এই ছবিগুলি "রূপক" নামক এক কিশোরের ইন্সটাগ্রাম একাউন্ট থেকে নেওয়া। ৩য় ছবিটি তার বোনদের। ইন্সটাগ্রামে সাজেশন দেখাচ্ছিল বলে একটু ঢুকে দেখলাম। কারণ, ফেসবুকে বাচ্চাটাকে ব্লক করেছি কয়েক ঘন্টা আগেই। দেখতে চাইছিলাম তার ইন্সটাগ্রাম একটিভিটিও কি ফেসবুকের মত কিনা। দেখলাম, একই! অসম্ভব রূঢ়ভাষী, প্রতিটা কথায় ফাক ছাড়া কথাই বলে না; অশ্লীল পোস্ট, অশ্লীল স্বলিখিত বা অন্যের কবিতা, অশ্লীল মিউজিক লিরিক্স, অশ্লীল অংগভংগি। সবচেয়ে বড় কথা, সে সমবয়সী ছাড়া গড়পরতা সবাইকেই ফেসবুক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছে, যাকেই কোন না কোন কারণে পছন্দ হচ্ছে। আমাকে সম্ভবত রেসলিং বা মার্ভেল/ডিসি প্ল্যাটফর্ম এর কোন পেইজ/গ্রুপ থেকে জেনেশুনে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। আমার অনেক সিনিয়র কাজিনদের বাচ্চা ওর সমবয়সী। তাই, ছেলেটাকে দেখে, গিটারসহ ছবি দেখে, মিউজিক লাভার ভেবে এড দিয়েছিলাম। শেষ স্ট্যাটাসে তার ভয়াবহ রকমের উদ্ধত ও অবাধ যৌনতা নির্দেশক পোস্ট দেখে তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, ফ্রেন্ড লিস্টে কয়েক ধরণের সাব-লিস্ট করতে, যাতে বন্ধু, আত্মীয়, কলিগ, সিনিয়র, জুনিয়র, পরিবার আলাদা আলাদাভাবে থাকে। তারপর, প্রত্যেক পোস্ট এর ধরণ অনুযায়ী প্রাইভেসি সেটিং এ ইচ্ছামত কোন গ্রুপকে বাদ দেওয়া যাবে, বা হাইলাইট করা যাবে। সে উত্তরে বলল, এটি তার পোস্ট, তার প্রোফাইল, সে যা ইচ্ছা করবে। আমি উত্তরে বললাম, বেয়াদবি হতে পারে, তাই তার ভালোর জন্যে বলেছিলাম। এরপর তার উত্তরের অপেক্ষা না করে তাকে ব্লক করার জন্য প্রোফাইলে গেলাম। ব্লক করার আগমুহূর্তে দেখলাম, সে ফেসবুকে তার নিকনেইম দিয়েছে- "বেয়াদব"!
আমার এই এতখানি বয়সে খুব দ্রুত বাংলাদেশে অনেক কিছু পরিবর্তন হতে দেখছি। সামাজিক ও নৈতিক দিক দিয়ে জাতীয় পরিবর্তনের হার ভয়াবহভাবে ঋণাত্মক। জগাখিচুড়ী মার্কা সংস্কৃতি, বা স্বার্থান্বেষী অর্থনীতি, কিংবা প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে এসব হচ্ছে কিনা সে ব্যাখায় যাবো না। আমি বলব, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা, প্রতিপালনের কথা। যে কেউ, যার যার অবস্থান, পেশা, দলীয় পরিচয়, সম্প্রদায় বা বংশকে প্রতিনিধিত্ব করার সময় আন্তরিকতা ও ভদ্রতার সাথে, বা সীমারেখার মধ্যে থেকে, সভ্যভাবে কিছু করার অভ্যাস উঠে যাচ্ছে। আস্তিক-নাস্তিক, আওয়ামীলীগ-বিএনপি, অমুসলিম-মুসলিম, এরকম আরো নানান জাতীয়, আঞ্চলিক বা সামাজিক ইস্যুতে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাইকে চারপাশে বিশ্রিভাবে ঝগড়া বিবাদ করতে দেখছি আমরা সবাই। দেখে বড় হচ্ছে ধনীর দুলাল, বস্তির চেংড়া ছেলে, বা ঝামেলা থেকে পালিয়ে বাঁচা মধ্যবিত্তের বর্ণচোরা কিশোরটা!
