৩০ নভেম্বর, ২০১৪,
এর আগে পর্যন্ত আমার জীবনের সব কিছুই খুব স্বাভাবিক ভাবেই কেটেছিল। গ্রামের একটা স্কুল থেকে মাধ্যমিক আর জেলা শহর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেছি। দুইটা সেমিষ্টার শেষ করেছি সবে। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি আমি, তাই পড়ালেখার খরচ নিয়ে সবসময় চিন্তা করতে হয় কিন্তু রেজাল্ট একটু ভালো ছিল বলে পরিবার থেকে সেভাবে কখনো কিছু বলেনি। সারাদিন ক্লাস করে বিকেলে বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় আবার টিউশানি করাতাম। ভালোই যাচ্ছিল সবকিছু। নতুন পরিবেশ, নতুন সব মানুষ, নতুন একটা শহর। প্রানের শহর। টিউশানি শেষ করে রাতের বেলা যখন রাস্তার সোডিয়াম আলোর নীচ দিয়ে হেটে বাসায় ফিরতাম তখন মনে হতো, "ইশ এই আলোগুলো যদি ঘরে নিয়ে যেতে পারতাম।" সেদিন টিউশানি থেকে ফিরতে বেশ দেরী হয়ে গিয়েছিল রাত প্রায় সারে নয়টা হবে আর এদিকে আমাদের হোস্টেলের গেট বন্ধ হয় দশটায় আমি খুব দ্রুত হেটে যাচ্ছিলাম। একেবারে হোস্টেলের সামনে এসে দেখা হয় আমাদের হোস্টেলের নীলু আপুর সাথে। নীলু আপু প্রতিদিনই এই সময়ে একবার নীচে নামেন। দুইটা কারনে, প্রথমটা হলো আপু রাত্রে ভাত খাননা তাই গরম গরম পরোটা নিতে আসেন আর আরেকটা কারন হলো আপু তাঁর বয়ফ্রেন্ড রাকিবের সাথে দেখাও করেন। নীলু আপুকে দেখে আমাদের এই "মাতৃছায়া" হোস্টেলের এমন কোন মেয়ে নেই যে কথা না বলে থাকতে পারে। আমিও সেদিন সন্ধ্যায় নীলুর আপুর সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে যাই। আর সেই এগিয়ে যাওয়াটা আমার জীবনটা একেবারে বদলে দেয়। রাকিব ভাইয়াকে আমাদের হোস্টেলের সবাই চিনে। সারাদিন নীলা আপুর ঝারির উপরে থাকে বেচারা। মাঝে মাঝে আমরা তাকে নিয়ে হাসির এক হাত বসিয়ে দেই। কিন্তু রাকিব ভাই নীলা আপুকে খুব ভালোবাসে। নাইলে কি আর বেচারা এতো ঝারি খাওয়ার পরেও সম্পর্কটা ধরে রাখে। হোস্টেলের সবাই মাঝে মাঝে আফসোসও করে রাকিব ভাইয়ের মতো ভালোবাসার মানুষের জন্য। কিছুদিন আগেও পাশের রুমের মেয়েটা ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে ব্রেকাপ করেছে, হোস্টেলে এসেই কান্নাকাটি করছিল। নীলা আপু সান্তনা দিতে গেলে সে বলেই ফেলে, "সবাই কেন রাকিব ভাই হয়না।" আজকে রাকিব ভাইয়ের সাথে তাঁর একটা বন্ধু ছিল। রুদ্র নাম। বেশ লম্বা আর স্বাস্থ্যবান। যেকোন মেয়েই তাকে পছন্দ করবে। আমি এর বাইরে পরিনা তাই প্রথম দেখাতেই ভালো লাগে রুদ্র কে।
আমার জীবনের সব কিছু উলটা পালটা করে দেয়ার জন্য এই একটা সন্ধ্যাই দায়ী। কথার মাঝে ডুবিয়ে রাখা এই ছেলেটাকেই মনে হয় আমি এতোদিন খুঁজেছি। হোস্টেলের পাশেই আমরা বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেই। এরপ মাঝে আমাদের পরিচয় হয়ে যায়। পরিচয় হওয়া মানে শুধু নাম জানাজানি হয়। নীলা আপু পরিচয় করিয়ে দেন।
-"হাই আরু।"
-"রুদ্র।"
কিছুক্ষণ পরে আমি রুদ্রর মুখে যা শুনি,
-"ইউ নো হোয়াট আরু?"
-"হোয়াট?"
