বিকেলের আগের সময়টাতে গোলাম আলীকে দেখা যায় না তেমন।জনশ্রুতি আছে রাতভর তিনি পানাহারে ব্যস্ত থাকেন এবং দুপুর অবধি নিদ্রামগ্ন থাকেন।
বাদ আছর হাওয়াই শার্ট আর জিন্স পরে লেফাফাদুরস্ত ভঙ্গিমায় তিনি গলির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চক্কর দিতে থাকেন এবং কিছুক্ষণ পরপর গলির ভাসমান চায়ের দোকান হইতে চা এবং গোল্ডলিফ সিগারেট ফুকতে ফুকতে সময় পার করেন।জিন্স প্যান্টটা তুলনামূলক লুজ বিধায় বেল্ট দিয়ে একপ্রকার দড়ির মত বেধে রাখেন।রোজ বিকেল থেকে রাত দশটা অবধি তার একই রুটিন।
গণহারে চা সিগারেট ফুকলেও দাম পরিশোধে তার ব্যাপক অনীহা।ছাব্বিশ টাকা বিল হইলে বিশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে আসমান দেখতে দেখতে উধাও হয়ে যান। বাকী টাকা আর কোন দিন পরিশোধ হয়না।
ম্যান ফ্রম বরিশাল সাচ্চুর দোকানেই তার এই মজমা চলে বেশি। ব্যবসা টিকিয়ে রাখার দায়ে দাতে দাত চেপে সব সহ্য করে সাচ্চু। কিন্তু একদিন বিকেলবেলা বিদ্রোহ করে বসে সে।
যথারীতি টুলে বসে চা সিগারেটের ফরমায়েশ করে গোলাম আলী। অন্য খদ্দেরদের চা বিলাতে থাকা সাচ্চু সাফ জানিয়ে দেয় তার দোকানে এসব কারবার আর চলবে না।
গোলাম আলী প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ঝিম মেরে আসমান দেখতে থাকে। মিনিট পাচেঁক পরে আবার চা চায় সে।সাচ্চুও চা নেই বলে জানায় আবার।আরও একবার একই কাহিনী ঘটে।বিদ্রোহ ভাব বজায় থাকে সাচ্চুর চেহারায়।গোলাম আলী প্রস্থান করে একসময়।
পরদিন বিকেল বেলা গোলাম আলী এবং সাচ্চুকে একই ভূমিকায় দেখা যায়।
রাস্তায় চক্কর অব্যাহত থাকলেও গোলাম আলীকে সাচ্চুর দোকানে আর দেখা যায় না কয়েকদিন।
সপ্তাহ পরে বেশভূষায় কিছু পরিবর্তন দেখা যায় সাচ্চুর। সারা বছর খোচা খোচা দাড়ি সমেত সাচ্চু ক্লিন শেভ করে চুলে কলপ দিয়ে ফিটফাট থাকার লড়াইয়ে নামে।
ঘটনা পরম্পরায় জানা যায় গোলাম আলী আর সাচ্চুর দ্বৈরথ মিটে গেছে। গোলাম আলী এক বিকেলে সাচ্চুকে জানায় দ্বিতীয় বারের মত বিয়ে করতে যাচ্ছে সে। ময়মনসিংহ জেলায় পাত্রীর বাড়ি।গোলাম আলী সাচ্চুকে বর যাত্রী হিসেবে যাওয়ার জন্য তৈরি থাকতে বলে। এই সংবাদে চাওয়ার পূর্বেই গোলাম আলীকে চা সিগারেট বাড়িয়ে দেয় দিলখোশ সাচ্চু।
পূর্বের দ্বৈরথ ভুলে সাচ্চু গোলাম আলী বিল হিসেবে যা দেয় তাই মেনে সে।বরযাত্রী হিসেবে যাওয়ার নিমন্ত্রণটি তার জীবনে একটা দারুণ ঘটনা।সাচ্চুর এই উদার আচরণ নিয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী দুএকজন প্রশ্ন তুললে সাচ্চু জানায় চা সিগারেটের বিল কয়েক টাকা কম নেওয়ার চেয়ে বরযাত্রার নিমন্ত্রণটি তার জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। নিজের বিয়ে ছাড়া আর কারো বিয়েতে বর যাত্রী হবার সৌভাগ্য তার হয় নাই।
কিন্তু কপালে যদি থাকে হাড়! দুই তিন বাদে শোনা গেল গোলাম আলীর বিয়ে ভেঙে গেছে। কেউ একজন তাকে বলেছে ময়মনসিংহের মেয়েরা খুবই বিপজ্জনক। বটি চালনায় তাদের পারদর্শীতা রয়েছে।বটি দিয়ে সবজি কাটাকুটি এবং অন্যের ধড় বিচ্ছিন্ন করে ফেলা দুইটাতেই তাদের সমান আগ্রহ এবং দক্ষতা। গোলাম আলী পিছু হটে।ঘটককে জানিয়ে দেয় বয়স পঞ্চাশ ছুই ছুই হলেও নিজের ধড়ের প্রতি মায়া এখনো শেষ হয় নাই।
বিয়ে ভেঙে যাওয়ার খবর সাচ্চুকে ব্যাপক হতাশ করে।উদার আচরণ খারিজ করে আবার তেজি ভাব জারি রাখে সে। পরদিন বিকেল বেলায় গোলাম আলী সাচ্চুর দোকানমুখী হতেই সাচ্চু জানায় জানায়, চা সিগারেট হবে না।অন্য পথ দেখেন।
গোলাম আলী অন্য পথ দেখে না। দুই হাত পকেটে চালান করে চোখ পিটপিট করে একবার রাস্তার চলমান মানুষের দিকে আরেকবার আসমানের দিকে তাকায়।ঘাড় এপাশ ওপাশ করে নিজের স্বাভাবিক দশা বজায় রেখে কিছুক্ষণ বাদে পুনরায় হাঁক ছাড়ে, সাচ্চু, চা দে।