দৃশ্যপট ১.
মেলা বা লঞ্চঘাটের গেইট। অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে, যেন সবাই খুব ব্যগ্র ভেতরে ঢোকার জন্যে, সবারই খুব তাড়াহুড়া, অথচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মানুষগুলো ওখানেই ঘুরঘুর করছে। এরা ঢুকবেও না, বেরও হবে না; কেবল যখনই এক বা একাধিক মেয়ে বা মহিলা (বয়স যাই হোক, গায়ে তুলতুলে বা ধরার মতো মাংস থাকলেই হলো) সে গেইট দিয়ে ঢুকতে বা বের হতে যায়, তখনই সেখানকার ইতস্তত ঘুরতে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে ব্যস্ততা জাগে, তারা ধাক্কাধাক্কি আরম্ভ করে এবং তার সুবাদে গমনোদ্যত মেয়ে বা মহিলাগুলোকে যে যেভাবে পারে, যেখানে পারে একটু হলেও স্পর্শ বা মর্দনের প্রাণপণ কর্মটি করে।
দৃশ্যপট ২.
বাস স্টপ। গেইটের মতোই অবস্থা। এখানেও কোট টাই পরা, ঝকঝকে, ফিটফাট শিক্ষিত ছাত্র, চাকুরে যুবক হতে মাঝবয়েসী মুরুব্বি; আবার নোংরা, ঘামে ভেজা স্যাঁতস্যাতে জামার হলদে দেঁতো পুরুষও গলা উঁচিয়ে বাসের অভাবে করুণ, হতাশ ও বিপদে পড়া চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এরমধ্যে অর্ধশত বাস আর একশোরও বেশি বিভিন্ন বয়স, আকৃতি ও রঙের মেয়েলোক চোখের সামনে দিয়ে আঙুলের খামচি বা স্পর্শ নিয়ে পার হয়ে (পেয়ে) যায়!
এসব দৃশ্য আমরা নিত্যই দেখি। চোখ এড়িয়ে যাই বা যায়।
ভীড়ের মধ্যে কী কী হওয়া সম্ভব তা আমরা নারী পুরুষ উভয়েই কমবেশি জানি।
তবে আমি আপনাদের বলব তীক্ষ্ন আঁচড়দার কিছু দৃশ্যের কথা, যার সঙ্গে পরিচয় আপনাদের সম্ভবত এখনও ঘটেনি।
পিতা তাঁর কন্যার হাত মুঠো করে ধরে ভীড় পার হচ্ছিলেন। পেছন থেকে যে মেয়ের শরীরে ঠোকরাঠুকরি চলছে সেটা বাপ ও মেয়ে উভয়েই টের পাচ্ছে। দুজনেরই মাথা হেঁট। এখানেই শেষ নয়, ভীড়ের ব্যস্ত ভদ্রলোকগুলো ঠেলাঠেলির একপর্যায়ে একদম চোখে চোখ রেখে, সামান্য চক্ষুলজ্জারও দোহাই না মেনে বাপের হাত থেকে মেয়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হারিয়ে গেল লুটোপুটিতে। অসহায় বাপ যে ক্ষুব্ধ গর্জনটি ছাড়লেন তাকে আর্তনাদও বলা চলে না, তা নিতান্ত অসহায় গোঙ্গানি।
মা ও মেয়ে ভীড়ের মধ্যে হাঁটার সময় মেয়ের সামনে মায়ের গায়ে হাত! কী যে নিদারুণ অভিশাপ তখন ভেতরে ভেতরে উচ্চারিত হয় তা যদি লোকগুলো বুঝত!
এক মেয়ের বইমেলাতে গিয়ে ভীড়ের কবলে পড়ে অর্ধবিবস্ত্র হবার মতো ঘটনাও এদেশে ঘটেছে!
ভদ্র রুচিবান পুরুষগুলোর হাতে পিষ্ট হয়ে ওড়না হারিয়ে ফেলার ঘটনাও একটি দুটি নয় এবং নতুনও নয়!
ইউরোপে একদল বিকৃত বখাটে ছিল যাদের কাজ হতো ভীড়ের মধ্যে মেয়েদের শরীরে ব্লেড দিয়ে পোচ দেওয়া, কিংবা জ্বলন্ত সিগারেট ঠেসে দিয়ে পালিয়ে যাওয়া! শোকরিয়া যে আমাদের দেশে এখনও অতটা পৈচাশিকতার প্রাদুর্ভাব ঘটেনি।
সমস্যাগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এবারে আসুন ভাবি, এর প্রতিকার কী?
প্রতিকার খুঁজতে হলে আমাদের এর মূলে দৃষ্টিপাত করতে হবে, ভেবে দেখতে হবে, যারা এই গর্হিত কাজে অংশ নেয় তারা আসলে কারা? তারা কেন করে এমন? কী তাদের মনস্তত্ত্ব?