-"পৃথিবীতে দুই ধরনেও মানুষ বাস করে, প্রথমটা এঞ্জেল! যারা দুনিয়ার সব থেকে কিউট নিষ্পাপ, গার্লস উইথ সানগ্লাস!"
-"আরেকটা?"
-"নরমাল মানুষ মানে বাকি সবাই"
আমি অনেক হেসেছিলাম রুদ্রর কথায়। কিন্ত এই প্রথম কেউ আমার চশমা নিয়ে ডিরেক্ট বা ইনডাইরেক্ট এতো ভালো কথা বললো। আর এতো সম্মান ছিল কথা গুলো বলার সময় যা আমি আগে কখনো কারো চোখে দেখিনি। সারাজীবণ কানি শুনে আসা মেয়েটা আজকে হঠাত এঞ্জেল হয়ে গেলো আমি এই দিনের কথা কিভাবে ভুলি। মনে তো চাচ্ছিল যে এভাবে সারারাত এখানে বসে আড্ডা দেই। কিন্তু গেট বন্ধ হউয়ার তাড়ায় নাকি অন্য কোন কারনে তা হয়ে উঠেনি সেদিন আমি জানিনা। আমি উঠে এসেছিলাম আগেই একটু সামনে আগাতেই রুদ্র আমার পিছে দৌড়ে এসেছিল,
-"চা?"
-"অন্য কোনদিন এখন গেট বন্ধ হয়ে যাবে"
চা আমার এতোটা পছন্দের যে না করতে ইচ্ছে করছিলনা আর রুদ্রর অফার সত্যিই আমি অবাক হচ্ছিলাম কিন্তু কেন যে না করলাম! আমাকে ফলো করে যাচ্ছিল দেখে মোবাইলে রিচার্জের দোকানে ঢুকলাম,
-"আমি নাম্বার লিখে নিচ্ছিনা আরেকদিন তাহলে রাস্তায়ই দেখা হওয়ার অপেক্ষায় থাকি নাকি?"
-"হ্যাঁ যদি আমাদের ভাগ্য ফের আমাদেরকে মিলিয়ে দেয় তাহলে আমরা প্রথমে চা খেতে যাবো।"
বলেই আমি হোস্টেলে ঢুকে যাই। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল, রুদ্র আবার ফিরে এসে মোবাইল নাম্বার চায় কিনা? কিন্তু রুদ্র সেদিন আমাকে আর পিছন থেকে ডাকেনি। রুমে গিয়ে কতবার যে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হয়ছে সেদিন। কি হতো নাম্বার টা নিজে থেকে দিলে! কি হতো এখনি চা খেতে গেলে। এসব ভাবতে ভাবতে সেদিন আমি ডিনার না করেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।
এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। আমি আর রুদ্রকে খুঁজে পাইনি। নীলা আপুকেও জিজ্ঞেস করতে পারছিনা। কিন্তু আমি মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে দেরীতে বাসায় ফিরতাম এখন ফের যদি হোস্টেলের নীচে দেখা হয়ে যায় রুদ্রর সাথে। নীলা আপু আর রাকিব ভাইয়ের সাথে দেখা হলেও রুদ্রকে খুঁজে পেতামনা। একেবারে হাওয়া হয়ে গেলো একজন মানুষ। কিন্তু তাঁর সাথে আমার চা খাওয়ার কথা আছে এভাবে সে হারিয়ে যেতে পারেনা। দেখতে দেখতে আমাদের ওয়ি সেমিষ্টার শেষ হয়ে গেলো। সবাই ছুটিতে বাড়িতে চলে গেলো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল আজকে রুদ্রর সাথে দেখা হবে। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। প্রায় পনেরো দিনের বন্ধ থাকে ক্যাম্পাস। এই সময়ে সবাই বাড়ি চলে যায়, শীত আর শীতের পিঠা খেতে। রুদ্র আমাদের ইউনিভার্সিটিতেই পড়তো। কিন্তু কোনদিন ক্যাম্পাসে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়নি। কিন্তু আমার মন বলছিল আজকে রুদ্র বাড়ি যাবে আমাদের দেখা হয়ে যাবে। দিনের বেলায় জার্নি করতে আমার খুব বিরক্ত লাগে তাই রাত্রে যাওয়া হয় সবসময়। হোস্টেলের সবাই বিকেলের মধ্যে চলে গেছে। আমি একা আছি এই ফ্লোরে নীচ তলায় কয়েকটা মেয়ে আছে অন্য ভার্সিটির। রুদ্র কখন যাবে? দিনে নাকি রাত্রে? এমন কথা মনে হতেই আমি তখন পারলে রুম থেকে বের হয়ে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি এমন লাগছিল।
১৭ই জানুয়ারি ২০১৫,
রাত্রি প্রায় এগারোটার দিকে আমি বাস স্ট্যান্ডে পৌছালাম। শীতের রাত তাঁর উপর এখন সবার স্কুল কলেজ খোলা যাত্রীদের তেমন কোন চাপ নেই। বেশ ফাকা পরিবেশ। আমি সারে এগারোটার বাসে টিকিট নিয়ে কাউন্টারের পাশে এসে এক কাপ চা নিয়েছি মাত্র। প্রচণ্ড পরিমাণে কুয়াশা চারিদিকে। শীতের রাত্রে কুয়াশা ভেদ করে হেডলাইটের আলো তরোবারির মতো আঘাত করে ছুটে চলে দূরপাল্লার বাস। একেবারে সামনের সিটে বসে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরার যে আন্দদ তা বাড়িতে গিয়ে দশদিন থাকার থেকে বেশী প্রভাব ফেলে আমার মনে। আজকেও একেবারে সামনের সিট নিয়েছি আমি যদিও রাতের বেলায় লাইটের আলো চোখে লাগবে দেখে কেউ সামনে সিট নিতে চায়না কিন্তু আমি সবসময়ই নেই।
চা শেষ হয়নি তখনও আমার। পাশে থেকে চাদরে মুখ ঢাকা একজন আমাকে বলছিল,
-"চা?"
-"খাচ্ছিতো!"
-"আমি কিন্তু সেদিনের পরে চা খাইনি"
আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল রুদ্রর সাথে দেখা হবে কিন্তু এভাবে একজন আমার সাথে চা খাওয়ার জন্য এতোগুলো দিন চা না খেয়ে থাকবে সেটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সেই রাতের পর থেকে আমি যতবার চা খেতে গেছে ততবার যে আমারও রুদ্রর কথা মনে হয়নি সেটা না। আমারও রুদ্রর কথা মনে হয়েছে কিন্তু আমি তো চা খাওয়া বন্ধ করিনি। বরং আমার চা খাওয়া বেরে গিয়েছিল, আমি ভার্সিটির আশেপাশে সব চা'য়ের দোকানে চা খাওয়া শুরু করি সময় কাটানো শুরু করি যাতে রুদ্রর সাথে কোন একদিন আমার দেখা হয়ে যায়। রুদ্রর কথার জবাবে আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি চা'য়ের কাপ থেকে চা ফেলে দেই।
-"এবারতো চা খাওয়া যাবে নাকি?"
-"কিন্তু গাড়িতো সারে এগারোটায় মিস হয়ে যেনো না যায়।"
অবশেষে আমাদের চা'য়ের সময় হলো। আমরা চা নিয়ে গোটা একটা মহাকাব্য রচনা করে নিলাম। মুখে কোন কথা নয় শুধু চোখে চোখে গড়ে নিলাম বাকিটা পথ। নীরবতা ভেঙ্গে রুদ্র,
-"একা এতো রাত্রে?"
-"দোকলা হইনাই তাই বলে কি রাত্রের জার্নির মজাটা কি নিতে পারবোনা।"
-"অবশ্যই! আমিও সেজন্য রাত্রেই যাই।"
-"নাকি এভাবে একা কোন রমনীকে পটাতে?"
-"একা কোন রমনী পটে গেলে পরেরবার চা কখন খাবো?"
-"আপনি কথা রেডি করেই রাখেন?"
আমাদের গন্তব্যের কিছুটা পথ একসাথে। একসাথে কিছুটা পথ চলে যে বাকিটা পথ একা যাওয়া কতটা কষ্টের সেদিনের পরে আমি বুজতে পেরেছি। সিরাজগঞ্জ রোড পর্যন্ত আমরা একসাথে যাবো তবে আলাদা বাসে এরপর আমি বগুরা আর রুদ্র রাজশাহী। আমাদের একই কোম্পানির বাস ছাড়বেও একই সময়ে কিন্তু আমরা আলাদা হয়ে যাবো। আর মিনিট পাঁচেক পরে। ধীরে ধীরে আমার মন খারাপ হতে শুরু করে। আমি অনেক দিন ধরে স্বপ্ন দেখেছি, "এমন শীতের রাতে প্রিয় মানুষের সাথে পাশাপাশি বসে বাস জার্নি করবো আর হোটেলের যাত্রাবিরতীতে দুজনে চা খাবো। কুয়াশার মাঝে যখন বাস হারিয়ে যাবে তখন আমরাও হারিয়ে যাবো এই দুনিয়ার সকল কর্মব্যাস্ততা থেকে।"