গতকাল রাস্তায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ফুটপাতের পাশে থাকা দোকানের সামনে ৪ বছরের ছেলেকে হাতে ধরে দাঁড়িয়ে বাবা সিগারেট কিনলেন আর ফুঁকতে শুরু করলেন। ছেলে চকলেট খেতে চাইল, তার বাবা হ্যাচকা টানে ছাগলের মত তাকে টেনে নিয়ে হাটা শুরু করে দিল। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি, সাথে সিগারেটের ধোঁয়া। ঘটনাটি প্রতীকী। এভাবেই আপনার ছোট ছোট চিন্তা, কথা, আচরণ বা কাজের মধ্যে দিয়ে আপনি প্রতিনিয়ত অনভিজ্ঞ, অনভ্যস্ত বা নতুন কারো ভিতরে খারাপ বা ভালো কিছু ইনজেক্ট করে দিচ্ছেন।
ভুল শিক্ষা বা অশিক্ষা আচরণে বৈকল্য বা বিকৃতি আনতে পারে, সেটা আমাদের অনেকের বিবেকে ধরে। কিন্তু, উচ্চশিক্ষা বা শুদ্ধ পরিবেশও অনেক সময় মানুষের চিন্তা ও আচরণের বিকলাঙ্গতা ঠেকাতে পারে না। ব্যক্তিগত একটি উদাহরণ দিই। বিদেশী ভার্সিটিতে মাস্টার্সের জন্য ভর্তি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরের ধাপ হল, সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসা পাওয়া। আবার, ভিসা পাওয়ার অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত হল, ভার্সিটির নিজের ছাত্রাবাসে বা ক্যাম্পাসের বাইরে কোথাও থাকার অনুমতিপত্র প্রাপ্তি। কয়েক বছর আগে, ফ্লোরিডার একটি নামকরা ভার্সিটিতে মাস্টার্সে সামান্য স্কলারশিপ সহ ভর্তি অফার পেয়েছিলাম। ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ওয়েবসাইট ছাড়া এখনকার সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের মাধ্যম হল ফেসবুক। তাই, খুঁজে খুঁজে ওই ভার্সিটির বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হই। বিভিন্ন প্রয়োজনে সরলভাবে বোকার মত প্রশ্ন করতে থাকি। নতুন দেশ, নতুন জীবন, ভিন্ন সমাজ, তারচেয়ে বড় কথা দেশ থেকে এতগুলি টাকা নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ও বোঝা। ভেবেছিলাম, বিদেশের ভালো ভার্সিটিতে পড়া, ভালো পরিবার থেকে আসা, পিএইচডি/পোস্টডক এর মত ভারীক্কি ডিগ্রী অর্জনরত মানুষগুলি স্বদেশীদের যথাসাধ্য সংযতভাবে পরামর্শ দিবে, সাধ্যমত সাহায্য করবে। আর, যাই হোক মৌখিকভাবে, একজোট বেধে পরাস্ত বা পর্যুদস্ত করবে না। কিন্তু, তা হয়নি। থাকার জায়গা খোঁজা নিয়ে আমার এক পোস্টের পরে আমাকে ভুল বুঝে মারাত্মক অপমানিত করা হয়েছিল। নিজেকে সেদিন খুব নীচ ও অসহায় মনে হয়েছিল। এরকম না যে, ওই গ্রুপের সবাই ওরকম ছিল। গুটিকয়েক অসভ্য ও উদ্ধতদের বাদ দিলে বাকিরা নীরব দর্শক, কেউ বা ব্যস্ত, কেউ ভীতু- আমাকে সমর্থন করে নিজের বিপক্ষ ভারী করতে চায় না। পরবর্তীতে আরো কিছু কারণে আমার ভিসা পাওয়া হয়নি। ফেসবুকে কয়েক সপ্তাহের পরিচিত এক আন্তরিক সিনিয়র ভাইয়ের তার নিজ ঘরে আমার থাকার বন্দবস্ত এর মৌখিক ওয়াদা আমলে নেয়নি মার্কিন এম্বেসির ভিসা অফিসারেরা।
