তিনজন খুন হয়ে গেলো গতকাল রাত পর্যন্ত। একেবারে প্রথমে বাড়ির দারোয়ান অলোক, এরপর মল্লিক সাহেবের স্ত্রী, আর একেবারে শেষ খুনটি হলো গতকাল এ বাড়ির কাজের মেয়েটি। একটা বাড়ির তিনজন মানুষ খুন প্রত্যেক তেরো দিন পরে আর জীবিত মানুষ এখন চারজন। খুনীর সন্দেহে প্রথমে অবস্থান করা পাশের বাড়ির দারোয়ান এর অপশানটা আজকে দূর হয়ে গেলো কারন সে গতকাল রাত্রে পুলিশ হেফাজতে ছিল। তাহলে এই খুন সে করতে পারেনা। কিন্তু তিনটা খুন যে একজনই করেছে সেটাও তো নিশ্চিত না। সেজন্য তাকে আসলে লিস্ট থেকে সরানো যাচ্ছেনা। এরপর আছে বিশ্বনাথ মল্লিকের ছেলে প্রফুল মল্লিক। ক্লাবে জুয়ার নেশা রাত্রে বাড়ির ফেরা। টাকা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। সেই জের ধরে একটা খুনের প্রমান চাপা দিতে একে একে তিনটা খুন। একে লিস্ট থেকে সরানো যাচ্ছেনা। আর একেবারে শেষ ব্যাক্তি হলো ডাক্তার বাবু। মল্লিক বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্রই কাঠের তৈরী এর মাঝে বেশ কিছু পুরাতন সংগ্রহও আছে। সে দিক দিয়ে চিন্তা করলে একে একে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে এই সম্পত্তি দখল করার পায়তারা থাকতে পারে তাঁর।
কাজের মেয়ের খুনের ফোন পেয়ে কিছুটা খুশী হয়েছে অতনু। তাঁর ভাবে মনে হচ্ছে সে আগে থেকেই জানতো যে এরকম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ফোন রেখে সোজা থানায় গিয়ে হাজির হলো অতনু সেন। থানার ব্ড় বাবু গেছেন মল্লিক বাড়িতে লাশ পোস্টমর্টেম করাতে হবে আর প্রাথমিক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে। ট্যাক্সিতে উঠেই একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো অতনু। অণির্বান পাশে থেকে,
-"এই সাত সকালে সিগারেট টা না জ্বালালে হতো না?"
-"সিগারেট টাই চিরযৌবনা বন্ধু"
-"আর খুন হল মল্লিক বাড়িতে আমরা থানায় কেনো যাচ্ছি?"
-"থানায় যাচ্ছি একটা প্রেমের উপন্যাস লেখা শুরু করবো সেটার বাস্তব জ্ঞান নিতে।"
-"সবসময় ফাজলামি ভালো লাগেনা। বলতে না চাইলে বলার কোন দরকার নেই।"
-"পাশের বাড়ির দারোয়ান। কাজের বুয়ার প্রেমিক। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু সংবাদ টা কেমন ভাবে নেয় সেটা নিজের চোখে দেখতে চাই।"
-"এতক্ষণে তো সে নিশ্চয়ই জেনে গেছে।"
-" নাহ। আমি থানায় ফোন করেছিলা যাতে তাকে এই বিষয়ে কিছু না জানানো হয়। আর তাকে ধরা হয়েছে শুধু মদ খাওয়ার জন্য। তাঁর সাথে এই খুনের কোন সম্পর্ক নেই।"
-"কিন্তু তাহলে তো খুনী এই দারোয়ান না?"
-"উফফ অনির্বাণ! এবার থামো। আমরা ওখানে প্রেমের উপন্যাস লিখতে যাচ্ছি।"
অতনু কে চেনা বড় মুশকিল। কখন যে মাথার মধ্যে কি কাজ করে আর কি যে বলে শুধু সেই জানে। এদিকে খুনের রহস্য অনির্বাণের মনের মধ্যে ডাল-পালা গজিয়েছে। থানায় যাওয়ার পরে অতনু শুধু পাশের বাড়ির দারোয়ানের সাথে দেখা করেই বের হয়ে গেলো। তাঁর সাথে একটা কথাও বললো না।
-"কি ব্যাপার! প্রেমের উপন্যাস হয়ে গেলো?"
