গভীর রাত্রে যখন চারিদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনা যায়, আমরা যখন প্রিয় জনের সাথে স্বপ্ন দেখতে থাকি ঠিক সেই মুহুর্তেও কিছু মানুষ গভীর জঙ্গলে অবাধ বিচরণ করে চলেছে শুধু আমাদের এই শান্তির ঘুমে যেনো কোন বাধা না আসে, আমরা যাতে প্রিয়জনদের সাথে স্বপ্ন দেখতে পারি। সেই মানুষগুলো আমাদের সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে নিজের জীবন ঝুঁকিতে রেখে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। প্রতিমুহুর্তে নিশ্চিত বিপদ জেনেও পিছুপা হচ্ছেনা তাঁরা। এরাই আমাদের দেশের বর্ডার গার্ড। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী। আর এভাবে বর্ডারে যেমন তাঁরা তেমনি দেশের অভ্যান্তরেও নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এই প্রহরীরা। দিন-রাত প্রতি মুহুর্তে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে আমাদের।
সাল ২০০৬, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডে সিপাহী হিসেবে যোগ দেন ঠাকুরগাঁও জেলার সদর থানার আনসার আলীর ছেলে জাকির হোসেন। ছোটবেলায় ঠাকুরগাঁ জেলা স্কুলে পড়ার সময় থেকেই স্কাউট দলে যোগ দেন জাকির। তখন থেকেই দেশের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে মনস্থির করেন তিনি। এরপর কলেজে বিএনসিসি তে থাকার সময় সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ রাইফেলস বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে যোগ দিবেন। সীমান্ত পাহারার এই কাজ তাকে খুব আকৃষ্ট করে। কলেজ পাশ করেন ২০০৫ সালে এরপরই ২০০৬ সালে যোগদান করেন বাংলাদেশ রাইফেলসে। ছাত্র হিসেবে খুব ভালো না থাকায় সিপাহি পদেই যোগদান করতে বাধ্য হন তিনি কিন্তু তাঁর কাছে পদবী কোন বড় বিষয় ছিলনা। তাঁর কাছে বড় বিষয় ছিল, দেশ রক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা।
২০০৯ সালে চট্টগ্রামে আসেন জাকির। পেয়ে যান প্রথম পদোন্নতি সিপাহী থেকে ল্যান্স নায়েক। ল্যান্স নায়েক জাকির হোসেন। বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে বারবার তাগিদ দেয়া হয় তাকে। কিন্তু ২০০৯ এ ঘটে বিডিআর বিদ্রোহ। বেড়ে যায় দুশ্চিন্তা। ব্যারাক থেকে কোন ক্রমেই ছাড়া পাননা জাকির। পরিস্থিতি ঠিক হলে ২০০৯ এর অগাস্টে বিয়ে করেন ল্যান্স নায়েক জাকির হোসেন। বিয়ে করে বাড়িতে ছিলেন মাত্র দুইদিন। এরপরেই ব্যারাকে ফেরত আসতে হয় তাকে। ঠাকুরগাঁ থেকে চট্টগ্রাম দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ফেরার সময় বউয়ের একটা ছবি মানিব্যাগের ভিতরে নিয়ে যান জাকির।
এদিকে নতুন বউ, সায়েমার সময় কাটে কেবল স্বামীর ছবি দেখে আর সারাদিন পরে কখনো বা দুই এক মিনিট ফোনে কথা বলে। শ্বশুর শাশুড়ি আছে তাঁর সাথে তবুও একা সায়েমা। ঘরের সব দেয়ালে টানিয়ে রেখেছেন জাকিরের ছবি। স্কাউট দল থেকে শুরু করে চাকরী জীবনের অনেক স্মরণীয় ছবি দেয়ালে টানিয়ে দিয়েছে সায়েমা। নিজেই বানিয়েছে ছবির এলবাম। কখনোবা গভীর রাত্রে পেট্রোলিং এর ফাকে একবার ফোন করে জাকির। ফোনের ওপাশের মানুষটির কথা শুনেই হাজার রকমের স্বপ্ন দেখে রাত কাটে তাঁর।
আর এদিকে নতুন বউকে ঘরে এসে শুধু তাঁর ছবি দেখেই ডিউটিতে চলে যান জাকির। অপেক্ষা করতে থাকেন ছুটির। বছরে একবার বা কখনো দুইবার ছুটি মেলে জাকিরের। ছুটি পেলেই ছুটে চলে যান বাবা-মা'র কাছে। সায়েমার কাছে। চার-পাচদিন বা সাতদিন এর বেশী নয়। এরপরেই আবার ব্যারাকে ফিরে আসেন। শুরু হয় আবার অপেক্ষা। আর এভাবে অপেক্ষা করতে করতে একদিন জাকির অপেক্ষা করতে থাকেন বাবা হওয়ার।
