মুসলিম সমাজের একটা অংশের নিকট এটা বড় প্রশ্ন যে জ্ঞান-বিজ্ঞান-আবিষ্কারে কেন মুসলিমরা অন্য সব জাতি থেকে পিছিয়ে আছে। এ প্রশ্নটা সাধারণ বিশ্বাসী মুসলিমদের মনে দাগ কাটে। তারা ব্যথিত হয়। আর ইসলাম বিদ্বেষীরা এটাকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। ক'দিন পরপরই এই বিষয়টাকে আলোচনায় নিয়ে আসে এবং হাস্যকর কথাবার্তা বলে। যেমন- কম্পিউটার যেহেতু অমুসলিমরা আবিষ্কার করেছে অতএব মুসলিমরা কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবেনা, ব্যবহার করলেও এ দিয়ে ইসলাম প্রচার করা বা অমুসলিমদের বিরুদ্ধে কিছু বলা ভারি অন্যায় ইত্যাদি ইত্যাদি!
বাস্তবে এটা একটা ধোকাবাজী বৈ কিছুই নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন ধর্মই তার অনুসারীদের বৈষয়িক উন্নতি অগ্রগতির ফর্মুলা দিতে আসেনি। আর কোন ধর্মের সত্য মিথ্যা এর ওপর নির্ভরশীলও না। ইসলাম মানুষের নিকট যে দাওয়াত নিয়ে এসেছে তার সারকথা ছিলো- সৃষ্টিকর্তা একজন, তাকে এক বলে স্বীকার করতে হবে। আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ নবীর (সা) অনুসরণে প্রত্যাহিক জীবন গড়ে তুলতে হবে। এবং মৃত্যু-পরবর্তী অনন্ত জীবনে বিশ্বাস রাখতে হবে। শুধু বিশ্বাসই নয় পার্থিব ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখ সমৃদ্ধির তুলনায় আখেরাতের জীবনের সাফল্যকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ অবস্থায় মানব কল্যাণের জন্য মুসলিমরা যদি বিজ্ঞানে অবদান রাখতে পারে ভালো। যদি না পারে তবে এ কারণে তাদের ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ কই? অন্তত মুসলিমদের ধর্মতো বিজ্ঞান গবেষণায় বাঁধা দিতে ইনকুইজিশন প্রথা চালু করেনি। আজকে অধিকাংশ বিজ্ঞানী যে ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে এসেছে তাদের ধর্মই বরং এই জঘন্য প্রথা চালু করেছিলো, ফলে তারা ধর্মকে অগ্রাহ্য করে সামনে অগ্রসর হতে বাধ্য হয়েছিলো।
বিজ্ঞান একটি জাগতিক জ্ঞান যা অর্জন করা সবার জন্য আবশ্যকীয় নয়। কিছু মানুষ এই জ্ঞানে অভিজ্ঞ হলে গোটা মানব সমাজ তাদের দ্বারা উপকৃত হতে পারে। পৃথিবীর শুরু থেকে এভাবেই চলে আসছে। আর বিজ্ঞানের প্রাথমিক চর্চা শুরু হয়েছিল প্রাচীন নবীগণের (আ) মাধ্যমেই। ইসলাম যখন পৃথিবীতে এসেছে তখন পারস্য এবং রোম আরবের তুলনায় বৈষয়িক জ্ঞানে এত বেশী উন্নত ছিলো যে উভয়ের মধ্যে তুলনা চলেনা। তা সত্ত্বেও ইসলাম যে তাদের ওপর বিজয়ী হয়েছিলো তা বিজ্ঞানে উন্নতির জন্য নয়। সত্য ধর্ম হওয়ার কারণে, মানুষে মানুষে সমতা প্রতিষ্ঠিত করার কারণে। সর্বোপরি আল্লাহর সাহায্যে। যদিও ইসলামের বিজয় সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলিম বড় বড় শহরগুলো একেকটা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার আধুনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, বীজগণিত, ভুগোল ইত্যাদি শাস্ত্র ওই সব শহর থেকেই নবজীবন লাভ করেছিলো।
