দেখতে দেখতে আজ অনেক বড় হয়ে গেছে রাখি।স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে সে।সবুজ রঙের ফ্রকে বেশ মানিয়েছে তাকে।হিমাংশু টেবিল থেকে রাখির স্কুলে যাওয়ার ব্যাগে সব বই আর কলম পেন্সিল গুছিয়ে দিচ্ছে।স্কুলের সব নিয়ম কানুন বুঝাতে বুঝাতে স্কুলের উদ্দ্যেশে যাত্রা শুরু করেছে বাবা আর পরম আদরের একমাত্র কন্যা রাখি।জগতে গুরুজন এর স্থান হইলো বাবা মায়ের পরেই তাদের কে সম্মান দিয়ে কথা বলবে ,কোন বেয়াদবি করবেনা কারো সাথে,কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ করবেনা বলে বারবার করে বলে দিয়েছে হিমাংশু।
স্কুলে পৌছে মেয়ের ক্লাসরুম খুজে তাকে বসিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো হিমাংশু।বাবার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছে রাখি।চারপাশের সবাই নতুন।নতুন মুখের ভীরে বাবাকে খুজতে ব্যাস্ত সে।নতুন কিছু জানার আগ্রহ রাখির অনেক বেশী আর বাবা বলেছে স্কুলে প্রতিদিনই নতুন নতুন বিষয়ে পড়ানো হয় তাইতো নতুন মুখের ভীড়েও খুব একা একা লাগলেও চুপচাপ বসে আছে রাখি।অন্যদিকে রাখির বাবা এতোক্ষন বারান্দায় দাড়িয়ে ছিল নিজেকে আড়াল করে যাতে রাখি দেখতে না পায়।ক্লাসের স্যার আসতেই তাকে দূর থেকে নিজের মেয়েকে দেখিয়ে দিয়ে সেখানে আর এক মুহুর্তও দেরী করেনা হিমাংশু।
হিমাংশুর চোখের কোনায় জ্বল এসেছে।সুখের কান্না সবাই কাদতে পারেনা।হিমাংশুর বেচে থাকার একমাত্র সম্বল এই মেয়েই তাকে আজকে স্কুলে দিতে এসে যেমন সুখানুভূতি হচ্ছে তেমনি কিছু নিষ্ঠুর অতীতও তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।গত পাচ বছরে রাখির বাবা-মা বলতে একজনই ছিল সে হিমাংশু।নিজের উপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপটা বয়ে গেলেও রাখিকে বুঝতে দেয়নি তা।
মা স্বরস্বতীর বিসর্জনের মাধ্যমে হিমাংশুর ঘরে এসেছিল রাখি।দুর্গাপূজার দশমীর দিনে হাঠাতই প্রচন্ড পেটের ব্যাথায় ছটফট করতে থাকে অনুরাধা।বিসর্জনের ব্যাথা আরো তীব্র হয় হিমাংশুর।বিয়ের পরে এটাই ছিল তাদের প্রথম পূজা।লাল পেড়ে শাড়ী পরেছিল অনুরাধা।বাগান থেকে কিছু বুনোফুল এনে অনুর মাথায় গুজে দিয়েছিল হিমাংশু।আনন্দের সীমা ছিল না তাদের।সন্তান সম্ভবা বাবা মায়ের থেকে খুশীর কিছু এ জগতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
খুব অল্প বয়সে অনুকে বিয়ে করে হিমাংশু।হিমাংশু সবে বি.এ পাশ করে চাকরির সন্ধান করছে, আর অনু মেট্রিক দিবে এমন সময় অনুর বাবা দেহত্যাগ করে।অনুকে ছোট বেলা থেকেই চিনতো হিমাংশু।হিমাংশুর মাস্তেতো বোন হয় অনু।একে অপরকে ভীষন রকমের ভালোবাসতো তারা।অনুর দাদা চেয়েছিল খুব শীঘ্রই বোনের বিয়েটা দিতে তাইতো মেট্রিকের আগেই অনুকে বিয়ে করে ঘরে তুলে হিমাংশু।
তবে ঘরে নিয়ে আসলেও খুব বেশীদিন ঘরে আটকে রাখতে পারেনি হিমাংশু।চারিদিকে সবাই যখন প্রতিমা বিসর্জনে ব্যাস্ত ঠিক তখনই হিমাংশুর ঘরেও চলে বিসর্জন।এক মা বিসর্জিত হয়ে আরেক মা আসে তার ঘরে।দুর্গা মা তার সাথে করে অনুকে নিয়ে যায় আর দিয়ে যায় রাখিকে।