-"এর সাথে ক্তহা বলা মানে সময় নষ্ট করা।"
-"কেনো?"
-"এর চেহারা দেখলি ভালো করে। এতো ছোট বেলা থেকে এডিকটেড যে এর দ্বরা এখন আর সুঁইয়ের মধ্যে সূতা একবারে ঢুকানো সম্ভব না আর সে করবে এতো সূক্ষ্ণ খুন!"
-"তাহলে এই নামটী এখন একেবারেই বাদ?"
-"হ্যাঁ আপাদত এটা বলা যাচ্ছে যে, প্রেম ট্রেম নিয়ে কোন ঝামেলাই থাকতেই পারে বা খুনের সাথেও এই দারোয়ানের সম্পর্কও থাকতে পারে। কিন্তু খুনী সে নয় এটা নিশ্চিত।"
-"তাহলে এখন তো আমাদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেলো। মাত্র দুইজন থাকলো আমাদের সন্দেহের তালিকায়।"
-"এতোটা সহজ না অনির্বাণ।"
এরপর ডাক্তার বাবু আর প্রফুল মল্লিককে সন্দেহ করা ছাড়া আর কোন অপশান খোলা থাকছেনা। কিন্তু কোন প্রমান ছাড়াতো কাউকে এককভাবে টার্গেট করা যাচ্ছে না। আর কাউকে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে আইনী ব্যাবস্থায়ও যাওয়া যাচ্ছেনা। সব মিলিয়ে একটা গোলকধাঁধার তৈরী হয়েছে।
থানা থেকে বের হয়ে সোজা মল্লিক বাড়িতে হাজির হলো অতনু আর অনির্বাণ। মল্লিক বাড়ির গেটে গিয়েই দেখা হয়ে গেলো বিশ্বনাথ মল্লিকের সাথে। লাঠি হাতে বাইরের দিকে আসছিলেন বিশ্বনাথ মল্লিক। বাড়ির গেটে নেমেই আবার গাড়িতে উঠে গেলো অতনু সাথে অনির্বাণ। কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। বাড়ির ভিতরে না ঢুকেই কেন সে আবার গাড়িতে উঠলো তা কোনভাবেই মাথায় আসছেনা অনির্বাণের। গাড়ি ছাড়তেই মুচকি হেসে অনির্বাণ কে অতনু জিজ্ঞেস করলো,
-"আমরা কোন ঘটনার কি দেখি বা শুনি?"
-"পরিষ্কার! যতটুকু দেখা যায় বা শুনা যায় ঠিক ততটুকই আমরা দেখি বা শুনি।"
-"না অনির্বাণ! সমস্যাটা এখানেই আমরা কখনই একটা ঘটনার যা দেখা যায় বা শুনা যায় তা দেখিনা বা শুনিনা। আমরা আসলে সেটাই দেখি বা শুনি যেটা আমরা দেখতে চাই বা শুনতে চাই।"
-"হ্যাঁ এটা ঠিক। কিন্তু এই ... "
-"সম্পর্ক আছে অনির্বাণ। আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাও আমরা দেখতে পারিনা মাঝে মাঝে।"
-"আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?"
