বাসায় নতুন সিকিউরিটি গার্ড এসেছে। বয়স পঞ্চান্ন ষাটের মাঝামাঝি। ময়মনসিংহ মুক্তাগাছায় বাড়ি। চেহারায় আবহমান বাঙালি পৌঢ় পুরুষের দরদ জাগানিয়া অবয়ব । পরিবার পরিজন ফেলে পড়ন্ত বেলায় কেবল অভাবের তাড়নায় জীবনে প্রথমবারের মত বাঁধাধরা চাকরিতে যোগদান করেছেন। দেশের অর্থনীতি যেখানে পাগলা ঘোড়ার মত উন্নতির মহীসোপানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তিনাদের ময়মনসিংহ মুক্তাগাছায় নাকি অভাব আর অভাব। সাথে মোবাইল নাই। প্রতিবেলা নামাজ পড়েন। অবসরে তজবীহ গুনে জিকির ইবাদতে সময় পার করেন। প্রথম দশ পনের দিন পরিবারের জন্য হাহাকার আর ঢাকা শহরে বসবাসের ঘোর কাটাইতেই গেছে। ধীরে ধীরে জবান খুলতে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগে দুপুরবেলা গেট খুলে আমারে চাচামিয়া সম্বোধন করে আমি কি করি জিজ্ঞেস করে আমার সাথে আলাপের শুরু। তো যে কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং শিক্ষকতা করি তা প্রকাশে আমার বরাবরই অনীহা। কিছু করি না বলে জবাব দিলে তিনি আরও নাছোড়বান্দা হইয়া প্রতি সকালে সুগন্ধি মাইখা ফুলবাবু সেজে বাইরে যাবার কথা মনে করিয়ে দেন। অবশেষে কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং মাস্টারির কথা স্বীকার করিলে তার চেহারায় বিজয়ের ছাপ ভেসে উঠে। আমি এইরকম বিরাট কিছু 'একটা' হব এইটা নাকি দেইখাই বুঝছিলেন। পরক্ষনেই বললেন যে মাষ্টারেরা নাকি টাকার কুমির। ছাত্র পড়াইয়া মাসে লাখ টাকা আয় করেন। আমি হু হা করিয়া বিদায় লইয়া প্রথমবারের মত আলাপে ইতি টানি। এরপর থেকে শুরু হইছে মধুর অত্যাচার।প্রতিবার বাইরে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে ছাত্র পড়াইতে যাই কিনা এমনকি চা খাওয়ার জন্য লুঙ্গি চপ্পল পরে বের হইলেও। বাসায় ঢোকার সময়ও সেই একই ধারার প্রশ্ন 'ছাত্র পড়াইয়া আইছুন?'। জবাব আর কি দিব মাঝে মাঝে মাথা নাড়ি। মাঝেমাঝে কিছুই বলিনা। উনার আগ্রহের কমতি নাই। একটু সুযোগ পেলেই গল্পের আড়ত খুইলা বসেন। সব অভাবের গল্প। গল্প শুনে মনে হবে ময়মনসিংহে সবার অজান্তে নীরব দুর্ভিক্ষ চলিতেছে। এরপরে শুরু হয়েছে ফোনে কথা বলার পালা। নিজের মেয়ে এবং ছেলের মোবাইল নম্বর লেখা কাগজ বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন 'আপনেরে আপনা লোক মনে করি বলে ছোটখাট এইটা সেইটা আব্দার করি কিছু মনে করুইন না যে।' কিন্তু দুই তিন মিনিট কথা বলার পরেই অপরপাশের কথককে কথা তাড়াতাড়ি শেষ করার তাগাদা দেন। বলেন 'পরের মোবাইল দিয়া ফোন দিছি ।রাইখা দেও। হে রাগ হইব।' আপন পর মাত্র দুই মিনিটের মামলা।
পরবর্তীতে দুই একবার চা সিগারেটের আব্দার। দশ টাকাতেই আবার আপনা লোক ।
সবচেয়ে ভয়ংকর ক্ষেপনাস্ত্রটা ছুড়লেন গতকাল। আমার বাছকাছ কয়জন জিজ্ঞেস করলেন। বাছকাছ কি জানতে চাইলে বলেন ওই ধরেন ছেলেপুলে। নিজের ব্যাচেলর দশা জানাইলে তিনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সমগ্র ভূমন্ডল একবার পরিভ্রমণ করিয়া আবার যেন উত্তরায় আছড়ে পড়লেন। "এইডা আপনে একটা কাম করছুইন? আমি তো মনে করছি আপনের কমবেশ দুইটা বাছকাছ আছে?"
বিবাহ না করিয়া, বাছকাছ জন্ম না দিয়াও কি কাম( পড়ুন কাজ। কাম শব্দের অন্য তর্জমা আছে) করলাম বুঝলাম না। নিস্তার লাভের আশায় বললাম "চাচা,ছাত্র পড়াইবার যাই । কি বলেন?"
"আইচ্ছা আহুন যে। "
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১২:০৮