
কমলার বনবাস জনপ্রিয় লোক কাহিনী। এই নামের যাত্রাপালা ও মুভি আছে। হুমায়ুন আহমেদ তার ঘেঁটুপুত্রের নাম কেন কমলা রাখলেন তা জানার উপায় নাই। কিন্তু এই কমলাটা নিছক নামই নয়- বরং কমলার সাথে বনবাসের কথাই কেন জানি মনে করিয়ে দেয়। যে তিনমাস হাওরে পানি থাকবে- সেই তিনমাস জহির (মামুন) কমলা সেজে জমিদারের (তারিক আনাম খান) মনোরঞ্জন করবে। আক্ষরিক অর্থে এই তিনমাস জহির কমলা হয়ে বনবাস করে। এই বনবাসের শুরু বা শেষে রোমান্টিক কিছু নেই। এখানে কমলা শিকার জমিদার শিকারী। তবে টাকার বিনিময়ে। সব নিপীড়ন হয়তো আয়োজন করে হয় না কিন্তু ঘেঁটুপুত্র..। সে এলাহী আয়োজন। যেসব শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়- তাদের অনেকে সারাজীবন সেই ভয়াবহ স্মৃতি বয়ে চলে। কাউকে বলতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, তাদের জীবনাচারে অস্বাভাবিক অনেক কিছু ঢুকে পড়ে। তাদের কাছে সারা জীবনটাই বনবাস। ঘেঁটুপুত্র কমলা মুভি নিয়ে সবার মাঝে আকর্ষন আছে। এর একটা কারণ হুমায়ুন আহমেদের প্রয়াণ। অন্যটি মুভির বিষয়বস্তু। হুমায়ুন আহমদ খুব যে সহজ পথে হেঁটেছেন তা নয়। বিতর্ক হবে জেনেও তিনি এই মুভিটি নির্মাণ করেছেন তার জন্য আমরা তার কাছে কৃতঞ্জ থাকতে পারি। তার আগে ঘেঁটু গান সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেয়া ভালো।
গাঁটু বা ঘাঁটু না গাঁডু সেই বিতর্কে যাবার খুব একটা দরকার নাই। একটা কাহিনী দিয়ে সংক্ষেপে বলা যাক। ১৬ শতকের প্রথম দিকে তৎকালীন শ্রীহট্টের আজমিরীগঞ্জের জনৈক আচার্য রাধা যেভাবে কৃষ্ণের জন্য পাগলপারা হয়ে ছিলেন- সেই বিরহভাবে ব্যাকুল হয়ে সংসার থেকে উধাও হয়ে যান। কয়েক বছর পর ফিরে এসে বাড়ির সামনে পুকুরের ধারে একটা কুঞ্জ বানান। সেই কুঞ্জে বিরহিণী রাধার মতো মথুরাবাসী কৃষ্ণের অপেক্ষায় থাকলেন। ভাবাবেগে অধীর হয়ে তিনি ফুল তুলতেন, কুঞ্জ সাজাইতেন, কখনো কলসী কাঁখে জল আনতে যেতেন, কখন বা প্রাণবেনুর রব শুনে শিষ্য উদয় আর্চাযের গলা জড়িয়ে কাঁদতেন, কখন বা কোকিলার কুহু তানে আপনাকে হারিয়ে ফেলতেন- তন্ময় হয়ে পড়তেন।
ক্রমে তার শিষ্য বাড়তে থাকে। সমাজের নিম্মশ্রেণীর লোকেরা এসে জড়ো হয়। তাদের কম বয়েসী ছেলেরা এই গানে অংশগ্রহন করে নারীবেশে। উদয় আর্চাযের সংস্কারে এটা পালা গানে পরিণত গয়। এই পালা গান নানা অন্কে বিভক্ত। এর নিজস্ব ধারা তৈয়ারী হয়ে যায়। আচার্যের মৃত্যুর পর এই গানে সুন্দর কিশোরদের নারী সাজিয়ে মনোরঞ্জনের বিষয়টি আসে। তখন বিরহ বা ঠাট্টার ছলে বিশেষ ধরণের ইঙ্গিতই প্রধান হয়ে উঠে। উমর আলী আর সুরেন্দ্রচন্দ্র নমদাস নামে দুইজন গাঁটুর মাসিক আয় ছিলো তিনশত টাকার উপরে। বলা হয়ে থাকে এই দুই ঘেঁটুপুত্রের বিলাসিতা অনেক টাকাওয়ালা ব্যক্তিকে সর্বস্বান্ত করেছে।