সেদিন রাখিকে কোলে নিয়ে অনুর মুখে আগুন দিয়েছিল হিমাংশু।ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ভেঙ্গে পরে সে।স্বপ্নে গড়া সংসারটা কেবল সুখের ছোয়া পেতে শুরু করেছিল আর এমন সময়ই অনুকে হারিয়ে ফেলে হিমাংশু।কদিন বাদেই মিলিটারির চাকরিতে যাওয়ার কথা ছিল তার।অনেক কষ্টে চাকরিটা পেয়েছিল হিমাংশু।হঠাতই সে সিদ্ধান্ত নিল চাকরিতে যাবেনা সে।চাকরিতে গেলে রাখিকে দেখভাল করার মতো যে কেউ থাকেনা।হিমাংশুর বাবা-মা অনেক বার বলেছিল আবার কারো সাথে ঘর বাধার কথা কিন্তু সে কথায় কান দেয়নি সে।অনুর যায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারবেনা সে।
এদিকে হিমাংশুর বাবার চাকরিটা প্রায় শেষের দিকে।রেলষ্টেশান এর মাষ্টার সে।আসলে পদবিতে মাষ্টার সে নয়।এলাকার সবাই তাকে মাষ্টার বলেই ডাকে।ডাকবেইনা বা কেনো দিনে মাত্র একটি ট্রেন এর যাতায়াত এই ষ্টেশানে।সকালে যে ট্রেনটি যায় সেটিই আবার বিকেলে ফিরতি অথে যায় এই ষ্টেশান হয়ে।এমন মরা একটা ষ্টেশান এর পতাকা উঠায় সে।আর রেলের মাষ্টার সাহেব তার উপর সমস্ত দায়ীত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিজে শহরে গিয়ে বসে আছেন আর মাস গেলে পয়সা তুলে নেন।
বছরখানেক বাদে হিমাংশুর বাবার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।সংসারে একমাত্র আয় করা ব্যাক্তিটিও আজ থেকে আর কোন আয় করতে পারবেনা।হিমাংশু তার বাবার একমাত্র সন্তান।সংসারের এহেন অবস্থাতেও কিছু করতে পারছেনা সে।শহরে গেলে একটা কাজ জোগাড় করে দেবার কথা বলেছিল রেলের মাষ্টার।কিন্তু রাখিকে একা রেখে শহরে যেতে নারাজ হিমাংশু।হিমাংশুর মায়ের বয়স হয়েছে সে এই বাচ্চা মেয়ে খেয়াল রাখতে পারবেনা।আর হিমাংশুও চায় না বৃদ্ধ বাবা মায়ের উপর এতো ঝামেলা চাপিয়ে দিতে।গ্রামের কয়েকটা ছেলেকে পড়িয়ে কিছু টাকা পাচ্ছিলো হিমাংশু।তবে সে টাকায় আর কিছু হচ্ছেনা এখন।বাবার ঔষুধ,সংসারের এই চারটি প্রানের খাবারের ব্যাবস্থা আর রাখির জন্য দুধ কোনমতেই কিছু করে উঠতে পারছিলো না সে।
বাবার ওই চাকরিটা হওয়ার কথা চলছিল মাঝে।কিন্তু মোটা অংকের টাকা ঘুষ না দিলে সেটিও আর হবেনা।আর এতোগুলো টাকা সে কোথায় পাবে।তার বাবা অবশ্য বলেছিল সরকার থেকে তাকে পেনশানের কিছু টাকা দিবে।কিন্তু সে টাকা তুলতেও তার প্রতিদিন শহর গ্রাম শহর করতে করতে হিমাংশুর বৃদ্ধ বাবা এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পরে।
অনু থাকলে অবশ্য এতোটা কষ্ট করা লাগতোনা হিমাংশুর।রাখি,বাবা-মা,সংসারের সব দায়ীত্ব অনুর উপর দিয়ে মিলিটারির চাকরিটা করতে পারতো সে।মাঝে মাঝে হিমাংশু ভাবে কত কষ্টই না করেছে অনু তার জন্য।বিয়ের বছরে মেট্রিক দেবার কথা ছিল তার।কিন্তু পরে টাকার জন্য পরীক্ষাতেই বসতে পারেনি সে।কোন আয় করতে পারতো না হিমাংশু বাবার টাকায় চলতো সংসার।নিজেদের সব শখ আর আল্লাদ তাই শুধু অধোরাই থেকে যায় তাদের।
পাড়ার কয়েকটা ছাত্রকে পড়িয়ে দিন চলছিল হিমাংশুর আর ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল রাখি।রাখির বয়স তখন দু বছর ছাড়িয়েছে।একটুকু দুধ খাওয়ার জন্য সবসময় কান্না করতে সে।হিমাংশু তখন দুধের সাথে পানি মিশিয়ে খাওয়াতো রাখিকে।ক্ষুধা পেটে নিয়ে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যেতো রাখি।