ভীড়ের মধ্যে মেয়েদের লাঞ্ছিত করার এই দলের মধ্যে প্রথম শ্রেণীস্বরূপ যাদের কথা বলা যায়, তারা বখাটে ছাত্রের একটি অংশ। এরা সাধারণত পোশাক পরিচ্ছদে এবং চোখের দৃষ্টিতে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে থাকে। কৈশোর চেতনার যৌনতা ও নারী শরীরের প্রতি কৌতূহল তাদের মধ্যে বাসা বাঁধলে তারা ভীড়ের মধ্যে শরীর চাখার এই সুযোগটি নিতে চায়। প্রথম দুয়েকবার সফলভাবে কারো গায়ে হাত দিতে পারলে পরবর্তীতে এটা তাদের কাছে এক ধরনের এডভেঞ্চারে পরিণত হয় এবং তারা সাহস পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে এই অভিযানে অংশ নিতে থাকে। কিশোর বখাটেদের দল বেঁধে কেবল এই উদ্দেশ্যে মেলা বা অন্যান্য জনসমাগমে বিপুল উৎসাহে আগমন করতে দেখা যায়। এবং তারা একজন আরেকজনের আদর্শের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কে ক'টাকে হাত লাগাতে পারল তার লোলুপ বর্ণনা দিয়ে অন্যদের মাঝে উদ্দীপনা সঞ্চার করে। পরস্পরের মধ্যে একটা স্কোরিংয়ের বা পাল্লা দেওয়ার চেতনা কাজ করে।
অতএব খেয়াল করুন, দুয়েকবার হাত দিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে এদের সাহস বাড়তে থাকে এবং পরবর্তী সময়ে এরাই চাকুরী জীবনে প্রবেশ করেও পুরনো অভ্যাস ও সাহসবশতঃ এই নিপীড়নের কাজটি সুচতুরভাবে করে যেতে থাকে। এরাই হয়ে ওঠে ভীড়ের মধ্যে বা ব্যক্তিজীবনের অন্তরালে যৌন নিপীড়নকারী শিক্ষিত চাকুরীজীবী দ্বিতীয় শ্রেণী!
তাই প্রাথমিক পর্যায়ের ওই কিশোরটিকে থামিয়ে দিতে পারলে, একটা সমুচিত শিক্ষা দিতে পারলে সে হয়ত আগামীতে আর এই পথে এগোবে না।
ভীড়ের মধ্যে এভাবে গা ছোঁয়ার ব্যাপারটি দুইভাবে একজন যুবক বা পুরুষের চেতনায় প্রবিষ্ট হতে পারে।
১. অন্যকে দেখে উৎসাহিত হয়ে,
২. অসতর্ক মুহূর্তে একবার কারো গায়ে হাত লাগার পরে অপরপক্ষের কোনরূপ প্রতিক্রিয়াহীনতা বা নির্লিপ্ত ভাব যা তার মনে আরেকবার হাত দিয়ে দেখার সাহস যুগিয়ে দেয়।
আপনারা কি প্রতিকারের অভাসটা পাচ্ছেন?
যাইহোক, তার আগে মধ্যবয়সী লম্পটগুলোর কথাও একটু বলি। সাধারণত এই লোকগুলোর ঘরে গেলে দেখা যাবে বৌয়ের শরীর বিধ্বস্ত। বুড়িয়ে যাওয়া বা ভেঙে যাওয়া ভাজ পড়া চামড়ার বৌ তাদের। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলব যখন দাম্পত্য সম্পর্ক ও কৌশল শীর্ষক প্রবন্ধটি পেশ করব তখন। আপাতত বুঝলে বুঝুন, না বুঝলে চুপ থাকুন, পরের প্রবন্ধের অপেক্ষা করুন।
খেয়াল করে দেখবেন, মধ্যবয়সী লম্পটগুলোর বৌদের বেলায় আমি "সাধারণত" বিশেষণটি ব্যবহার করেছি। অর্থাৎ তাদের সবার বৌই যে বিধ্বস্ত অসুন্দর তা মোটেই নয়। মাঝবয়সী এই লম্পটগুলোর মধ্যে অনেক টকটকে সুদর্শন অফিসার টাইপ ব্যক্তিকেও দেখা যায়, শরীর স্বাস্থ্যে এটাও অনুমান করা যায় যে তার ঘরের স্ত্রীর অবস্থাও তথৈবচ সুগঠিত সুন্দর। দেখা যাবে, তার নিজেরও টকটকে সুন্দরী যুবতী মেয়ে আছে! এই লোকগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী বা মনস্তত্ব এতই ঘৃণ্য যে তা আর বলতে ইচ্ছে হয় না। অবশ্যই এদের পকেটে টাকা ছিল এবং সারাটা জীবন তারা টাকার কারিশমায় রাতকে রাত নারীর শরীর চেখেছে এবং একটা পর্যায়ে বাদ যাবে না একটি মেয়েও টাইপ একটি মনোভাব নিয়ে যাকে পায় তাকেই অন্তত একটু ছুঁয়ে টেইস্ট (Taste) করার চেষ্টাটি হলেও করে!
মনস্তত্ত্ব ও প্রকরণ নিয়ে যথেষ্ট বলা হলো। এবারে তবে প্রতিকার নিয়ে বলা যাক। কিন্তু এ পোস্টে আর পাচ্ছেন না তা। স্পেইস শেষ। অপেক্ষা করুন পরবর্তী পোস্টের!