গত ছয় মার্চ বিকেল। নয়াপল্টন বিএনপির অফিসের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ চলছে। এদিকে বিজয়নগরের হোটেল সেভেনটি ওয়ানের পাশের গলিতে কিছু জঙ্গি শিবির কর্মী জটলা পাকাচ্ছে। একই রকম জটলা দেখা গেছে নাইটেঙ্গেল রেস্টুরেন্টের পাশের গলিতে।
মুহূর্তেই জামাত-শিবিরের জঙ্গি গ্রুপ দুটি ঝটিকা মিছিল শুরু করল। মিছিল দুটি নাইটেঙ্গেল মোড়ে আসতেই দেখা গেল মিছিলের আসল জঙ্গি রূপ। মিছিল থেকে পরপর অনেকগুলো ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হল। কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে কয়েকটি ককটেল ছোড়া হল, ইট-পাটকেল বর্ষণ চলল সমানতালে।
পুলিশকে বাধ্য করা হল গুলি চালাতে। পুলিশ আহত সিংহের উন্মত্ততা নিয়ে জঙ্গি মিছিল দমনে নামল। ছত্রভঙ্গ দশ-বারোজন শিবির কর্মী বিএনপির অফিসের দিকে দৌড় দেয়াতে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে পিছু নিল। ফলাফল খুবই সরল- বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ পণ্ড হল। মহানগর নেতা আব্দুস সালাম গুলিবিদ্ধ হলেন। আহত হলেন আরও কয়েকজন সিনিয়র নেতা। জামাত যা চাইছিল তাই হল। বিএনপি সমাবেশ পণ্ড ও নেতাকর্মী আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগে পরদিন বৃহস্পতিবার ঐতিহাসিক সাতই মার্চ দেশব্যাপি হরতাল ডাকল। দেশের মানুষ একই সপ্তাহে চতুর্থদিনের হরতালের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হল।
নিন্দুকেরা বলেন- বিএনপিকে নাকি একশোজন মানুষের সমাবেশ করতে হলেও জামাতের টাকার মুখাপেক্ষী হতে হয়। জোট সরকারের আমলে বিএনপির নেতাকর্মীরা হরিলুটেই ব্যাস্ত ছিলেন। দীর্ঘমেয়াদি টাকা আয়ের তেমন কোন পথ তৈরি করতে সফল হননি। জামাত কিন্তু বসে থাকেনি, জামাত নেতাকর্মীরা অসংখ্য ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে নিষ্ঠার সাথে পরিচালনা করে সেসব প্রতিষ্ঠানকে আরো শক্তিশালী করেছে। যার ফলে একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, একজন বীরাঙ্গনা খালেদা জিয়া জামাতের পয়সা ছাড়া আরামে বাথরুমও সারতে পারেন না। সুতরাং খালেদা জিয়া যখন বলেছেন দেশে গণহত্যা চলছে, আমরা তেমন বিস্মিত হইনি। যারা বলেন একাত্তরে দেশে গণ্ডগোল হয়েছিল তারা এখন এই দুইহাজার তেরতে দেশে গণহত্যা হচ্ছে বলবেন তাতে আর আশ্চর্য কি আছে!
গত ছাব্বিশ ফেব্রুয়ারি কুখ্যাত রাজাকার সাইদির ফাঁসির রায় হওয়ার পর থেকে দেশব্যাপি জামাত-শিবিরের সহিংসতায় কমপক্ষে একশোজন মানুষ মারা গেছেন। এই মৃত্যুর মিছিলে আছেন পুলিশ সদস্য, নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ। আর আছে অনেক জামাত-শিবির কর্মী, যাদের বয়স চোদ্দ থেকে বাইশ বছর। এই কিশোর-তরুণদের অনেকই জামাত-শিবিরের নিয়মিত কর্মী নয়। এদের মধ্যে নেই কোন জামাত নেতার সন্তান-স্বজন। বেশিভাগই নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। সামান্য কয়টা টাকার বিনিময়ে যাদের দিয়ে সহিংসতা চালানো হয়েছে। তাদেরকে দিয়ে জামাত-শিবির কি না করেছে? সরকারি ভবনে আগুন দেয়া, রেললাইন উপড়ে ফেলা, ট্রেনের বগিতে আগুন দেয়া, রাস্তা অবরোধ, পুলিশের উপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও বসতবাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ, বাসে-খাদ্য বোঝাই ট্রাকে আগুন দেয়া ইত্যাদি। এই ধরণের ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে পুলিশকে বাধ্য হয়েই গুলি চালাতে হয়েছে। জামাত-শিবিরের অনেক জঙ্গি মিছিল থেকে পুলিশ ও সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই হামলাস্থলে কিছু সাধারণ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে।
জামাত-শিবির নেতৃত্ব এতটাই ভীরু কাপুরুষ আর ভণ্ড যে রাস্তায় নামার সাহস তাদের নাই। তারা অর্থ আর মগজধোলাই সম্বল করে সাইদির নামে কিছু নির্বোধ কিশোর-তরুণের প্রাণ সংহার করল। না জানি আরও কত নাম না জানা তরুণকে এরা স্বার্থের বলি বানাবে। আমরা দেখেছি রাজিব হত্যাকারীদের। তারাও তরুণ, যারা সরাসরি জামাত-শিবির সংশ্লিষ্ট নয়। একজন শিবিরকর্মি তাদেরকে উস্কে দিয়ে খুনি বানিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করল। নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তার ছেলে তৌকিকে হত্যা করা হয়েছে। এখনও কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। তবে বুঝতে অসুবিধা হয়না কারা খুনটা করিয়েছে। এখানেও দেখা যাবে কয়েকজন অতি সাধারণ তরুণকে খুনি বানানো হয়েছে।
এতদিন সারাদেশে সহিংসতা চললেও শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ ছিল সবচাইতে নিরাপদ জায়গা। আমরা কেউ কেউ বিশ্বাস করতাম জামাত-শিবিরের এত সাহস নেই যে তারা শাহবাগে হামলা চালায়। কিন্তু আমাদের যাবতীয় ধারনাকে ভুল প্রমাণিত করে গতকাল নারীজাগরণের অনুষ্ঠানের সময় দুটি ককটেল ফাটানো হল। একজন র্যাব সদস্য আহত হয়েছেন। বিস্ফোরণের পরপর একটু গুঞ্জন উঠলেও মুহূর্তেই দেখছি উপস্থিত সবার চকচকে চোখ। যে চোখে নেই কোন বিস্ময়, নেই কোন হতাশা, নেই কোন ভীরুতা। চোখ থেকে চোখে দেখছি ক্রোধের তীব্র আগুন। যে আগুনে এবার পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবে জামাত-শিবির আর তার পদলেহনকারী তাবত দোসরেরা।
জয় বাংলা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৪:৩৫