সর্দি হয়েছে, ডাক্তার বললেন— হিসটাসিন খাও, রোগী মেনে নেয়। কিন্তু ডাক্তার যদি বলে, সর্দি কেন হল সেটা বের কর এবং ভবিষ্যতে যাতে আর না হয় সেই ব্যবস্থা নাও— তবে যে রোগীর কেন গা জ্বলে ওঠে বুঝি না।
ধর্ষণের ব্যাপারেও হয়েছে তাই।
ধর্ষণ হয়েছে, আমরা নাক সিটকাই, ভদ্রতার ব্যানার গলায় টাঙিয়ে ধর্ষকের বিচার চাই— এ পর্যন্ত ঠিক আছে; কিন্তু ধর্ষণের কারণ খুঁজতে গেলেই সমস্যা!
তবুও আমি মনে করি, কারণ খোঁজা আমাদের দরকার।
ধর্ষণের কারণ হিসেবে মেয়েদের পোশাকের প্রতি কটাক্ষ করা হয়। কতখানি যৌক্তিক এই দোষারোপ?
ভাবুন তো, আপনার সামনে দিয়ে একটি অর্ধনগ্ন পোশাক পরিহিতা যুবতি হেঁটে যাচ্ছে আর অমনি কি আপনি তাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হবেন?
উত্তর অবশ্যই 'না'।
তবে প্রতিক্রিয়া একটা ঠিকই হবে আপনার মনে। ভদ্ররা কেউ নাক কুচকাবেন, বখাটেরা টিটকারি ছাড়বে, কেউ বা ভিড়ের মধ্য মেয়েটিকে স্পর্শ করার চেষ্টা করবে— এও মিথ্যে নয়।
কিন্তু ধর্ষণ?
এটি আসলে অনেক বিরাট ব্যাপার।
একটি পুরুষ ধর্ষণের মানসিকতায় উপনীত হওয়া মানে সে আর মানুষ নেই। আর মনস্তত্বের এই ধাপে পৌছালে তা সংশোধনের সম্ভাবনাও অলীক। এক্ষেত্রে সে আসলেই পাগলা কুকুরের মত বিপজ্জনক। আর পাগলা কুকুরের প্রতিবিধান— ওটাকে গুলি করে হত্যা।
আসুন ধর্ষণের কারণ খুঁজে দেখি :
♣ ধর্ষণ কী?
— মানুষের যৌন উদ্দীপনার ভয়ানক বিকৃত এবং দুঃসাহসী রূপ এটি।
ভাবুন তো, এটিকে উস্কে দিতে কী কী নিয়ামক কাজ করে?
একজন নারী কামোদ্দীপক শরীর কিংবা পোশাকে সজ্জিত হলে তা পুরুষের বাসনাকে আলোড়িত করে, এটা সত্যি। পুরুষটি বড়জোর তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতে পারে, সখ্য স্থাপনে উত্সুক হতে পারে, তার প্রেমে পড়তে পারে; কিন্তু ঝাঁপিয়ে যদি পড়ে, তবে সেটা একান্তই ঐ পুরুষের মানসিকতার দোষ, মেয়েটির নয়।
যদি মেয়েটিরই দোষ হত, তবে তো সব পুরুষই ধর্ষণ করত, সেই পুরুষটি শুধু কেন?
অবাধ ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট, পর্নোগ্রাফি, চটিবই (চটিসাহিত্য নয়) ইত্যাদিকে ধর্ষণের কারণস্বরূপ দেখানো হলে একদল মানুষ ক্ষেপে ওঠে; তাদের যুক্তি, যখন স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট, পর্নোগ্রাফি ছিলো না তখন কি ধর্ষণ সংঘটিত হয়নি?
আমিও বলি, হয়েছে।
অতএব, তারা চায়, তাদের নির্বিঘ্নে ওসব দেখতে, পড়তে দেয়া হোক।
নারীর অশালীন পোশাক নিয়ে কথা বললেও এরা প্রতিবাদ করে, কেননা ওসব বন্ধ হলে তো ফ্রিতে আর শরীর দেখা যাবে না!
পরুক আর দেখুক তারা।
ব্যাপার অত্যন্ত জটিল।
ধর্ষণ হয় দুর্বলের ওপর সবলের।
পর্ন দেখে উত্তেজিত হয়ে কেউ পর্ন্স্টারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না, রাস্তার তীব্র যৌন আবেদনময়ী তন্বীটিকে দেখে নারী পিপাসু বিকৃত লোকটি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পায়না, তবে ভেতরে ভেতরে তাতায়, অঙ্গার জ্বলতে থাকে। আর তা এসে অগ্নি বর্ষায় ঘরের অসহায় কাজের মেয়ের ওপর, কিংবা তারই অনুগ্রাহী কোন নারীর ওপর।
অতএব এসব নিঃসন্দেহে ধর্ষণের পশ্চাত্ কারণ। অপনারা না মানলে সেটা আপনাদের অতিবিচক্ষণতা।
আর সব অপরাধীর মতই একটি মানুষ ধর্ষক হয়ে জন্ম গ্রহণ করে না। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার যৌন আবেদন ধীরে ধীরে তীব্র হয় এবং বিকৃত হয়ে ওঠে, আর তারই দুঃসাহসিক বহিঃপ্রকাশ হল ধর্ষণ। আপনারা যদি ভুলে গিয়ে বিরক্ত হয়ে থাকেন, তবে আমি আবারও স্মরণ করিয়ে দিই, প্রথমেই আমি বলে রেখেছিলাম, একজন লোক ধর্ষণে আগ্রহী হয়েছে মানেই হল সে বাঁচার অধিকার হারিয়েছে। ধর্ষকের সমাজে বাঁচার অধিকার নেই।
মানুষে মানুষে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ চিরন্তন। ইন্টারনেট, পর্নোগ্রাফি যখন ছিল না তখনও ধর্ষণ হয়েছিল, তখনও মানুষের এই যৌন বাসনা ছিল, তখনও দুর্বল সবলের তারতম্য ছিল।
যৌন বাসনা সবারই থাকে, আর তা চরিতার্থ করতে প্রেম নামক একটি নাটক আছে, বিয়ে নামক একটি সমাজস্বীকৃত বন্ধন আছে, আর সেসবে না গিয়ে সরাসরি বলাত্কার করতে যাওয়ার মত বাসনা নিঃসন্দেহে পাশবিক বৃত্তি।
আমি ধর্ষণের দুইটি দিক বলছি :
১. মানুষ যখন সৌন্দর্য চর্চা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, আর সেই সঙ্গে সে বঞ্চিত, তিরস্কৃত হয়, তখন সে তার গ্লানির দরুণ ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয়। ভালোবাসা না পেয়ে না পেয়ে তার মধ্যে এই ধারণা জাগে যে, সে ভালোবাসার নেহায়েত্ই অযোগ্য; সুতরাং তাকে দস্যু হয়েই ভালোবাসা আদায় করতে হবে।
২. মানুষ যখন হাতে ব্যাপক ক্ষমতা পায়, তখন তার মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা জন্ম নেয় এবং সে বহুগামিতা এমনকি ধর্ষণের দুঃসাহস করে। এই ক্ষমতা আর্থিক, রাজনৈতি, সামাজিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিকও হতে পারে।
প্রতিকার:
¯¯¯¯¯¯¯¯¯¯¯¯
১. ইদানিং মানুষকে ধর্মের বাণী শোনালে বিরক্ত হয়। তবুও বলি, ধর্মের চেয়ে আত্মশুদ্ধির আর কোন ভালো উপায় নেই।
২. যাবতীয় কুচিন্তা জন্ম নেয় অলস মস্তিষ্কে। একজন কর্মব্যস্ত মানুষ এই দিক দিয়ে কম মানসিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিগ্রস্ত থাকে।
৩. নির্জনতা যৌনতার মহোদ্দীপক। তাই মানুষের মধ্যে থাকতে চেষ্টা করুন।
৪. পর্নোগ্রাফির শীত্কার এবং চটি নামক অশ্লীল গল্পের বই মানুষকে সর্বাধিক বিকৃতির দিকে ধাবিত করে। চটিতে দেখানো হয় নারী মাত্রই যৌন পিয়াসী, কেবল একটু ছুঁয়ে দিলেই যেন এরা নিজেকে খুলে দিতে রাজী হয়ে যাবে! অত্যন্ত ভ্রান্ত উপাত্ত এটি। এর দ্বারা যুবকগণ ভীষণভাবে বিপথগ্রস্ত হতে পারে। সরকার কেন যে ফুটপাথ হতে এই বইগুলো উঠিয়ে নিচ্ছে না আজো জানা যায়নি।
আসুন আমরা অন্তত ব্যক্তিগতভাবে এসব বর্জন করি।
আপনি এখন ধর্ষক নন, কিন্তু এসবে যে আপনার মাথা বিগড়াবে না— সে অনিশ্চয়তার কথা আপনিও জানেন।
৫. যারা পঁচে গেছে তারা মরবেই। এই পঁচন নিজ থেকে গন্ধ না ছড়ালে তা আমাদের জানার উপায় নেই। আমরা গন্ধের প্রতীক্ষায় রইলাম, গন্ধ পাওয়া মাত্রই উপড়ে ফেলব ঐসব বিষবৃক্ষ। যে বৃক্ষ নষ্ট হয়েছে সে তো গেলই, তবে যে চারাটি আমাদের সম্মুখে আছে আসুন আমরা সেই শিশুগুলোকে সুন্দর ভাবে পরিচর্যা করে ফলদায়ক বৃক্ষে পরিণত করে তুলি। শিশুর প্রতিপালন ও মনন নিয়ে অন্য একটি পোস্টে বিস্তারিত বলব।
৬. সর্বশেষ যে প্রতিবিধান, তা হল প্রকাশ্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। যা দেখে ভদ্রবেশী ধর্ষকেরা আতঙ্কিত হবে, নিভৃতে ঠকঠক করে কাঁপবে এই ভেবে যে, ওহ খোদা, এই ভুল যেন আমার কোনদিন না হয়।
ধন্যবাদ।