পৃথিবীর ইতিহাসে সব কিছুরই উত্থান পতন রয়েছে। একটি ভবন যেদিন নির্মাণ সমাপ্ত হয় মূলত ঐ দিন থেকেই উক্ত ভবনের ক্ষয় শুরু হয়ে যায়। নদীতে জোয়ার সমাপ্ত হলে ভাটা শুরু হওয়াই কেবল বাকি থাকে। মুসলিমরা ইতিহাসের দীর্ঘ একটা সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। একথা কেউ যদি অস্বীকার তবে সেটা তার জেগে ঘুমানো। সেসময় আজকের সভ্য ইউরোপ ছিলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাদের কল্যাণেই "মধ্যযুগীয় বর্বরতা" নামক পরিভাষাটির উদ্ভব ঘটেছিলো। সময়ের আবর্তনে মুসলিমরা পিছিয়ে পড়েছে। যে বাগদাদ ছিলো জ্ঞান ও সভ্যতার বাতিঘর তা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এসে হালাকু খাঁর নেতৃত্বে মোঙ্গলরা এমনভাবে ধ্বংস করে দিল যে এর পরে আর মুসলিমদের নতুন করে উঠে দাড়ানোর শক্তি রইলনা। তখনও অবশ্য ইউরোপের বুকে স্পেনে মুসলিমদের জ্বালানো জ্ঞানের প্রদীপ মিটিমিটি করে জ্বলছিলো। ১৪৯৮ তে এসে সেটাও ইউরোপীয়দের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। মুসলিমদেরকে গণহত্যার মাধ্যমে নির্মূল করা হলো। ভারতীয় মুসলিমরা অবশ্য আওরঙ্গজেবের আমল পর্যন্ত শান্তিতেই ছিলো। কিন্তু আফসোস! ইউরোপে যখন রেনেসাঁ চলছিলো আমরা তখন প্রেমের সমাধি তাজমহল নির্মাণ করে চলছিলাম। বাইরের বিশ্বে কি ঘটছে সে ধারণাও আমাদের ছিলোনা।
যাহোক ইউরোপের দেখাদেখি মুসলিম বিশ্বে দেরিতে হলেও জ্ঞান গবেষণায় নতুন করে জাগরণের সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু এবারে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো তথাকথিত সভ্য পৃথিবীর আরোপিত কলোনিয়ালিজম। এখানে এসে ইতিহাসের এ দিকটা নিয়ে কেউ আলোকপাত করেনা। ভারতীয় উপমহাদেশের কথাই ধরা যাক। ইউরোপে যখন নিত্য নতুন অত্যাশ্চর্য যন্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে। সেই সময়টাতে দুইশত ব্ছর যাবত ব্রিটিশরাই আমাদেরকে শাসন করেছে। কিন্তু তারা এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছোয়া লাগতে দেয়নি ইচ্ছাকৃতভাবেই। এ প্রসঙ্গে জওহারলাল নেহেরু তার 'দ্যা ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া' বইতে লিখেছেন-
"বস্তুতপক্ষে ভারতের শিল্পোন্নতি যাতে না হয়, যাতে শিল্পের দিক থেকে তার অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ অবনতি লাভ করে- সেইদিকেই ইংরেজের লক্ষ্য ছিলো বেশি। যন্ত্রপাতি ভারতে যাতে না আসতে পারে তার জন্য নিয়ম করা হল। বাজারে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা হল যে ব্রিটিশ পণ্য না হলে যেন ভারতের না চলে। সঙ্গে সঙ্গে বহু লক্ষ লোক হল বেকার, দৈন্যদশায় দেশ ছেয়ে গেল। গঠিত হল আধুনিক কালের আদর্শ উপনিবেশ-শাসনতন্ত্র। ইংল্যান্ড দ্রুত তার শিল্পোন্নতির দিকে এগিয়ে চলল, ভারত হয়ে গেল কৃষিপ্রধান দেশ।"
ইংরেজদের দেশ দখলের পর লুটপাটের প্রথম ধাক্কায় যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো তাতেই বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গিয়েছিলো। জ্ঞান-গবেষণাতো পরের বিষয়, জমিদারদের খাজনা দিতে দিতেই মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছিলো। ব্রিটিশরা তাদের নিজ ভূমির শিল্পোন্নয়নের স্বার্থে এ অঞ্চলের লোকদের কৃষিকাজেও করেছে সীমাহীন অত্যাচার। ফসলী জমিতে নীল চাষে বাধ্য করেছে, তা ঐ ইংল্যান্ডের কারখানার কাঁচামালের যোগান দিতেই। যে কারণে কৃষকরা বিদ্রোহ পর্যন্ত করেছে।