২০১৩ সালে ছেলে সন্তানের বাবা হন জাকির। তাঁর সন্তান যখন নিরাপদে পৃথিবীতে আসলো ঠিক তখন জাকির কে পাঠানো হলো বান্দরবনে। ১০ বিজিবি ব্যাটেলিয়নে। সেখানে যোগপদানের পূর্বে দুইদিন সময় পেলেন জাকির। ছুটে চলে এলেন সন্তানের মুখ দেখতে। আজকে অনেক খুশী জাকির এই দিনটার জন্য তিনি সারা জীবন অপেক্ষা করেছেন। বাবা হওয়ার জন্য না, দেশের কোন এক সীমান্তে যাওয়ার জন্য। আজকে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন থেকে জাকির সীমান্ত পাহারা দিবেন। আর সেই সাথে যোগ হয়েছে বাবা হওয়ার আনন্দ। এরকম আনন্দঘন মুহুর্ত খুব কমই আসে জীবনে। আর তাইতো এই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করে মানিব্যাগের এক কোণায় রেখে ব্যারাকে ফিরে গেলেন জাকির।
৮০৮০ একর পাহাড়ি দূর্গম এড়িয়ার সীমান্ত বান্দরবনের রিমাক্রিতে। ১০ বিজিবি ব্যাটেলিয়নের নিয়ন্ত্রণে এতো বড় এরিয়াতে মাত্র ছয়টা আউটপোষ্ট আছে এখানে। পাহাড়ি দূর্গম এলাকা যাতায়াতের তেমন কোন ব্যাবস্থা না থাকায় আউটপোষ্ট বাড়ানো যাচ্ছেনা। আর সেই সাথে আছে জনবলের অভাব। সীমান্তের ওপারে মায়ানমার। প্রতিদিন পেট্রোলিং চলে জাকিরদের। দশজনের একটা টিম পায়ে হেটে আউটপোষ্টগুলো থেকে বের হন। এরপর আবার ফিরে আসেন। কিন্তু এই ফিরে আসা যে যেকোন দিন আর হবেনা সেটা এখানকার সবাই জানে।
সীমান্তের পেট্রোলিং তো আছেই সাথে আছে লোকাল এরিয়াতে মাদক এর নিয়ন্ত্রণে কাজ করা। মায়ানমার থেকে বিভিন্ন চালানে মাদকের ব্যাবসা চলে এখানে। সব মিলিয়ে ভালো সময় কাটাচ্ছিলেন জাকির। ২০১৪ সালে পেয়ে যান আরেকটা পদোন্নতি। ল্যান্স নায়েক থেকে নায়েক হন জাকির হোসেন। আর এই সময়টাতে সীমান্তে লুট আর মাদকের উপদ্রব বেড়ে যায়। ২০১৪ এর শেষের দিক থে শুরু হয় পেট্রোলিং এ জোড়াদার করা। নায়েক জাকির এখন পেট্রোলিং টিমের কমান্দার হিসেবে থাকেন।
শিফটিং ডিউটি শেষ করে ব্যারাকে এসেই ছেলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন জাকির। ছোট একটা ডায়েরি আছে তাঁর পকেটে মাঝে মাঝেই কিছু একটা লিখে রাখেন তাতে। হয়তো কবে কোথায় কি অপারেশান করছেন সেসব লেখেন। তাঁর জীবনের একটাই ইচ্ছা, তাঁর কিছু হয়ে গেলে যেনো এই ডায়েরিটা তাঁর ছেলের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। ছেলেকে হয়তো তাঁর কর্মজীবনের গল্প বলতে চান বা ছেলে যাতে বাবাকে কখনো মিস না করে সেজন্য।
একজন কমান্ডার যিনি নায়েক পদের সাথে দুইজন ল্যান্স নায়েক আর সাতজন সিপাহীকে নিয়ে দশজনের টিমের পেট্রোলিং চলে নিয়মিত। সেমি অটোমেটিক পিস্তল থেকে শুরু করে ভারী অস্ত্রও বহন করতে হয় এই টিমকে। কখন কোথায় আক্রমন হয় তাতো বলা যায় না। এখানে জীবন সবসময় প্রস্তুত দেশের জন্য উতসর্গ হতে। লড়াই করতে। মাঝে মাঝে পাহাড়ি ডাকাতদের সাথে অথবা মাদক ব্যাবসায়ীদের সাথে লড়াই হয় তাদের।
জাকিরের মতো আরো একজন আছে এখানে নাম, ল্যান্স নায়েক হাবিবুর রহমান। জাকিরের থেকে এক ধাপ নীচে হাবিবুরের অবস্থান, কিন্তু এগুলো জাকিরের কাছে তেমন গুরুত্ব পায়না। জাকিরের হাবিবুর কে হাবিব বলে ডাকে। হাবিবেরও ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বিজিবিতে যোগ দেয়ার। সীমান্তে নিজের জীবন বাজি রাখার। হাবিবের বাড়ি নারায়ানগঞ্জের চাষারাতে। ছমাস হলো এখানে এসেছে সে। এসেই জাকিরের সাথে বেশ খাতির হয়েছে তাঁর। বয়স আর পদবী দুইটাতেই ছোট হাবিব তাই তো সারাদিন জাকিরের নিকট থেকে বিভিন্ন রকমের পরামর্শ নেয় হাবিব।
