের মাঝে দিয়ে উচুনিচু টিলার পাকা পথে আমরা হেঁটে চলেছি। প্রায় ঘণ্টা খানেক হেঁটে এক জায়গায় খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আবার রওনা হলাম। কিছুক্ষণের মধেই আমরা গান্ধিগাও থেকে একটা বেইলি ব্রিজ পার হয়ে নাওকুচি বা নকশি এসে পৌঁছলাম।
নাওকুচি বা নকশির পথে
নাওকুচি বা নকশির পথে
পাহাড়ি ঝিরি
আছরের আজান কানে ভেসে আসছে, আরও কিছু দূর এগিয়ে নকশি বিজিবি ক্যাম্পের এক সার্জেনের সাথে দেখা হোল। তিনি নামাজের জন্য মসজিদে যাচ্ছিলেন, আমাদের দেখে হাসিমুখে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন এবং আমাদের সমন্ধে জানতে চাইলেন। আমরাও নিজেদের পরিচয় দিয়ে, কামালপুর থেকে এই পর্যন্ত হেঁটে এসেছি এবং হালুয়াঘাট পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। তিনিও আমাদের শুভ কামনা করে মসজিদে রওনা হলেন। হাসনুল ভাই নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে বিজিবি ক্যাম্পের পাশের পুকুর ঘাটে অজুর জন্য গেলেন। পথিমধ্যে আরও ৩/৪ জন বিজিবি কর্মকর্তা আমাদেরকে একই প্রশ্ন করলেন, এবং সবাইকে একই উত্তর দিয়ে আমরা বাধানো পুকুর ঘাটে হাসনুল ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। নামাজ শেষ হতেই ৮/১০ মসজিদ থেকে বেরিয়ে আমাদের ঘিরে দাঁড়ালেন এবং একজন আমাদের লক্ষ্য করে বললেন যে ‘এই যে স্যার উনারা’। কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন গম্ভীর স্মরে জিজ্ঞাস করলেন, ‘আপনারা কে, কোথা থেকে এসেছেন, এখানে কোথায় এসেছি, কার কাছে এসেছি’ ইত্যাদি। কিছুটা বিরক্তির সাথেই উত্তর দিয়ে পাল্টা জানতে চাইলাম যে এত জেরা করার কারন কি? আমাদের কি সন্দেহজনক মনে হয় কিনা? তিনি জানতে চাইলেন কেন বিরক্ত হচ্ছি। বললাম যে তাঁদের ক্যাম্প থেকে পুকুর ঘাট পর্যন্ত আসতে আসতে অন্তত ৭/৮ জনকে এই একই প্রস্নের উত্তর দিয়েছি। এতবার উত্তর দেয়াটাকি বিরক্তিকর নয়। সেলফোনটা হাতে নিয়ে বললাম ‘যদি আমাদেরকে সন্দেহ হয় তাহলে বলেন, আমি এখনই আর্মির কর্নেল বা মেজরকে ফোন দেই আপনি তাঁর কাছ থেকে আমার পরিচয়টা জেনে নিন’। শুনে মনে হোল তারা একটু চুপসে গেলেন, আরেকজন বললেন তিনি আমাদের কমান্ডার স্যর, আপনাদের এলাকায় নুতন দেখে আপনাদের সম্বন্ধে জানতে চাইছেন। এরই মধ্যে হাসনুল এসে হাজির, তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আবার কমান্ডারকে বললেন। এইবার কমান্ডার সাহেব আর কোন কথা না বাড়িয়ে আমাদের কাছ থেকে তাঁর লোকজন নিয়ে বিদায় নিলেন। আমরাও রংটিয়ার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।
রংটিয়ার পথে
সোনালি ধান, রংটিয়ার পথে
তখন প্রায় পরন্ত বিকেল, অস্তগামি সূর্যের লাল আলোতে পাকা ধানের জমিগুলো সব বিস্তীর্ণ সোনালি এলাকায় রুপান্তরিত হয়েছে। ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না, কয়েক মিনিটের জন্য দাড়িয়ে প্রকৃতিকে ক্যামেরা বন্দী করার চেষ্টা করলাম আর আস্তে আস্তে এগুতে থাকলাম। রংটিয়া পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো, কিছুক্ষণের জন্য চায়ের বিরতি নিয়ে আবার চলতে আরম্ভ করলাম। অন্ধকার নেমে এলো, মাঝে মাঝে টর্চের আলো মেরে মেরে এগুতে থাকলাম। এইভাবে হেঁটে হেঁটে একসময় একটা ব্রিজের উপরে এসে দাঁড়ালাম, জিপিএসে দেখলাম ব্রিজটা মরিসা নদীর ব্রিজ। কখন সন্ধ্যাকুরা পেড়িয়ে এসেছি বুজতে পারিনি, জিপিএসের ঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা বাজে। দেরি না করে আবার সামনের দিকে পা বাড়ালাম, উদ্দেশ্য মধুটিলা পৌঁছান, আর মধুটিলা না হয় অন্তত সমাসচুরা পর্যন্ত পৌঁছান। ঘণ্টাখানেক অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে একসময় কিছুটা আলোর কাছাকাছি আসলাম, বুজলাম কোন গ্রাম বা লোকালয়ের কাছে এসেছি। একটু সামনে এগুতেই একটা বাজার চোখে পরল। একটা চায়ের হোটেলে বসে জানলাম যে আমরা সমাসচুরা বাজারে এসে পৌঁছেছি। হোটেলে বসে থাকা কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠর সাথে আলাপ ও পরিচয় হোল। ভাগ্যক্রমে সমাসচুরার মেম্বার মুসলিম সাহেবের সাথেও আলাপ হয়ে গেল সেখানে। আলাপ প্রসঙ্গে উনাকে জানালাম যে, আমরা কামালপুর থেকে এই পর্যন্ত হেঁটে এসেছি এবং হালুয়াঘাট পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছে আছে। ওনাকে আরও জানালাম যে আজ মধুটিলা পর্যন্ত যেয়ে রাতটা মধুটিলা কাটাতে চাই। কিন্তু তিনি সামনে হাতির আক্রমণের বিপদের কথা স্মরন করিয়ে আমাদেরকে না আগানোর পরামর্শ দিলেন। বিপদের আশঙ্খা দেখে সিধান্ত নিলাম না আগানোর এবং আগের রাতের বালিঝুরি স্কুলে থাকার বর্ণনা জানিয়ে সমাসচুরার মেম্বার সাহেবকে অনুরোধ করলাম আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। তিনিও বাজারের পাশেই সমাসচুরা স্কুলে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন। হোটেলে বিস্কুট, কলা ও চা খাওয়াতে কেউই আর রাতের খাবারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাল না। সবাই স্কুল ঘরে যেয়ে তারাতারি শুয়ে পড়লাম।
সমাসচুরা স্কুল
সমাসচুরা বাজার
মধুটিলার পথে
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, পাশেই বাজারের হোটেলে বিস্কুট ও চা খেয়ে মধুটিলার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে প্রায় সাড়ে আঁটটা বেজে গেল। আধা ঘণ্টার মধ্যেই আমরা ইকো পার্কের কাছাকাছি চলে আসলাম। ইকো পার্কের সামনের পথে না যেয়ে জিপিএস ধরে পিছনের পথে আগানোর সিধান্ত নিলাম। সিধান্ত অনুযায়ী কিছু দূর এগুতেই একজন বিজিবির কর্মীর সাথে দেখা। তিনি আমাদের ঐ পথে ডাকাতির আশঙ্কা কথা জানিয়ে সতর্ক করলেন এবং ঘুরে ইকো পার্কের সামনের পথে যেতে পরামর্শ দিলেন। মাঝে মাঝেই নাকি দিনে দুপুরে ঐ পথে ডাকাতি হয়। বিষয়টাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে তাকে বিদায় জানিয়ে আমরা সেই পথেই এগুতে থাকলাম। সুন্দর মেঠো পথের দুই পাশের টিলার ঢালে বন জঙ্গল পার হয়ে আমরা ইকো পার্কের অন্য প্রান্তে এসে পৌঁছলাম। আরও কিছুটা এগিয়ে আমরা ইকো পার্কের পিছনের পথ দিয়ে পার্কের প্রবেশ করলাম। ঢুকতেই হাতির বিস্টা (গোবর) চোখে পড়ল। দেখে খুব একটা পুরনো মনে হোল না, মনে হোল আগের রাতেই হাতি এই পথে পদচারনা করেছে। ব্যাপারটা আরও পরিস্কার