মাত্র কয়দিন আগে এই ঘটনার প্রায় পুনরাবৃত্তি হল। এবারের ঘটনাস্থল হায়ারস্টাডিএব্রোড নরওয়ে চাপ্টার নামের ফেসবুক গ্রুপ। বাংলাদেশের বিদেশে উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত প্ল্যাটফর্মগুলির সবচেয়ে বিশাল ও ঈর্ষনীয় এই প্ল্যাটফর্ম এর নরওয়ের জন্য বিশেষভাবে চালু হওয়া এই গ্রুপ। গ্রুপে আবারো হাউজিং সম্পর্কিত একটি পোস্ট এর জের ধরে ভলান্টিয়ার ও কন্ট্রিবিউটারেরা একে একে আক্রমণাত্মক ও মানহানিকর মন্তব্য দিতে থাকে। ব্লক করেও তাদের থামানো যায়নি। আমাকে শেষ পর্যন্ত গ্রুপ ত্যাগ করতে হয়েছে। "বাঙালীদের এজন্য সাহায্য করতে নাই।", "এটা কি বাংলাদেশ পেয়েছে নাকি?", "এটা দুবাই/মালেশিয়া না যে- পাচার হওয়া যাবে!" এরকম বেশ কিছু মন্তব্য শুনে স্তম্ভিত যেমন হয়েছি, তেমনি তাদের জন্য আফসোস হয়েছে এই ভেবে- তারা সঠিক পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায়নি; শুধু টাকার গরম, আর ডিগ্রির গরমই বুঝেছে। নিজে সিড়ি বেয়ে উঠে উপর থেকে অন্যদের লাথি দেওয়া শিখেছে, টেনে তোলা শিখেনি। একটি চরম উদাসীন, বেয়াদব, স্বার্থপর, নির্লজ্জ আর উজবুক প্রজন্মের সদস্য এরা। মে দিবসের মাহাত্ম্য ও এরা কখনো বুঝবে না। এরা কেন? দেশের নেতারাই বুঝেনি। দুবাই/মালেশিয়ার মত দেশগুলিতে থাকা লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবি ও স্বল্পআয়ের মানুষের হাড়ভাংগা পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আয়ের যে অংশ দেশে তারা পরিবারের জন্য ফেরত পাঠায়, সেগুলির সম্মিলিত পরিমাণের উপর দাঁড়িয়েই আজ উন্নত দেশের পথে বাংলাদেশ! আমি ৩ রুমের এপার্টমেন্টের অন্যদুটি রুমে থাকার জন্য পৃথক দুজনকে খুঁজেছিলাম বলে আমাকে ঘৃণ্যভাবে অবজ্ঞা করে বলা হয়েছিল, "বাংলাদেশের মত এখানে এক রুমে একাধিক মানুষ থাকে না; সাবলেট থাকে না!" তারা কি জানে, তারা ইউরোপে গিয়ে নামী ব্র্যান্ডগুলির যে পোশাক কিনে গর্ব করছে, সেই পোশাক বাংলাদেশের ইপিজেডের কোন এক শ্রমিকের হাতে তৈরি, যে তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটা রুমে থাকে! তারা কি জানে, বিদেশে উড়াল দেওয়ার আগে তারা ঢাকার নামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে যে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেত, সেই খাবারের যোগানদাতা আলুচাষীরা বছরের ৩ মাস বর্ষণস্নাত খোলা আকাশের নিচে ব্রিজের উপর বাস করে? না, তারা জানে না, জানলেও পাত্তা দেয়না। তাদের পূর্বসূরি ও তাদের মত মানুষের জন্যই দেশটা আজ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে "ফুটোয় ভরা নৌকা"!
আমি চরম হতাশ এই জাতিকে নিয়ে। কারণ, আশা দেখতে গেলেই মধ্যাংগুলি দেখানো "ফাক ইউ" বলা রূপকদের প্রতিচ্ছবি সামনে ভেসে উঠে!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৮ রাত ১:৩১