ডাক্তারি পাশ করেছিলাম দুই বছর আগে। আরো চার বছর আগে পাশ করে বের হওয়ার কথা থাকলেও সেশন জটের কারনে তা আর হয়ে ওঠেনি। প্রায় অবসর ধরা চলে এই সময়টুকু। তবে মেডিকেলের বহির্বিভাগে ভালো সময় পার করেছি। যে বছর পাশ করে বের হয়েছিলাম তাঁর পরের বছরে হয়েছিল ৭০ এর নির্বাচন। পাশ করেই আমি ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগে নিয়মিত বসা শুরু করি। মানুষের কষ্টে তাদের পাশে দাঁড়ানোর যে ব্রত নিয়ে মেডিকেল পড়া শুরু করেছিলাম তা দিনে দিনে সত্যি হতে শুরু করেছিল আমার জীবনে। পাশ করার জন্যই নীলার সাথে বিয়েটা আটকে ছিল। তাইতো পাশ করে বের হতেই বাড়ি থেকে ঠিক করে রাখা নীলার সাথে বিয়ে হয়ে যায়। নীলার বাবা ছিল ঢাকার নামী ব্যাবসায়ীর একমাত্র মেয়ে। আর আমাদের মধ্যবিত্তের কোঠা পার করা সংসার। এসব নিয়ে অবশ্য আমাদের কখনো কোন কথা হয়নি। নীলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের ছাত্রী ছিল। শ্বশুর বাড়ি থেকে গাড়ি পেয়ে যাই বছর না ঘুরতেই। মেডিকেলে যাওয়ার সময় সেই গাড়িতে করে যখন যেতাম তখন বেশ একটা ভাব আসতো মনের ভিতর। আর গাড়িতে লাগানো ছিল ডাক্তারি লোগোর সিল।
সবকিছুই ঠিক ছিল আমার আর নীলার জীবনে। আমি ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে মেডিকেলে যেতাম আবার আসার সময় তুলে নিয়ে আসতাম। আমার দেরী হলেও নীলা আমার জন্য অপেক্ষা করতো। আবার কখনো কখনো রিক্সা দিয়ে মেডিকেলে গিয়ে হাজির হতো। নীলার সাথে আমার বেশীরভাগ কথাই হতো দেশের খবর নিয়ে। আমি সারাদিন রোগীদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকলেও দেশের সকল কথাবার্তা আমি নীলার কাছেই জানতে পারতাম। রাজনীতির সাথে কিভাবে নীলা জড়িত ছিল তা আমি জানতামনা। আসলে আমি কখনো জানার চেষ্টাই করিনি। আমার কাছে মনে হতো ওর যে কাজ করে ভালো লাগবে সেটা করার স্বাধীনতা ওর থাকা উচিৎ। নীলার কাছ থেকে সব খোঁজ খবর শুনতে শুনতে আমি একসময় নীলার খবরের জন্য অপেক্ষা করা শুরু করি। পত্রিকা খুঁজেও যে খবর পাওয়া যায়নি তখন সে খবর মিলতো নীলার কাছে। আমি অবাক হতাম মাঝে মাঝে। নীলাকে জিজ্ঞেস করলে নীলা শুধু হাসতো।
এর মাঝে সাত মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর জ্বালাময়ী সে ভাষণ দিলেন। সারাদেশে তখন স্বাধীনতার স্বপ্ন। মানুষ তখন মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে। তখন থেকে আমি আর আগের নীলাকে খুঁজে পেতামনা। নীলা কেমন জানি বদলে গেছে। আমি বার বার জিজ্ঞেস করতাম কিন্তু নীলা কোন জবাব দিতনা। নীলা এখন বেশ রাত করে বাড়ি ফিরে। অবশ্য এসব নিয়ে নীলার প্রতি আমার কোন অভিযোগ ছিলনা।
নীলা একদিন আমাকে বলেছিল, "আমরা মনে হয় আর বেশীদিন একসাথে থাকতে পারবোনা। আমি তোমার জন্য অনেক প্ল্যান করে রেখেছি।"
আমি নীলার কথায় অবাগ হয়ে বলেছিলাম, "আমার জন্য আবার কি প্ল্যান যা আমাদের একসাথে থাকতে দিবেনা।"
নীলা হাসতে হাসতে বলেছিল, "তোমাকে তালাক দেয়ার কোন প্ল্যান নেই ভয় পাওয়ার কোন দরকার নেই।"
নীলার কথায় আমার বুকের ভিতরে যে ঝড় তুলেছিল সেদিন আমি জানি পৃথিবীর কোন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সে ঝড়ের কারন খুঁজে পাবেনা আর এর মাত্রাও পরিমাপ করতে পারবেনা।
