অফিস শেষে ক্লান্ত দেহ আর মন নিয়ে হাজির হলাম আরুর বাসার সামনে। আগের রাত্রে সারারাত জেগে সকাল ৬ টায় ঘুমিয়েছিলাম আর আজ সকালে ১০ টায় উঠে অফিসে। অফিসের কাছাকাছি বাসা হওয়াতে একটা সুবিধা হয়েছে, ঘুম থেকে উঠেই অফিস ধরতে পারি। আর একটা বড় অসুবিধা আছে, আরুর বাসা আমার বাসা থেকে অনেক দূরে হয়ে গেছে। আর সেই সাথে আছে ঢাকা শহরের জ্যাম। এই সব কিছু মাথায় নিয়ে আমি আরুর বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি। দুইবার আরুকে ফোন দিলাম রিসিভ করছেনা। নিশ্চয়ই মেয়েটা এখন কোন খাবার গরম করছে। চাকরীতে জয়েন করে নাকি আমি চিকন হয়ে যাচ্ছি তাই আমাকে মোটাতাজা করার দায়ীত্বটা সে নিজের কাধে তুলে নিয়েছে। অফিস শেষে ওর সাথে দেখা করতে এলেই কিছু না কিছু রান্না করে নিয়েই হাজির হয়। আরু ফোন রিসিভ না করাতে আমি অফিসের একটা কল এটেন্ড করেছি।
আরুর সাথে প্রায় চার বছরের সম্পর্ক আমার। ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষ শেষে আরুর সাথে ফেসবুকে পরিচয় হয় আমার। এরপরে দেখা! আরুর সাথে প্রথম দেখা আমি কখনো ভুলতে পারবোনা। প্রথম দেখা করার জন্য আরু ঠিক করেছিল নিউমার্কেট। ঢাকা শহরের এতো রেস্টুরেন্ট আর পার্ক থাকতে আমরা দেখা করেছিলাম নিউমার্কেটে। এতো মানুষের ভীরেও ওকে খুজে পেতে আমার কোন কষ্ট হয়নি সেদিন। ভীরের মাঝে সবাইকে আলাদা করে নিজের স্বকীয়তা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল আরু। কিছুক্ষণের জন্য সেদিন আমি কোন কথা বলতে পারিনি। ছবিতে যে আরুকে আমি দেখেছিলাম তার থেকে হাজারগুন বেশী সুন্দর বাস্তবের এই আরু। প্রথমবার দেখা হওয়ার পর থেকেই আমরা রোজ দেখা করতে থাকি। দেখা করার জন্য নানা অজুহাত বানাতে থাকি আমি। অথচ আরুকে এক নজর দেখাটাই আমার জন্য বেশী জরুরী ছিল সেকথা আমি তাকে কখনো বলতে পারিনি।
প্রথমবার দেখা করার জন্য যে প্রস্তুতি আমি সেদিন নিয়েছিলাম এর পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল যেদিন আমি আরুকে বলি, যে সে আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাকে এক নজর দেখার জন্য আমি কত মিথ্যে অজুহাত দিয়েছি। তার সাথে আরেকটু বেশী সময় কাটানো জন্য আমি তাকে কত বাহানায় কত জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেছি। সেদিন আমার সব থেকে সুন্দর আর দামী শার্টটা লন্ড্রি করে পরেছিলাম, পাশের রুম থেকে বডিস্প্রে ধার করেছিলাম, আগের রাত্রে সেভ করেছিলাম। শাহবাগ থেকে ফুল এনেছিলাম। এই এতো সকল প্রস্তুতি ছিল শুধু তাকে এই কথাটা বলার জন্য যে, "আরু, তোমার সাথে আমার লক্ষ কোটি বছরের হিসেব বাকি, তোমার সাথে আমার বোহেমিয়া জীবন বাকি, তোমার সাথে আমার প্যারিস-লন্ডন জীবন বাকি, তোমার সাথে আমার বরফ-তুষার জীবন বাকি।" অথচ সেদিন আরুর সামনে গিয়ে আমি এসবের কিছুই বলতে পারিনি। ওর সাথে দেখা হওয়ার আগেই ফুলগুলো ফেলে দিয়েছিলাম। আরু আসার পূর্বেই লন্ড্রির শার্ট কুঁচকিয়ে ফেলেছিলাম। আরু আসার পরে ওর হাতে এক গুচ্ছ কাচের চুড়ি পরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, "এই হাতে আমার সারা জীবন চুড়ি পরানো বাকি! " মেয়েটা কি বুঝেছিল জানিনা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিল সেদিন।
অফিসের কল কাটতে না কাটতেই আরুর কল বাজছে আমার ফোনে,
-হ্যালো, কোথায় আপনি?
-আমিতো সেই কখন থেকে তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি তুমি কোথায়?
-আমার বাসার গেটের দিকে তাকান!
মেইন রাস্তা থেকে আরুর বাসার গেটে একটা সরু গলি। আমি মেইন রাস্তাতে দাঁড়িয়ে আছি। ফোন কানে ধরে আমি গেটের দিকে তাকিয়েছি মাত্র। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। হাসির এক দেবী আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হাসির দেবী আজকে শাড়ি পরে এসেছে। আমি তাহাকে দেখিলাম! আমি তাহাকে দেখিলাম! ধরণের অনুভূতিহীন একটা অবস্থার মধ্যে পরে গেলাম আমি। আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে আছি। একেবারে প্রথম যেদিন আরুকে দেখেছিলাম, বাচ্চা বাচ্চা স্বভাবের একটা মেয়ে আমার দিকে আসছে আজকেও ঠিক সেই প্রথম দিনের মতোই বাচ্চা বাচ্চা স্বভাবের একটা আরু আমার দিকে আসছে। চার বছরে আজকে সে প্রথম শাড়ি পরছে এমন না। কিন্তু আমার সামনে এটাই তার প্রথম শাড়ি পরে বের হওয়া। আমি এতোটা অবাক কখনো হয়েছি কিনা এই মুহুর্তে মনে পরছেনা। আর আমি মনে করতেও চাইনা। এরকম অনুভূতি সারাজীবনের জন্য আটকে রাখা যেতো! এক হাত ভর্তি কাচের চুড়ি, অন্য হাতে মেটাল এর চুড়ি, নাকে নাকফুল, ঠোটে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা লিপস্টিক, গলায় মাটির মালা। এক হাতের নখে নেল পালিশ দেয়া। রুপের দেবী স্বর্গ থেকে নেমে আসছে আর আমি শুধু তার আসার পথের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি চাইনা আরুর এই আসার পথের শেষ হোক এই পথ হোক অনন্তকালের আমি অনন্ত কাল ধরে তাকে দেখতে থাকি।