হাবিবের প্রেমিকা থাকে ঢাকাতে। সরকারি তিতুমীর কলেজে ব্যাবস্থাপনা বিভাগে পড়ে হাবিবের প্রেমিকা, ঈশিতা। দুজনে একসাথে কলেজে পড়েছে একসময়। রোজ দেখা হয়েছে তাদের। আর এখন এতো দূরে থাকে যে ফোনেও কথা হয়না প্রতিদিন। এই এলাকায় ফোনের নেটওয়ার্ক তেমন নেই। অনেক কষ্টে মাঝে মাঝে কথা বলে হাবিব আর ঈশিতা। হাবিবের মানি ব্যাগের কোনায় ঈশিতার একটা ছবি আছে। প্রতিদিন পেট্রোলিং এ যাওয়ার সময় একবার সেই ছবি দেখে নেয় হাবিব।
২৫ অগাষ্ট ২০১৫। আগের রাত্রে ভারী বর্ষণ হয়েছে। পাহাড়ে বৃষ্টি হলে চলাচল করা খুব কঠিন হয়ে যায়। পিচ্ছিল রাস্তায় একবার এদিক ওদিক হলেই ডিরেক্ট খাদে পরে যেতে হয়। এমন সময় সকালে পেট্রোলিং এ বের হলেন ১০ বিজিবি ব্যাটেলিয়নের একটি টিম যেটার নেতৃত্বে ছিলেন ল্যান্স নায়েক জাকির হোসেন। জাকিরের টিমে আরো ছিল নায়েক হাবুবুর রহমান সহ আরো আটজন। সকালের নাস্তা ব্যারাকে সেরে নিয়ে দুপুরের খাবার নিয়ে বেরিয়ে পরেছিলেন তাঁরা। সিপাহীদের একজন রসদ পরিবহণের কাজ করে থাকেন আর বাকিরা সিরিয়াল ধরে হাটতে থাকে। সবার সামনে থাকে কমান্ডার।
সকাল প্রায় সারে নটার দিকে আরাকান সেনারা অতর্কিত আক্রমন করে বসে এই পেট্রোল টিমের উপরে। থানচির বড় মদকে গ্রামের কাছে এই ঘটনা ঘটে। দুই পক্ষের গুলি বর্ষণের এক পর্যায়ে গুলি লাগে জাকির হোসেনের। গুরুতরভাবে আহত হয়ে পরেন তিনি। এর মধ্যে বিজিবি বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তকে সংকট বলে ঘোষণা করে এবং এক ইউনিট বিজিবি আর দুই ইউনিট সেনাবাহীনি পাঠিয়ে দেয়।
আর এরপরেই বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহীনি, বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স মিলে একটা যৌথ অপারেশান পরিচালনা করে যেখানে এক ইউনিট বিজিবি, দুই ইউনিট সেনা এবং এক ইউনিট এফ-৭ এয়ারফোর্স থাকে। শুরুতে আরাকান সেনারা বড়মদক আউটপোষ্ট ঘিরে ফেলে এবং ফায়ার সিজ করে দেয় কিন্তু যৌথ অপারেশান এর সৈন্য আসলে ঘটনা বদলে যায়। আরাকান দের পালিয়ে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায় কারন বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় মায়ানমার সরকার। গুরুতরভাবে আহত হয় আরাকান এর ২৪ জন সৈন্য। আর এদিকে তাইতং পারার সেনা আর স্থানীয় পুলিশও রেড দেয়া শুরু করে। প্রায় সারে বারোটা অব্দি চলে এই দ্বীপাক্ষিক যুদ্ধ।
সব কিছু ঠিক হয়ে যায়। ঝড়ো বাতাসের পরে যেমন প্রকৃতি যেমন আবার আগের অবস্থায় চলে যায় ঠিক সেরকম। কিন্তু ঝড়ো বাতাসে যেমন কোন গাছ ভেঙ্গে পরলে সেটা আর ঠিক হয়না তেমনি আর ঠিক হলোনা জাকির হোসেন জীবন। হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। কিন্তু হেলিকপ্টার হয়তো এতোটা উপর দিয়ে আসে যেখান থেকে উপরওয়ালা খুব কাছে। তাইতো তাঁর ডাকেই সারা দিলেন তিনি। আর যাওয়ার সময় তাঁর ছেলের জন্য রেখে যাওয়া ডায়েরিটা দিয়ে গেলেন হাবিবের কাছে।
আর এভাবেই নিজের জীবন উতস্বর্গ করেন ল্যান্স নায়েক জাকির হোসেন। শহীদ ল্যান্স নায়েক জাকির হোসেন।
বিদ্রঃ ২০১৫ সালের বাংলাদেশ মায়ানমার বর্ডার ক্ল্যাশের সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। এই লেখাটা দেশের সকল স্তরের বিজিবি, সেনা, এয়ার ফোর্স সহ সকল আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহীনির প্রত্যেক সদস্যের প্রতি উতস্বর্গ করছি।