২৫শে মার্চের রাতের পর সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো। এক রাতের নিমিষে সব কিছু বদলে গেলো। পরদিন সকালে মেডিকেলের গেটে ঢুকতেই গিয়েই পরলাম করা চেকিং এ। ভিতরে গিয়ে যা দেখেছিলাম আমি কখনো তা ভুলতে পারবোনা। আমার সারজীবন আমি সেই স্মৃতি বয়ে বেড়িয়েছি। রক্তের কান্নায় বহির্বিভাগ ভেসে যাচ্ছিল। মানুষের আহাজারি আর কান্না। এমন নরকীর হত্যাকাণ্ড। কতজনকে দেখেছি মৃত লাশ নিয়ে বসে আছে ডাক্তারের আশায়। আমি ভিতরে ঢুকেই বমি বমি ভাব নিয়ে দৌড়ে বাথরুমে চলে যাই। নিজেকে শান্ত করে ফিরে আসি বহির্বিভাগে। শুরু হয় আমার যুদ্ধ। এরপরে ঘটে আরো খারাপ ঘটনা। মেডিকেলে কোন রোগী ভর্তি হতে দিতোনা মিলিটারিরা। আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করতাম আর নানা বাহানা বানিয়ে ভর্তি করে নিতাম। মাঝে মাঝে আমরা ঢাকার বাইরে লুকিয়ে কোন গ্রামে গিয়ে মানুষের সেবা করতাম।
ভারতে গঠন করা হলো আমাদের মুক্তিবাহিনী। প্রস্তুতি চলে তাদের যুদ্ধে নামার। আমার গাড়ীতে আমি শেষ কবে উঠেছিলাম আমার মনে নেই। গাড়ি সবসময় নীলার কাছেই থাকতো। ডাক্তারি লোগো লাগানো থাকার কারনে কোথাও তেমন কোন চেক হতো না আমার গাড়ির, আর সেই সুযোগ কাজে লাগায় নীলা। মুক্তি বাহিনীর সব খবরা খবর বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজ করতো নীলা। কিছুদিনের মধ্যে নীলার সাথে যোগ দেই আমি। নীলা তখন একা একা আর নিরাপদ ছিলনা।
একদিন রাত্রে নীলা আমাকে বলে, " মোর্তজা, তোমাকে নিয়ে যে প্ল্যান ছিল এখন তাঁর সময় এসেছে।"
আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম, "আমাকে কি করতে হবে?"
নীলা বলেছিল, "জানো আমি তোমাকে কেন বিয়ে করেছি? তুমি শুধু একজন ডাক্তার তাই তোমাকে বিয়ে করেছি। আমি জানতাম একদিন তোমাকে আমার অনেক দরকার হবে আর সেজন্যই আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। আমার এখন তোমাকে দরকার। দেশের এখন তোমাকে দরকার মোর্তজা।"
নীলার কথায় আমি যেনো নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলাম। আর এই যে নীলাকে আমি চিনতাম তাকে আমি নতুন করে চেনা শুরু করেছিলাম। নীলার প্ল্যান অনুযায়ী আমরা শুরু করি গেরিলা হামলায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করা। আমি গেরিলাদের একটা ক্যাম্পে গিয়ে জানতে পারি আমি একা নই সারাদেশে আমার মতো অনেক ডাক্তার আছে যারা এভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আমি আরো সাহসী হয়ে উঠি ধীরে ধীরে।
এভাবে অনেকদিন কেটে যায়। যুদ্ধ তখন আমাদের অনেক আপনজন দের দূরে নিয়ে গেছে। আমরা হয়তো তাদের এই দূরত্ব আর কোনদিনই কমাতে পারবোনা। দেশের অনেক মানুষ তখন আশ্রয় নিয়েছে ভারতে। ভারতে প্রস্তুতি চলছে আমাদের মুক্তি বাহিনীর। যুদ্ধের প্রস্তুতি। আর এর মাঝে এই খবর বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া আর আহত মানুষের সেবা করার কাজ করে চলেছি আমরা। মানিকগঞ্জের ভিতরে একটা গেরিলা ক্যাম্পে আমি আর নীলা। ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় এগারোটা হয়ে গিয়েছিল। আর তখনই খবর এলো পাশের ক্যাম্পে যেতে হবে। রোগীর অবস্থা খুব বেশী ভালোনা। এক্ষুণি হাসপাতালে নিতে হবে। আমি আর নীলা তাড়াহুড়ো করে সেখানে গেলাম আর তাকে গাড়ির পিছনে নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম হাসপাতালের দিকে। গ্রাম ছেড়ে শহরে ঢুকতেই মিলিটারি চেকপোষ্ট। আমি আর নীলা সেদিন মারা যাবো এটা কনফার্ম জেনেও গাড়ি থামাই নি। ডাক্তারি লোগো লাগানো থাকায় আর গাড়ি সেভাবে চেক করা হয়নি সেদিন। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু বাচাতে পারিনি সেই আহত মুক্তিযোদ্ধাকে যার নামও আমি জানিনা। যাকে আমি ঢাকা মেডিকেল রেখে চলে এসেছিলাম। এরপরে আমি আর কোনদিন যার খোজও রাখিনি।
ডিসেম্বার ৩, ভারতের সাথে পাকিস্থানের যুদ্ধ শুরু। হ্যাঁ আমাদের যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেলো এবার ভারত আর পাকিস্থানের মাঝেও। অবস্থা এবার আরো ভয়াবহ হওয়া শুরু হলো। আমরা আর আগের মতো লুকিয়ে কোথাও যেতে পারিনা। অসহায় মানুষের রক্তমাখা চেহারা তখন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করে। আমি আর ঘরে থাকিনি। নীলাকে আমি এই কথা বলে যাইনি যে আমি চলে যাচ্ছি। নীলা আমার সাথেই চলে যেতো। আমি যাওয়ার আগে নীলাকে একটা ছোট চিরকুঠ লিখে গিয়েছিলাম।
প্রিয় নীলা,
আমি এই রাস্তায় একা যেতে চাইনি যে রাস্তায় তুমি আমাকে নিয়ে এসেছিলে। কিন্তু আমাদের অনাগত যে সন্তান এখনো পৃথিবীতে আসেনি তাঁর কথা ভেবে আমি আর তোমাকে নিয়ে হাটতে পারছিনা। আমি এখানে আমার একটা ছবি রেখে যাচ্ছি তুমি আমাদের সন্তানকে দেখিয়ে বলো, যে তাঁর বাবা একজন ডাক্তার ছিল যে নিজের সন্তান ডেলিবারির সময় থাকতে পারেনি। স্বাধীনতা নিয়ে আসবে আমাদের সন্তান তাকে তুমি স্বাধীনতার গল্প শুনিয়ো।
ইতি,
মোর্তজা।
এর কিছুদিন পরে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। আর আমাদের জন্য শুরু হয় যুদ্ধে আহত মুক্তি সেনাদের চিকিৎসা। সারা দেশের সবাই যখন বিজয়ের আনন্দে মেতে আছে আমরা তখন বিরতীহিন ভাবে চিকিৎসা করে যাচ্ছি। এই বিরতীহিন কাজে যে আনন্দ পেয়েছি তা আমার সারাজীবনে কোথাও পাইনি। এরপরে বাড়ির ফেরার পালা। নীলাকে দেয়া চিঠিটা মিথ্যে করে দেবার পালা। এবার আমি নিজেই আমাদের সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনাবো।
আমাদের বাড়িতে গিয়ে বুঝতে পারি, আমার আর কখনো না নীলাকে আর না আমাদের সন্তানকে! কাউকেই কখনো মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনানো হবেনা। আমাকে খুজতে নাকি মিলিটারি হাজির হয় আমাদের বাড়িতে আর সেখানে আমার বেডরুমটা সেদিন রক্তে ভেসে যায়। আমি খুঁজে পাই নীলার চিঠি,
প্রিয় মোর্তজা,
জানিনা আমি এভাবে কতদিন থাকতে পারবো। প্রতিদিন রাতেই মনে হয় এটাই আমার শেষ রাত। মিলিটারির গাড়ির শব্দ শুনলেই আতকে উঠি। বাবাকে ওরা তুলে নিয়ে গেছে। আমি আর মা সেদিন বাড়ি ছিলাম না বলে প্রানে বেঁচে গেছি। কিন্তু এরপর আর প্রানে বাচবো কিনা জানিনা। তুমি আমার এই চিঠি পাবে কিনা জানিনা, কিন্তু আমি জানি এই কথাগুলো জানার জন্য হলেও তুমি এখানে আসবে আর এই চিঠি পড়বে।
ইতি,
তোমার নীলা।