এইভাবে সেই আধ্যাত্মিক ভাবের খবর চাপা পড়ে গেল। সময়ের সাথে এই অনৈতিক উদযাপন উঠে গেল। সেই প্রথার কদর্য রূপটিই হুমায়ুন আহমেদ তার গেঁটুপুত্র কমলায় তুলে এনেছেন। এই গানের আধ্যাত্মিক মহিমার কোন তুলনা যদি এই সিনেমায় আসত- তবে মানুষ গাঁটু গান সম্পর্কে আরেকটু জানতে পারত। এখন শুধুমাত্র এই ঐতিহ্যের খারাপ রূপটিই আমরা দেখলাম।
এই মুভিতে হুমায়ুন তার স্বভাবী বয়ান ভঙ্গিতে এগিয়েছে। শুরু থেকে প্রতিটি চরিত্রের পরিচয়ে হুমায়ুন বরাবরের মত চমক ও মজা দিয়েছেন। এমন কি ঘেঁটুপুত্রের আবির্ভাব, সাজন সব কিছুতেই সেই মজাটুকু ছিলো। তখন ভয় হচ্ছিল- ঘেঁটুপুত্রই না শেষ পর্যন্ত কোন মজার খোরাক হয়ে পড়ে। দর্শকের হাসি ও তালি সেই আশংকা বাড়িয়েই দেয়। কিন্তু ঘেঁটুপুত্রের চিৎকারে যখন জমিদার বাড়ি কেঁপে উঠে তখন পিনপতন নিরবতা। কমলা যখন পরদিন সকালে মায়ের কাছে যাবার আকুতি জানায় খুব কম দর্শকই বোধহয় আবেগী হয়ে পড়ে নাই। আর যাদের জীবনে এমন যন্ত্রণাময় স্মৃতি আছে- তাদের কথায় বাদ দিলাম। কমলা নাচের মাষ্টারকে (প্রাণ রায়) যখন বলে- গায়ে হাত দিবেন না। কি অদ্ভুত যন্ত্রণা। যার এই স্মৃতি থাকে, তার কাছে চিরকালই কি অপর পুরুষের হাত আগুনের মত ছ্যাকা দেয়া কিছু। এই একটা সংলাপ দিয়ে হুমায়ুন অনেক কিছু বুঝিয়েছে দিয়েছেন। মাষ্টার যখন বলে, তারও ঘেঁটুর জীবন ছিলো। তখন বিষাদ আরো গাঢ় হয়।
এই মুভির ডিটেইলে কিছু ঘাটতি আছে। শুরুতে ও জমিদারের জবানে সৌখিনদার মানুষের ঘাঁটু বিলাসের কথা জানা যায়। সৌখিনতা সাধারণত প্রশ্রয় সূচক। তাই দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে শিশুকামীতাও সেই প্রশ্রয়ের বিষয় কিনা। ইতিমধ্যে সেই প্রশ্ন এসেছে। সেই জবাব এই মুভিতে ভালোভাবেই আছে। শিশুকামীতা সৌখিনতার বিষয় নয়, প্রবৃত্তিগত বিকৃতি। হুমায়ুন তার নানা লেখাতে বলেছেন সুন্দর বালিকার জীবন যেমন বিপদের মুখোমুখি তেমনি বালকেরও। হিমুর সিরিজের সর্বশেষ বইতেও এমন একটা ঘটনা আছে। এই মুভিতে জমিদারের সহিস চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। এই অভিনেতার নাম জানা না গেলেও তার সামান্য উপস্থিতি অসাধারণ। তার ভেতরও সৌখিনতার ইচ্ছে জাগে- এই ইচ্ছে আসলে শিশুদের উপর অত্যাচারের। অর্থ্যাৎ, একটা খারাপ জিনিসেরও দোহাই থাকে- যে দোহাই দিয়ে একে জায়েজ করে নেয়া যায়!