হোল যখন কিছুটা সামনে এগিয়ে হাতির পায়ের ছাপ দেখতে পালাম। সবাই একটু আতকে উঠল, যদি সামনে হাতি পড়ে। তাই কিছুটা সতর্ক ভাবে সবাই একসাথে এগোচ্ছি। অনেকটুকু এগিয়ে একটা টিলার উপরে উঠে আমরা ইকো পার্কের ওয়াচ টাওয়ারের দেখা পেলাম। টাওয়ারের কাছেই টাওয়ারের টিকেটার বসা ছিল সাথে আরেকজন ঝালমুরি ও শসা বিক্রেতা। টাওয়ার পরিদর্শনের টিকেটের মূল্য ৫ টাকা, কিন্তু আমরা কামালপুর থেকে হেঁটে এসেছি শুনে টিকেটার আমাদের টিকেটের মূল্য নিতে রাজি হোল না বরং বলল যে ‘আমাদের টিকেট কাটলে নাকি অপমান করা হবে’। আমাদের সম্মান দেখিয়ে সে বিনা টিকেটে টাওয়ারে উঠতে বলল। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে জিপিএসে টাওয়ারটি মার্ক করে কিছু ছবি তুলে ও চতুর দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। দূরে ভারতের পাহাড়গুলো ও সাথে বিএসেফের ওয়াচ টাওয়ার দেখা যাচ্ছিল। টাওয়ার থেকে নেমে টিকেটার ভাইকে সাথে নিয়ে ঝালমুরিওয়ালা থেকে ঝালমুরি ও শসা খেয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে ইকো পার্কটা ঘুরে দেখার জন্য পা বাড়ালাম। পার্কের ভিতরে ঘুরাঘুরি শেষ করে পার্কের প্রধান গেইট
দিয়ে বেরুতেই হোটেল চোখে পড়ল। সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার একসাথে খাওয়ার জন্য হোটেলে ঠুকেই খাবার অর্ডার দিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তা নিয়ে আলোচনায় বসলাম।
মধুটিলার পথে
মধুটিলা ইকো পার্কের ওয়াচ টাওয়ার
মধুটিলা ইকো পার্কের ওয়াচ টাওয়ারে জিপিএস রিডিং
মধুটিলা ইকো পার্কের ওয়াচ টাওয়ার থেকে ভারতের পাহাড় দেখা
মধুটিলা ইকো পার্কের ওয়াচ টাওয়ার থেকে ভারতের পাহাড় দেখা
ওয়াচ টাওয়ার সামনে ঝালমুরিওয়ালা
খেতে খেতে ঠিক করলাম যে হালুয়াঘাট না যেয়ে মধুটিলা থেকে ঢাকা ফিরে আসবো। মধুটিলা থেকে হালুয়াঘাটের দূরত্ব প্রায় ২৫/ ৩০ কিমি, কিন্তু আমাদের হাতে সময় মাত্র অর্ধেক বেলা। হালুয়াঘাট পৌছাতে কমপক্ষে আরও একদিন দরকার, তাছাড়া পরদিন সবাইকে অফিস করতে হবে। তাই হালুয়াঘাট না যাওয়ার আফসোস নিয়েই ঢাকা ফেরত আসতে হচ্ছে। হোটেল মালিকের কাছে জানতে চাইলাম, ওখান থেকে কিভাবে দ্রুত নালিতাবাড়ি যেতে পারি। বিভিন্ন উপায়ের কথা জানিয়ে বলল যে কাছেই একটা টেম্পো/ বডবডি দাঁড়ানো আছে আমরা রিজার্ভ যেতে চাইলে সেটাতে আলাপ করে দেখা যেতে পারে। হোটেল মালিক আলাপ করে এসে জানালো যে সে যেতে রাজী হয়েছে তবে ২৫০ টাকা দিতে হবে। আমরাও তারাতারি খাওয়া দাওয়া শেষ করে টেম্পোতে চরে বসলাম। প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে টেম্পোটি নুন্নি হয়ে আমাদের নালিতাবাড়ির বাস টার্মিনালে পৌঁছে দিল। বাসের টিকেট কেটেই নালিতাবাড়ি বাজারে একটু ঘুরে এসে বাসে চেপে বসলাম। এই সুন্দর ট্রেইলটি আগামীতে আবার হালুয়াঘাট পর্যন্ত করার আশা নিয়ে সেই রাতেই ঢাকা ফেরত আসলাম।
হাতির বিস্টা (গোবর)
হাতির আক্রমনের শিকার
মধুটিলা ইকো পার্কের প্রধান গেট
মধুটিলা ইকো পার্কের স্টার ব্রিজ
গুগোল আর্থে জিপিএস ট্রেইল
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫৪