কীরাম আছ, বাসন্তী?
উরি আমার কপাল গো! কতদিন পর আইসলে!
আইসো, আইসো, দাওয়ায় উইটে বইসো।
কীরাম আছ বইললে না?
ক্যান? এই যে দেখতিছ না আমার দুই চউক্ষে খুশি কীরাম ঝলমল কইত্তিছে? তুমি আইছ, আর কি আমার খারাপ থাইকপার জো আছে বাউল?
তার মানে, এতদিন তুমি ভালো ছিলে না।
এতদিন? কতদিনের কথা কইচ্ছাও তুমি? কয়দিনের হিসাব রাখিছাও শুনি?
থাউক বাদ দেও, তোমাক আবার কোনদিন দেইখপার পাব সেই আশা তো আমি ছেইড়েই দিয়েছিলাম একদম। আমার যদি একফোটা পূণ্যিও থাহে জীবনে, তার প্রতিদান আমি আইজকে এই পাইলাম, তোমার দর্শনে।
পূণ্যের খরচা থাউক বাসন্তী, তুমি আমাক এট্টু পানি খাওয়াও, হাঁটতে হাঁটতে গলাডা শুকায়া গেছে।
রও। আনি। আরাম কর, জিরাও।
এই নেও, গুড় দিয়ে চিড়ে চাবাও।
আগে পানি দেও, গলা ভিজাই।
অনেক কষ্ট হইছে হাঁটতে, না বাউল?
আ? কষ্ট?
ওরে কেষ্ট তোমায় পাব বলে
আনন্দের সংসারে
সব ত্যাজিয়া শুধুই কষ্ট
লইয়াছি অন্তরে!
ওরে ধরায় সবাই স্বর্গ পেল সম্ভোগের মাঝারে
অলীক স্বর্গের অধিক আশায় আমিই রইলাম পড়ে..
গান পরে, নেও, আগে খেইয়ে একটু স্বস্ত হও।
হুম। দেও, শুধু পানি দেও।
হ্যা গো বাউল, সত্যিই কি আমাক মনে কইরে আইসছিলে, নাকি পথ ভুল কইরলে?
পথ ভুল কইরে আইসলে তোমার নামখান ডাইকলাম কেবা করে কওদিন?
আরি হয় তো! সেই কতদিন আগের একটু আলাপের পরও তুমি দেহি আমার নাম ঠিকই মনে রাখিছাও!
তোমাক কি ভোলা যায়?
হাহ, আমাক আর মনে রাখার কী এমন আছে, বাউল? কীই বা দিবের পাইরছিলাম তোমাক? দিয়েছিলে তো তুমি আমারে, বিনিময়ে নিজে কিছুই নিলে না!
বাসন্তী, তোমার কদর আমার চাইতে ভালো আর কেউ জানে না! কেউ না!
কদর? উস রে বাউল! কদর? কদরই যদি বুইঝতে তবে কি আর আমারে ফেইলে যেতে এ্যাবা করে? শিয়াল শকুনে খেইয়ে ছিবড়ে কইরে গেল অথচ নিজে একবার ছুঁইয়েও দেইখলে না! নারীর কদর তুমি বোঝ না বাউল!
পুরান কথা তুইলে আর কাজ নাই বাসন্তী, আমি যে চোখে দেখি, আমি যে পথে ভাবনার কিশতি চলাই, সে তোমরা বুইঝবে না।
সহজ কথায় কই, যে রূপের মোহে ঘর ছেইড়েছিলাম, সেই রূপোক বিসর্জন দিয়েই আইজ আমি বাউল হয়াছি, আমার আর মোহ নাই কিছুতে।
মোহ নাই তোমার?
মোহই যদি না থাইকপে তয় বাউল হইছ কীসির জন্যি? আন্ধা বৈকুণ্ঠের লোভ তুমি কর না?
তোমরাই আরো বড় লোভী! পরকালের লোভে তোমরা সন্ন্যাসী হইছ, অথচ আমি তো দেহের লীলা কম দেইখলেম না। এই যে, মইরে গেলিপরেই সব শ্যাষ।
না গো, বৈকুণ্ঠের লোভও আমার নেই। স্বর্গে না চাইতেই সব জিনিস পাওয়া যায়, তা জিনিস যদি এমনিতেই পাওয়া যায়, বিনা কামনায়, বিনা কষ্টে, তাইলিপরে আর সে জিনিস ভোগ কইরে আর আনন্দ কী?
ওহ, আমারেও তো এমনি এমনি পাইয়েছিলে, তাই আর ছুঁয়েই দেইখলে না, তাই না? আর যাগের কাছ হইতে এই দেহটারে বাঁচাইবের জন্যি এত তটস্থ ছিলাম, তারাই আমাক লুটেপুটে খাইল শেষতক। ওগের কাছে আমি দুর্লভ ছিলেম বলেই কি আইজ আমি বারবনিতা? এই তোমার বিচার?
