মা'য়ের মৃত্যুর পরে শোকটা সামাল দেয়া আমার জন্য খুব সহজ ছিলনা। তবুও চেষ্টা করেছিলাম যথেষ্ঠ শক্ত থাকার। আমার মা'কে আমি আমার চোখের সামনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে দেখেছি। আমি তখন মা'য়ের পাশে বসে দোয়া পড়ছিলাম। আমার তখন অনেক কাজ, কাউকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেয়া যাবেনা, তারউপর বাড়িতে এতো মানুষ চলে এসেছিল, দূরের আত্মীয়দের খবর পাঠাতে হবে, জানাজা নামাজের সময় ঠিক করতে হবে, মা'কে গোসল করানোর ব্যাবস্থা করতে হবে, কবরস্থানে লোক পাঠাতে হবে কবর খোঁড়ার জন্য। এতো কাজের ভিড়ে আমি আরও শক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার বাবা বেশ ভেঙ্গে পরেছিলেন। গত পঁচিশ বছর যার সাথে তিনি ঘর করেছেন সে আর আজ থেকে থাকবেনা। আমি হুজুরের সাথে কথা বলে জানাজা নামাজের সময় নির্ধারণ করেছিলাম। এরপর মা'য়ের পাশে বসে কোরআন তেলায়ত করছিলাম। এর মাঝেই চারিদিকে খবর চলে যায় মা আর নেই। আত্মীয়স্বজন আসতে থাকে মা'কে শেষবারের মতো একবার দেখার জন্য। অল্প কিছুক্ষণের জন্য শুধুমাত্র মহিলারা মা'কে দেখতে পারে। এরপরেই আমার এক চাচীমা আসেন যার কাছে আমার মা আরবী পড়তো। আমার আর বুঝতে বাকি থাকেনা মা'কে এখন শেষবারের মতো গোসল করাতে নিয়ে যাবে। মাকে গোসল করানো হলো। সাদা কাফনের কাপড়ে মা'কে জড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আর জানাজা নামাজে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোলা হলো খাটনিতে। আমার সামনে আমার সব আত্মীয়রা কান্না করছিল আমি তাদেরকে সান্তনা দিচ্ছিলাম। আমি মা'র জন্য একটুও কান্না করিনি তখন। আমি সবাইকে বুঝাচ্ছিলাম। এরপরে মা'কে নিয়ে যাই জানাজা নামাজের জন্য। জানাজা নামাজের আগে বাবা উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলেছিলেন। এরপর কবরস্থানে। মা'কে চির শায়িত করে চলে এসেছিলাম। বাসায় ফিরে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমি কবরস্থান থেকে ফেরার সময় খেয়াল করলাম আমার বাব একেবারে বাচ্চা মানুষের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি তখন। বাবাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম।
বাসায় ফেরার পরে সবার আগে আমার যে বিষয়টি মনে হয়েছিল, "আমি এখন কাউকে মা বলে ডাকতে পারবোনা"। শুধু এই একটা কথার জন্য আমার সমস্থ পৃথিবী উলটাপালটা হয়ে গিয়েছিল তখন। আমি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। অঝোড়ে কান্না করা শুরু করেছিলাম। আমার খুব ছোটবেলার আরবী পড়ানোর হুজুর যিনি একটু আগে আমার মা'য়ের জানাজা করে আসছেন তাকে জড়িয়ে ধরে আমি কান্না শুরু করেছিলাম। হুজুর আমাকে বারবার বুঝাচ্ছিলেন আর শান্ত হতে বলছিলেন। কিন্তু আমি শুধু একটা কথাই বলেছিলাম, "আমি এখন মা বলে ডাকবো কাকে?" আমি যতবার ঘরের দিকে তাকাচ্ছিলাম, উঠোনের দিকে তাকাচ্ছিলাম, রান্নাঘরের দিকে তাকাচ্ছিলাম আমার শুধু একটা কথাই মাথায় আসছিল তখন, "আজকে এখানে