রাখির বয়স তখন বছর তিনেক হবে।ষ্টেশান এর পাসের বাজারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল হিমাংশু।এমন সময় ষ্টেশানের মাষ্টারকে দেখে সে তার দিকে আসছে।তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় হিমাংশু।মাষ্টারকে খুব সম্মান করে সে।বাবার অফিসের বড় কর্তাবলে কথা।মাষ্টার তার কাছে এসেছিল দেবদূতের মতো।সরকার নাকি রেলের সংখ্যা বাড়িয়েছে।তাদের ষ্টেশানে আরো দুইজন মাষ্টার নিয়োগ দেয়া হবে।
খুশীতে এক দৌড়ে বাড়ী চলে আসে হিমাংশু।বাবাকে সব খুলে বলে সে।পরদিন সকালেই বাবাকে সাথে নিয়ে শহরে হাজির হয় সে।রেলের অফিসটাই বদলে গেছে।পুরাতন চেনা জানা লোকগুলো আর নেই।নতুন লোকে ভরে গেছে অফিস।আর নতুন এই নিয়োগের সংবাদে অনেক নতুন আবেদনকারীতে ভরে গেছে অফিস।এই ভীরের মাঝে পিয়ন কে খুজে পায় হিমাংশুর বাবা।যে পিয়ন একসময় সে আসলে দুই পয়সা বকশিশের লোভে তার সব কাজকর্ম করে দিতো সে আজ কথা সুর পাল্টেছে, মুখ চেনাতে আর কিছু হবেনা।সরকার নতুন নিয়ম করেছে পরীক্ষা দিয়ে চাকরী নিতে হবে।পরীক্ষায় বসার জন্য ফরম নিতে হবে সবাইকে লাইনে দাঁড়িয়ে ফরম পুরন করতে বলে সে।পিয়নের কথায় অগত্যা সে দিনের মতো ফরম পুরন করেই হিমাংশু আর তার বাবাকে চলে আসতে হয়েছিল।
এই প্রথম রাখিকে রেখে গোটা একটা দিন বাড়ীর বাইরে ছিল হিমাংশু।সারদিন বাবার জন্য কান্নাকাটি করতে করতে দাদীর কাছে ঘুমিয়ে গেছে রাখি।না রাখিকে আর জাগানো যাবেনা।সারাদিন অনেক ধকল গেছে তার উপরেও।এখন আবার এই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে।কদিন বাদেই পরীক্ষা।হিমাংশু দিন রাত এক করে প্রস্তুতি শুরু করলো।চাকরীটা তাকে পেতেই হবে।এর মাঝে সে পুরাতন সেই মাষ্টারের সাথে দেখা করে রেলের পরীক্ষার সব খোজখবর নিয়ে নেয় সে।বি.এ পাশ করেছে সে,পরীক্ষায় সে পাশ করবেই আত্মবিশ্বস দেয় মাষ্টার।
মাস খানেক বাদেই লিখিত পরীক্ষা হয়ার সপ্তাহ খানেক বাদেই ফলে দিয়েছিল সে পরীক্ষার।খবরের কাগজে নাম এসেছিল হিমাংশুর।খুশীতে আত্মহারা ছিল হিমাংশুর বাবা।রেলেই চাকরী হবে তার ছেলের।সারা জীবন রেলের পতাকা উড়িয়েছে সে আর তার ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, একদিন রেলের বড় বাবু হবে সে। কিন্তু হিমাংশু জানে এখনও অনেক পথ বাকি চাকরী পেতে।এরপরে একটা ভাইবা পরীক্ষার জন্য তাকে ডেকেছে।
মাস দুয়েক সময় পায় সে।এই দুই মাসে সারাদিন সে পরে থেকেছে ষ্টেশানে।জেনেছে রেলের খুটিনাটি সমস্ত বিষয়।রাখিকে ভালো রাখতে হলে এর থেকে ভালো চাকরী যে আর হয় না।এ চাকরীটা হয়ে গেলে গ্রামে থেকেই রাখিকে নিজের হাতে গড়ে তুলেতে পারবে সে।রাখিকে নিয়ে আর কোন দুশ্চিন্তা করতে হবেনা তার।
দুই মাস পরে একদিন চিঠি আসে হিমাংশুর নামে।সে চিঠি নিয়ে পরদিন শহরে যায় হিমাংশু।সারাদিন শহরে থাকে সে।ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় হিমাংশুর।হিমাংশু যখন বাড়ীতে পৌছেছিল তখন সে রাখিকে তার বাবার জন্য অপেক্ষা করতে দেখে চোখের জ্বল ধরে রাখতে পারেনি সে।একমাত্র মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয় সে।একেবারে ছেলেমানুষের মতো হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পরে সে।