বিচার তো আমার নয়। আমার সে সাধ্য কী বিচার ঠিক করি? বিচার করার মালিক তো ওই উপরে যিনি আছেন তাঁর হাতে।
উপরে কে আছে আমারে একটু দেখাইবের পার তুমি? কোন কানা বয়রায় ওইখানটায় বইসে ঝিমায় আমার বড়ো দেইখপার মনে চায়! আমি তারে চিনি না গো বাউল, চিনবের চাইও না। তারে আমি জনমের ডাক, যেতটুকু তার পাইবের হক ছিল, তারচাইতেও কোটি কোটি গুণ বেশি ডেইকেছিলাম সেই রাত্তিরে। কোন আল্লা ভগবান সেদিন আমারে বাঁচাইবের আসে নাই, সারাটা রাইত ওরা আমাক নষ্ট কইরল, আমি সারাটা রাইত ঈশ্বর আল্লা ভগবানরে ডাইকা ডাইকা গলা শুকাইলাম, কোন মায়ের পুতেরও মায়া হয় নাই। তারাও তো কোন মায়েরই পেট থেইকা হইছিল, মায়েরই দুধ খাইছিল। ওগো মায়ের সেই শরীরের সাথে আমার এই শরীরডার কী পার্থক্য ছিল, বাউল, আমাক কইবের পার? হায় রে মানব জনম! জন্ম দিবার এই প্রক্রিয়াডারেই আমার ঘেন্না হয় গো, বাউল। এই কইরাই তো মাইনষের বাচ্চা পয়দা হয়! আর পয়দা হইয়া আবার হেইগুলানেও তো এই একই কামে লিপ্ত হয়। যদি পোলা হয়, সে ভোগ কইরবে, আর যদি মাইয়া হয়, তালিপরে সে ভোগ হইবে! এর বাইরে দুনিয়া নাই গো, বাউল!
চোখের পানি মোছ, বাসন্তী। যে দুনিয়ায় তুমি এখন আছ, যে দুনিয়া তুমি প্রত্যেকটা দিনে রাইতে দেখতেছ, এইটাই সব না। ভোগের লিপ্সা ছাড়াও দুনিয়া আছে। সেই দুনিয়াডা আরো বেশি সত্য, আরো বেশি বড়ো, আরো বেশি সুন্দর। এই যে আমাক দেখ, তুমিই তো সাক্ষী, আমার মধ্যে দৈহিক কামনা নাই।
অনেক সইছ তুমি। আর না। আমি তোমাক ওই সুন্দর দুনিয়াটায় লিয়ে যাব বাসন্তী, তুমি শুদ্ধতার নতুন আলোতে পবিত্র হবা আবার।
হয় গো, হয়, আমার বিশ্ব্যেস হয়। তোমার কথাই আমার বিশ্ব্যেস হয় শুধু। আমি আল্লা খোদা ভগবান কাউরেই দেহি নাই, কাউরেই ডাইকে পাই নাই, এক তোমাকই দেখিছি, তুমিই ডাক শুইনলে। এবার তালি আমাক এট্টু দয়া দেও, আমাক লিয়ে চল এই প্রতিটা রাইতের গতরে গতরে কামড়াকামড়ি আর ধস্তাধস্তির দুনিয়া থেইকে। আমিও তোমার পথে, তোমার সাথে সাথে হাঁটবের চাই গো বাউল, বেশ্যা বইলে ঘেন্নায় বুকে জড়াইবের না পার, দাসী করে পায়ের কাছে এট্টু ঠাঁই দিবের পাইরবে না? আমি আমার বাকিটা জীবন তোমার সেবা করেই কাটাই দিবের চাই। কও, লিবা আমারে সত্যি?
হুম লিব।
তাইলি চল, আমি এখনই রাজি।
না গো, এখন না। আমাক সাতদিনের সময় দেও, আমি আমার গুরুজির অনুমতি ছাড়া তোমাক লিবের পাইরব না।
ওহ। তাইলি পরে আমি কী করব এখন? স্বপ্ন দেখলাম খালি?
না, স্বপ্ন না। এই যে আমি আবারও তো আইসলেম। পরেরবার তিন বারের বারে তোমাক একবারে লিয়ে যাব বাসন্তী।
হয়, আমার বিশ্বাস হয়। তোমাক আমার বিশ্বাস হয়।
আসো, আইজ আমি তোমাক ছুঁইয়ে প্রতিজ্ঞা কইত্তিছি।
ইস বাউল! তুমি আমাক সত্যিই ছুঁইলা আইজ? আমার জনম সার্থক হইল আইজ। এই আমি তোমার হাতে পবিত্র হইলাম গো।
কাইনবে না। আমি তাহলি এখন যাই। যাবার সময় কানতি নেই।
এট্টু দাঁড়াও, তোমারে প্রণাম করি।
সত্তর বছরের বুড়ি বাসন্তী গতকাল মারা গেছে। ও নিঃসন্তান, ভিক্ষা করত। কীভাবে কী হয়েছিল, আমি সবটা জানি না। শুধু জানি, বাউলটা আর ফিরতে পারেনি। কিন্তু বাসন্তী তার কথা রেখেছিল, বাউলের পথ সে না চিনলেও নতুন পথ সে নিজেই খুঁজে নিয়েছিল। হ্যাঁ, যে পবিত্রতা বাউলের স্পর্শে সে প্রাপ্ত হয়েছিল, তার মর্যাদা সে রেখেছিল, আর কোন পুরুষ তাকে ছুঁতে পারেনি।