ইংরেজরা দেশ ছেড়েছে আজ থেকে ৭০ বছর পূর্বে। কিন্তু তারা যে শোষণ করে গেছে তার ক্ষত এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। পাশাপাশি তাদের রেখে যাওয়া পদ্ধতিতেই দেশ চলছে। তারা যে কেরানী তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে গিয়েছিলো সেটাই এখনো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।
এতো গেল ভারতের দৃষ্টান্ত। মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলই সভ্য ইউরোপের কলোনিতে পরিণত হয়েছিলো। ফ্রান্স, ব্রিটেন, স্পেন, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, ইতালি যে যেখানে যতটুকু ভাগ নিতে পেরেছে লুটেপুটে খেয়েছে। যারা স্বাধীন ছিলো তাদেরও চিন্তা চেতনার গণ্ডি হয়ে পড়েছিল সংকীর্ণ। তারা নিমজ্জিত ছিলো আত্মকলহ আর বিলাসিতায়। সুতরাং যে জাতির বিগত কয়েকশত বছরের ইতিহাস পরাধীনতা, আত্মকলহ আর পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস। তাদের পক্ষে জ্ঞান-গবেষণা-আবিষ্কারে কতটুকু অবদান রাখা সম্ভব? তাছাড়া মুসলিমরা জাতি হিসেবে আত্মাভিমানীও বটে। যে কারণে এই ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখলের পরে অন্যান্য জাতির লোকেরা যত সহজে তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে মুসলিমরা পারেনি। এমনকি ইংরেজি শেখারও প্রয়োজনবোধ করেনি। এ অবস্থায় উপনিবেশবাদের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মুসলিমরাই। এরপরেও ব্যর্থতাকে ব্যর্থতা হিসেবেই দেখা উচিত। এবং মুসলিমদের Conspiracy Theory বাদ দিয়ে আত্মসমালোচনা করা উচিত।
তবে এ ক্ষেত্রে কথা হচ্ছে, এই পৃথিবীতে যে কেউ যা কিছু আবিস্কার করে তা গোটা মানবেরই সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞান অষ্টাদশ শতাব্দীতে শুরু হয়নি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলে আসছে। ইহুদী খ্রিস্টান বিজ্ঞানীরা যা কিছু আবিষ্কার করেছে তার অনেক কিছুর ফাউন্ডেশন মুসলিম বিজ্ঞানীরাই স্থাপন করে গেছেন। যদিও বিজ্ঞানের সর্বাধিক আবিষ্কার-উৎকর্ষের সময়টাতে মুসলিমরা বিশ্বকে তেমন কিছু দিতে পারেন নি। তবে ভুলে গেলে চলবেনা, মুসলিমরা যেমন দৈনন্দিন জীবনে পশ্চিমাদের আবিষ্কারের মুখাপেক্ষী তেমনি পশ্চিমারাও তাদের আবিষ্কৃত পণ্য মুসলিমদের নিকট বিকানোর মুখাপেক্ষী। অর্থনীতির সূত্র তাই বলে। টমাস আলভা এডিসনরা টাকার জন্যই বৈদ্যতিক বাল্ব থেকে শুরু করে গ্রামোফোন আবিষ্কার করেছিলেন। মানব কল্যাণ বা খ্রিস্টধর্মের খেদমতের জন্য নয়। (টমাস আলভা এডিসন নিজেই মাইকেল ফ্যারাডের সঙ্গে তার তুলনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে তিনি টাকার জন্যই এসব কিছু করেন)। স্টিভ জবস নিশ্চয়ই ধর্মীয় চিন্তা থেকে আইফোন উদ্ভাবন করেননি। বৈশ্বিক মার্কেট ধরাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো। অথচ আজকালকার ইসলাম বিদ্বেষীরা এমন ভাব করে যে আইফোন যেহেতু একজন খ্রিস্টান আবিষ্কার করেছে অতএব মুসলিমদের এটা ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই খ্রিস্টান এবং নাস্তিকদের গুণকীর্তন হবে। তাদের বিরুদ্ধে এই যন্ত্র দিয়ে কিছু লেখা যাবেনা!