এই মুভির প্রথম অর্ধেক শেষ হয় ঘেঁটুপুত্রকে মেরে ফেলার চক্রান্তের মধ্য দিয়ে। জমিদারের স্ত্রী (মুনমুন আহমেদ) তার দাসী সর্দারণীকে (শামীমা নাজনীন) দিয়ে কমলাকে খুন করাতে চান। সিনেমার দ্বিতীয় অংশে কাহিনী অনেকটা ঝুলে গেছে। কমলাকে খুনের নানা চেষ্টা দিয়ে এটাকে টান টানভাবে দেখানো যেতো। তার বদলে হুমায়ুন গেছেন পরিপার্শ্বিক দৃশ্যায়নে। অর্থ্যাৎ, হাওরের অলস তিনমাসকে নানাভাবে দেখানোর চেষ্টা। আছে। যেমন- এইসময় মানুষ নানান ধরণের আমোদ ফুর্তি করে বেড়ায়।জমিদারও। জুয়ার আসর, মোরগ লড়াই দিয়ে সেটা বুঝানো হলেও কাহিনীর প্রেক্ষাপটে আরেকটু বেশি কিছু দাবী করে। এটাকে খুব একটা খারাপ হয়েছে- বলা না গেলেও সিনেমাকে টানটান করা গেলে ভালো হতো। বিশেষ করে দর্শক যখন অন্যদের কাছ থেকে জেনে গেছে কমলা মারা যাবে- তাই এটা কোন বিশেষ চমক নয়। বরং, এই মৃত্যুকে আরো করুণ সুরে দেখানো যেত। বিশেষ একটা চরিত্রকে প্রায় বেকারই দেখা গেছে- চিত্রশিল্পী শাহ আলমের (আগুন) উপস্থিতি। তাকে অবসরে সময়ে ছবি আকাঁনো ছাড়া আরো শক্তিশালী চরিত্র আকারে দেখা যেতো। ঘেঁটুগানের নামে শিল্পের কদর্যতা আর তার নান্দনিক কাজের মধ্যে দিয়ে একটা তুলনা দেখানো যেত। শাহ আলমের সংবেদনশীলতা তার চরিত্রের সাথে মানিয়ে গেছে। তবে সেই তুলনায় স্বল্প উপস্থিতির সহিস চরিত্রটি প্রতিষ্ঠিত।
হুমায়ুনের ‘মাতাল হাওয়া’ উপন্যাস ধরে বললে, তার কাছে বড় প্রশ্ন ছিলো কড়া শরিয়তী ও রক্ষণশীল জীবন ধারার মধ্যে এমন একটি বিকারগ্রস্ত সংস্কৃতি কিভাবে টিকে ছিলো। সেই প্রশ্ন আমাদেরও। এই মুভিতে ধর্ম সে প্রশ্ন নিয়েই হাজির ছিলো। জমিদার বাড়ির ইমাম সাহেব সবাইকে নামাজের কথা বলে। সেইখানে সহিস বলে- যে বাড়িতে ঘেঁটুপুত্র থাকে, সেই বাড়িতে নামাজ কিসের। এই প্রশ্নের জবাব ইমাম, হুমায়ুন ও দর্শক কারো জানা নাই। শুধু এইটুকুই বুঝা যায়- ধর্মের চর্চা যখন ক্ষমতার পদনত হয়- তখন সেই ধর্মের কোন স্পিরিট থাকে না। ইমাম সাহেব যখন কমলাকে বেত দিয়ে মারেন- তখন তিনি আসলে নিজের ধর্মচর্চা ও জমিদারের অনাচারকেই আঘাত করেন। এইসব ঘটনার মাঝে কাহিনীর বিবেক হয়ে আসে জমিদারকন্যা ফুলরানী (প্রাপ্তি)। সে একটা প্রশ্নই সবাইকে করে যায়- কমলা ছেলে না মেয়ে। একজন মানুষ একই সাথে কি করে ছেলে ও মেয়ে হয়। সে জবাব আসলে সেই বৃত্তের কেউ দিতে পারে না। কারণ, সবার সাথে কমলার সম্পর্ক এক ধরণের স্বার্থ রক্ষার বা বিরোধের। সে মা (তমালিকা কর্মকার) হোক, বাবা, জমিদার বা জমিদারের বউ সবার কাছে। এমনকি মৌলভীর কাছেও নাই। হয়তো তাই মীমাংসাহীনভাবে কমলাকে চলে যেতে হয়। হুমায়ুন তাকে এই স্মৃতি থেকে মুক্তি দিয়েছেন।