-"আপাদত অপেক্ষা করতে যাচ্ছি।"
-"তোমার এই বিষয়টা নিয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।"
এরপর অতনুকে আর আগের মতো রাত জেগে সেই টেবিলের সামনে বসে থাকতে দেখা যায়নি। সে আর আগের মতো কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত নয়। বরং সে এখন বেশ আয়েশী মেজাজে সময় পার করছে। খুনের রহস্যভেদ করে ফেলেছে সে নাহলে এতো আয়েশী মেজাজে সে থাকতে পারতোনা। কিন্তু খুনী কে? এ নিয়ে হাজার বার কথা হয়েছে অনির্বাণ আর অতনুর। কিন্তু শেষমেশ এক জায়গায় এসেই আলোচনা থেমে যায়। সেটা হলো কোন কিছু জানতে হলে অনেক উপর থেকে ভালো ভাবে দেখতে হয়।
এভাবে গুনে গুনে তেরো দিন কেটে গেলো। তেরো দিনের মাথায় অতনু থানায় ফোন করে অনির্বাণ কে সাথে নিয়ে থানায় গিয়ে হাজির হলো। মল্লিক বাড়ির বাইরে পুলিশ চাই অতনুর। তাঁর ধারনা মতে আজকে রাতেও খুনী আসবে এই বাড়ীতে আগের সবগুলো খুনের আলামত আর খুনের ধরনের তাঁর কাছে এটাই মনে হয়ছে। তাইতো সে এখন খুনীকে হাতে নাতে ধরতে চায়। বাড়ির ভিতরে থাকবে সে আর অনির্বাণ। কোনরকম ঝামেলা হলেই বাইরে সিগন্যাল দিবে আর পুলিশ ভিতরে চলে যাবে। রাত প্রায় সারে বারোটার দিকে পুলিশের ভ্যান বাইরে এসে দাঁড়ালো। আর লুকিয়ে ভিতরে ঢুকলো অতনু আর অনির্বাণ। বাড়ির পিছনের দিকের গেটের সামনে অনির্বাণ কে দাঁড় করিয়ে রেখে লুকিয়ে উপরে উঠে গেলো অতনু। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে প্রফুল বাবুর ঘরের সামনে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে সে।
এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। খুনী আসার অপেক্ষা। রাত্রি প্রায় দুইটার দিকে বিশ্বনাথ মল্লিক তাঁর রুম থেকে বের হয়ে প্রফুল মল্লিকের রুমের দিকে এগিয়ে আসলেন। তাঁর হাতের লাঠি থাকলেও তিনি লাঠি ছাড়াই খুব দ্রুত হেটে চলে আসলেন। প্রফুল বাবুকে না ডেকেই তিনি রুম খুলতে গেলেন সাথে সাথেই পিছন থেকে ডেকে বসলো অতনু। এই ঘটনার জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলেননা বিশ্বনাথ মল্লিক। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
-"আপনি এতো রাতে আমার বাড়িতে কি করছেন? তাও আবার আমাদের বেডরুমের সামনে!"
-"দেখুন মল্লিক সাহেব, অনেক দিনতো হয়ে গেলো আর কতো এবার সবাইকে ডাকি নাকি?"
-"মানে কি বলতে চান আপনি?"
মল্লিক সাহেবের কথায় তেমন পাত্তা না দিয়ে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলো অতনু নীচ থেকে সবাই ডেকে পাঠালো। সবাই রুমে চলে আসলে অতনু সবার উদ্দেশ্য বললো,
-"একজন মানুষের বৃদ্ধ বয়সের সব থেকে কাছের জিনিস কোনটি? তাঁর হাতের লাঠি যেটা সে সবসময় ব্যাবহার করে। যার সাহায্যে সে চলাচল করে। তাই বৃদ্ধ বয়সে মানুষের শখের প্রকাশ ঘটে এই লাঠিতে। সবাই চেষ্টা করে কাঠ বা বেত দিয়ে এই লাঠি বানানোর আর খুব ভালো মানের ডিজাইন করার। কিন্তু আমাদের মল্লিক সাহেব ব্যাবহার করেন স্টিলের লাঠি। যার বাড়িতে সমস্ত আসবাবপত্র কাঠের সে তাঁর হাতের লাঠিতে ব্যাবহার করছে একটা স্টিলের লাঠি। প্রথম দেখাতেই আমার কেমন জানি একটা খটকা লাগে। এরপর এড়িয়ে গেলেও সবসময়ই খুনের হাতিয়ার হিসেবে এর ব্যাবহার কখনই মাথা থেকে সরাতে পারিনি। মল্লিক সাহেব একবার লাঠি টা আমার হাতে দিবেন?"