আবিস্কারই কি সব?
এই একটি প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। মুসলিমদের লজ্জা দেয়ার জন্য বারবার আবিষ্কারের প্রসঙ্গ নিয়ে আসা হয়। কিন্তু এই পৃথিবীতে আবিষ্কারই কি সব? এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে মানুষের অনেক কিছুই লাগে। শুধু আবিষ্কার দিয়ে তো চলেনা। আচ্ছা, সবচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দেশ আমেরিকায় কেন সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ হয়? পুরো সভ্য পৃথিবী কেন বৃদ্ধ মা বাবাকে টিস্যু পেপারের থেকেও নিম্নভাবে মূল্যায়ন করে? বিজ্ঞানে অগ্রসর জাপানে কেন এতমানুষ আত্মহত্যা করে? সভ্য বিশ্বে কিভাবে অস্ত্র ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, পর্নগ্রাফি ইত্যাদি দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে? আবিষ্কারের জগত থেকে কেন আবেগ, ভালোবাসা, পারিবারিক বন্ধন, নীতি-নৈতিকতা কর্পূরের মত উড়ে গেল?
এক্ষেত্রে এসে যে কেউ বলতে বাধ্য হবে, আজো পর্যন্ত যান্ত্রিক পৃথিবীতে বেগের চাপের মধ্যে যতটুকু আবেগ, ভালোবাসা, নৈতিকতা, পারিবারিক বন্ধন এবং মানসিক প্রশান্তি অবশিষ্ট আছে, বেশিটা মুসলিমদের কল্যাণেই আছে। যে কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত সভ্য পৃথিবীর লোকেরাও প্রতিনিয়ত মানসিক প্রশান্তির আশায় ইসলাম গ্রহণ করছে। অতএব, মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকার ব্যর্থতা যতটা না আমাকে কষ্ট দেয়, আজকের স্বার্থপর পৃথিবীতে ইসলামের এই মানবীয় দিক আমাকে এর চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ দেয়।
সর্বশেষ একটি ঘটনা দিয়ে আমার এই লেখার ইতি টানতে চাই। যে মোঙ্গলদের হাতে মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছিলো। বাগদাদ ধ্বংস করে যারা রক্তের ফোয়ারা বইয়ে দিয়েছিল। বেশ কয়েক বছরের ব্যবধানে তারাই ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। সেই মোঙ্গলদেরই উত্তর পুরুষ বাবর এই ভারতে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটাই পৃথিবী। কারো উত্থান ঘটে কারো পতন ঘটে। এভাবেই সময়ের আবর্তনে পৃথিবী এগিয়ে চলে। এর সাথে সত্য-মিথ্যার সম্পর্ক সামান্যই। যারা মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবনে বিশ্বাস করে তাদের সেই জীবনের সাফল্যকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত এবং ঈমান ও ভালো কাজের মধ্যেই সকল সান্ত্বনা খোঁজা উচিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৪