আমার মা থাকলে তাকে আমি মা বলে ডাকতে পারতাম! কিন্তু আমি এখন কাকে মা বলে ডাকবো?" আজ এই লেখাটা লিখতে গিয়েও আমি বারবার সেই দিনে ফিরে যাচ্ছি। আমার চোখে মনের অজান্তেই পানি চলে আসছে। তবুও এই লেখাটা আজকে আমি শেষ করতে চাই। মা'য়ের মৃত্যুর পরে প্রথম কয়েকদিন আমি নামাজ, কোরআন তেলায়ত, মা'য়ের কবরের পাশে গিয়ে মা'য়ের জন্য দোয়া করেই কাটিয়েছিলাম। মা'য়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে কান্না করতাম। আমার সাথে বাবা থাকলে অবশ্য আমি কান্না করতাম না। বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। আমি আর বাবা মোটামুটি ভাবে গুছিয়ে নিয়েছি সবকিছু। কিন্তু আমার ভেতরটা তখন চারিদিকে মা ডাকার জন্য কাউকে খুঁজে বেড়ায়। আমি আর ওই বাড়িতে থাকতে পারছিলাম না। চারিদিকে মা'য়ের স্মৃতি। আমি যেদিকে তাকাই সেদিকেই মনে হয় "মা আমার কাজ করছে, মা আমার জন্য রান্না করছে, মা আমার পড়া ফাকির জন্য বেত হাতে আমার দিকে আসছে, মা আমার ঘুমানোর আগে বিছানা গুছিয়ে দিচ্ছে।" আর আমিও মাঝে মাঝে মন থেকে বলে ফেলতে চাইতাম, "এ মা... মা কনে তুই? ক্ষুদা লাগছে। ভাত দে।"
কয়েকদিনের মধ্যে আমি আর টিকতে পারিনা একদিন রাত্রে হঠাতই বাসা ছেড়ে চলে যাই আমি। যেই বাড়িতে এতোদিন ছিলাম সেই বাড়িই তখন আমার কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। সেখানে আর এক মুহুর্তও আমার জন্য থাকা সম্ভব ছিলনা। বাড়ি ছেড়ে বাইরে চলে যাও্য়াটা সহজ ছিল কিন্তু এরপরে টিকে থাকা কঠিন হিতে থাকে। একেবারে একা হয়ে যাই। প্রায় এক মাস পরে একদিন বাবা মোবাইল করে বলেছিল, "তোর মতো আমিও তো একা হয়ে গেছিরে বাবা।" এরপরে বাবা আর কিছু বলতে পারেনি আমিও না। সোজা ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে যাই। এই মানুষটা কেনো এতো কষ্ট পাবে। আমিতো আছি এই মানুষটার জন্য। বাড়ি ফিরে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন অনেক কান্না করেছিলাম। বাবা'র কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়নি তখনও এখনও।
দিন পনেরো যেতেই বাড়িতে আমার বিয়ে কথা উঠে। আমার মত ছিল আবার ছিলোনা এমন অবস্থার মধ্যে আমার বিয়ে হয়। রাত্রি! নতুন একটা নাম আমার জীবনে। নতুন একটা সম্পর্ক। নতুন একজন মানুষ। হ্যাঁ রাত্রি একজন মানুষ। সে আমার বউ হয়ে আমার ঘরে আসার আগে সে একজন মানুষ। অন্তত তাঁর সাথে গত ছয় বছর সংসার করে আমি তাকে মানুষ বলেই ডাকবো সবার আগে। বাসর রাত নিয়ে কোন উত্তেজনা ছিলনা আমার মাঝে। সত্যিই বলতে আমি তখন বাসর বুঝিনা। সবে কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম এর মাঝেই এই সব কিছু ঘটে গিয়েছিলো। আমি বাসর ঘরে রাত্রির হাত ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, "এই দুনিয়াতে আমি আর তুমি ছাড়া আমার বাবার আর তৃতীয় কোন ব্যাক্তি নেই। তাই আজ থেকে তুমি আমার বাবার খেয়াল রেখো। বাবা যেনো কিছুতে কষ্ট না পায়।" রাত্রি তখন কিছুই বলেনি শুধু একবার মাথা নড়াচ্ছিল আমি এটা বুঝতে পারি। এরপর আমি আবার রাত্রিকে বলেছিলাম, "তুমি যদি কখনো অনেক বেশী অধৈর্য হয়ে পরো তবুও আমার বাবাকে কিছু বলোনা সেটা তুমি আমাকে বলো আমি তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাবোনা পর্যন্ত।" জানিনা কি বুঝেছিল সেদিন এই মেয়েটা এরপর থেকে আমার আর বাবাকে নিয়ে কোন চিন্তা করতে হয়নি।