-"হ্যাঁ মানে এটাতো আমাকে একটা কোম্পানি থেকে দিয়েছিল।"
-"জ্বী আজ থেকে নয় বছর আগে একটা স্টিল কোম্পানি তাদের প্রচারণার জন্য দেশের বিশেষ পাচজনকে তাদের লোগো সম্বলিত এই লাঠি দেয়। যেই পাচটি লাঠির আর কোন কপি নেই। কিন্তু বাকি চারটি লাঠি থেকে এটি ভিন্ন আমি চারটি লাঠি কাছে থেকে নেড়েচেড়ে দেখেছি এই কয়েকদিনে তখনই আমার সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। অন্যান্য লাঠির মাঝে কোণ দাগ নেই। কিন্তু এই লাঠি টা মাঝ বরাবর একটা দাগ আছে আর আমার খুব ভুল হয়ে না থাকলে এই লাঠিটা এখানে দিয়ে খোলা যায়।"
বলেই লাঠিটা খুলে ফেললো অতনু। লাঠি খোলার সাথে সাথে ভেতর থেকে বের হয়ে আসলো একটা নিডেল। নিডেল হলো খুব ধারালো স্টিলের তৈরী এক ধরনের সরু তীক্ষ্ণ তরোবারির মতো বস্তু। যা দিয়ে খুব সহজেই কাউকে আঘাত করা যায়। এবং এই হাতিয়ার সঠিকভাবে ব্যাবহার করতে পারলে খুব সহজেই কাউকে খুন করা যায়। অতনু লাঠি খুলে নিডেল টা হাতে নিয়ে বিশ্বনাথ মল্লিককে বললেন,
-"এবারে তো নিজে থেকে বলুন মল্লিক বাবু। নাকি আমাকেই বলতে হবে।"
-"আমার ভুল গেছে।"
বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন ভদ্রলোক। কিন্তু পুলিশ সামনে থাকায় শেষ রক্ষা তাঁর হলোনা। পুলিশ তাকে নিয়ে গেলো। মল্লিক বাড়ির খুনের রহস্যভেদ হয়ে গেলো কিন্তু বাড়িতে ফিরেও কয়েকটা জিনিস মাথায় আসছেনা অনির্বাণের, কেনো? খুন করলেন মল্লিক সাহেব। আর এই খুনের জন্য পিছনের গেট দিয়ে আসার ব্যাপারটা বা পাশের বাড়ির দারোয়ন এর পালিয়ে যাওয়। অতনুকে উদ্দেশ্য করে,
-"এবারে কি আমার রহস্য উদ্ধার হবে?'
-"মুচকি হেসে অতনু, আমাদেরকে নিয়ে বেশ খেলে যাচ্ছিলেন এই ভদ্রলোক। উনি নিজে থেকে পিছনের গেটের তালা খুলে রেখেছিলেন। আর আমাদের জন্য তখন খুনী সন্দেহ করার মতো দুজন থেকে গেলো। আর এই সুযোগে তিনি আরো কৌশলী হয়ে উঠলেন। তাঁর এই কার্যকলাপ হয়তো তাঁর স্ত্রী কিছুটা বুঝতে পেরেছিল তাই তাঁর স্ত্রীকেও। সেদিন যখন উনার স্ত্রী কিছু বলতে চায় সেটা শুনে উনি কিছুটা ঘাবড়ে যান আর এরপরেই তাঁর স্ত্রী খুন।"
-"আর কাজের মেয়েটা?"
-"একটা খুনের সাথে আরেকটা খুনের সম্পর্ক তেরো দিনের অনির্বাণ।"
-"মানে কি এটার আবার হেয়ালী হচ্ছে।"
-"পরিষ্কার অনির্বাণ, খুনীদের খুন করতে কোন কারন দরকার পরেনা খুনীদের শুধু একটা মানুষ চাই খুন করার জন্য।"
বিদ্রঃ আর এর মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেলো অতনু সেন নতুন রহস্য সিরিজ। আশা করি সামনে আরো ভালো কিছু নিয়ে অতনু সেন আবার ফিরে আসবে। ততদিন অব্দি এটার ভালো লাগা মন্দ লাগা জানাবেন। ধন্যবাদ যারা এই সিরিজটা ফলো করছেন।