হুমায়ুন স্বভাব সুলভ কৌতুকময় অথচ স্বাভাবিক বর্ণনা ভঙ্গির মধ্য দিয়ে এই মুভির প্রথম থেকে এগিয়েছেন। একদম প্রথম দৃশ্যের জমিদার বাড়ির ছাদে চিত্রশিল্পীর মডেল হওয়া থেকে শেষদৃশ্যে গাঁটু দলের ফিরে যাওয়া বলা যায় একটা মালা তিনি গেঁথেছেন। বলা চলে, হুমায়ুনের মুভিগুলোর মধ্যে শ্রাবণ মেঘের দিন-র পরে ঘেঁটুপুত্র কমলা-র লোকেশান ও দৃশ্যায়ন পরিকল্পনা চমৎকার লেগেছে। জমিদার বাড়ির বাহিরের চকচকে ভাব দৃশ্যায়নে আলাদা মাত্রা এনেছে। দারুন লেগেছে সেই আমলের উপযোগী নানা পরিবেশনা। দুটি দৃশ্যের কথা আমার বারবার মনে পড়ছে। একটি হলো- যখন এই মুভির টাইটেল দেখানো হয় শীতালং শাহের ‘সুয়া উড়িলো উড়িলো’ গানের তালে তালে। হাওরের প্রতিটি দৃশ্য অসাধারণ সৃন্দর হয়ে এসেছে। আরেকটা সুন্দর দৃশ্য হলো কমলা ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর শাহ আলমের ঘরের জানালায় ছায়া পড়েছে।
বরাবরের মতো হুমায়ুনের অন্য মুভির মতো চমৎকার চারটি গান আছে। এরমধ্যে অসাধারণ হলো সুয়া উড়িলো উড়িলো। এই গানটি গেয়েছেন ফজলুর রহমান বাবু ও শফি মন্ডল। জীবের জীবনের বৈচিত্র্য সব পর্বের বর্ণনা আছে এই গানে। মুভির শেষে প্রান্তির কন্ঠে গানটি কমলার অপূর্ণ মানব জীবনকে প্রকাশ করে।এইছাড়া অতিপরিচিত ‘যমুনার জল দেখত কালো’র সাথে আছে ‘ভাইসব সাবান কিনা দিলা না’সহ আরেকটি গান। তবে এই মুভিতে হুমায়ুনের অন্যান্য সিনেমায় থাকা বিরহ গান মিস হয়ে গেছে। আবহ সংগীত কিছু দৃশ্যে খুব চড়া হয়ে গেছে। অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই। হুমায়ুনের গল্প ও চিত্রনাট্য সব সময় নিরাসক্ত একটি ভঙ্গি পছন্দ করে। সেই মোতাবেক হুমায়ুন তার চরিত্রগুলো থেকে কাজ আদায় করে নেন। এই মুভিও তার ব্যতিক্রম নয়। তারিক আনাম খান, শামীমা নাজনীন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের সাথে ছোট্ট প্রাপ্তির অভিনয়ও চমৎকার। তবে, কমলা চরিত্রের অভিব্যক্তি আরেকটু মনোযোগ দিলে ভালো হতো।
হুমায়ুন আহমেদের খুব কম মুভিই আনন্দের দৃশ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। ঘেঁটুপুত্র কমলাও তার ব্যতিক্রম নয়। গাঢ় বিষাদ ছড়িয়ে যায়। হুমায়ুন তার নিজের প্রশ্নগুলোরও জবাব দেন না। আমাদের সামনে মালা গেঁথে রেখে যান। এই মুভি তার ব্যতিক্রম নয়। নানা প্রশ্ন আছে। যেমন শিল্পের রূপ কি হবে? শিশুদের প্রতি আমাদের মনোযোগ কেমন হবে? শিশুকামীতা শুধুমাত্র ঘেঁটুপুত্রে সীমাবদ্ধ নয়- এটা আমাদের জানা আছে। সেইসব প্রশ্নের উত্তর অন্বেষনই এই মুভিকে আলাদা পূর্ণতা দিবে। এইসব উত্তর কোনটাই শুষ্ক চিন্তার বিষয় নয়- আমাদের যাপনও বটে। সব শিশুই ভালো থাকুক।
তথ্য সুত্র: মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন কাসেমপুরী, গাডুগান, বাংলা একাডেমী ফোকলোর সংকলন (খন্ড ৫৩), বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৯২।
ফটো: ইন্টারনেট।
> আমার লেখার খাতা: ইচ্ছেশূন্য মানুষ ।