আমাদের সংসারে তখন রোজ জ্যোৎস্না আসে। চারিদিকে সুখের হাট তখন। আমার শ্বাশুড়ি মাঝে মাঝে আমাকে সন্তান নিতে বলতেন। আর বাড়ির অনেক আত্মীয় এই কথা বলতেন কিন্তু এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে কোন প্রকার কথা হয়নি কখনো। আমি আর রাত্রি খুব দ্রুত বন্ধু হয়ে যাই। নিজেদের মতো করে ভাবতে পারি। এই মেয়েটার কাছে আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবো। যে আমার সব থেকে খারাপ সময়ে আমার পাশে থেকেছে। আমাকে সব কাজ করতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। অল্প বয়সেই সংসারের সব দায়ীত্ব কাছে তুলে নিয়েছে। রাত্রি অনেক চাপা স্বভাবের ছিল। কখনো মুখে কিছু বলতোনা। খারাপ লাগা ভালো লাগা সুখ-অসুখ সব নিজের কাছেই রাখতো মেয়েটা। দেখতে দেখতে আমার অনার্স শেষ হয়ে যায়। বাবার ব্যাবসা দেখা শুরু করি। বাবার বয়স হয়েছে বিশ্রাম দরকার। তবে বাবাকে নিয়ে চিন্তা করার জন্য রাত্রি আছে। আমি নিশ্চিন্ত এইদিক থেকে।
আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর পরে বাবা মারা গিয়েছিলেন। শেষ দুই বছর অসুস্থ হয়ে বিছানা পরে ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পরে রাত্রি অনেক বেশী ভেঙ্গে পরেছিল। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল একেবারেই। শেষ দুই বছরে রাত্রি সবসময় বাবার পাশে থেকেছে। আমি তো কাজের চাপে কোন খোঁজ রাখতে পারিনি। কিন্তু রাত্রি সংসারের সব কাজ সামলে নিয়ে বাবার সেবা যত্ন করেছে। আর ভুলে গয়েছিল নজের যত্ন করতে সেটা আমি গতকাল রাত্রেই জানতে পারি। মূলত সেজন্যই এই লেখাটার শুরু।
বাবা মারা যাওয়ার পরে রাত্রির মা মানে আমার শ্বাশুড়ি রাত্রি খুব দ্রুত সন্তান নিতে বলে আর রাত্রি জবাবে বলে, "সময় হলে নিবো।" আমি তখনো কিছু বুঝিনি। কিন্তু গতকাল রাত্রিতে যখন দেখলাম রাত্রি বিছানায় নেই এক বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আমার ভিতরটা কেমন জানি করে উঠলো। বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। আমি কাছে যেতেই বুঝলাম আমার ঘুমের সম্যসার জন্য রাত্রি বাইরে এসে একা একা কান্না করছে। বৃষ্টির পানি এসে পরছে রাত্রি মুখে। চোখের পানি ভেসে গেছে কিন্তু মনের দুঃখটা এখনো তাজা। আমি কাছে যেতেই আমকে জড়িয়ে ধরে বেশ শব্দ করে কান্না করা শুরু করেছিল রাত্রি। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রাত্রি আমাকে বলছিল, "তোমার বাবা মারা যেতে পারে, আমার কিন্তু ছেলে মারা গেছে। কোন মা কি তার ছেলের মৃত্যুর শোক ভুলতে পারে?পাঁচটা বছর চোখের আড়াল করিনি মানুষটাকে।"