১ম পর্ব
২য় পর্ব
প্রথম দেখাতেই কর্মা লোটেকে আমাদের ভাল লেগে গেল। নীল রংয়ের একটি মাইক্রো নিয়ে এসেছে। আমরা পাঁচজন ওর সাথে কয়েকটি ছবি তুলে থিম্পুর পথে রওনা দিলাম। ভ্রমণসুচীর আজকের সারা দিনটিতে থিম্পু যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। দ্রুক এয়ারের টাইম টেবিল এমনই যে, কিছু না করেই একটা দিন নষ্ট হয়ে যায়।
কর্মা বেশ ভালো ইংরেজি বলছিল। আমাদেরকে ভূটান সম্পর্কে কিছু ধারণা দিল। পারো হতে থিম্পু কম বেশী দেড় ঘন্টার ড্রাইভ। পাহাড় লাগোয়া রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ী চলছে। পাশ দিয়ে কুলকুল শব্দ করে পারো নদী বয়ে গেছে। পারো নদীকে ভূটানিরা বলে- পাছু। আসলে ভূটানে নদী’র কোন নাম নেই। “ছু” মানে হচ্ছে পানি। পারো হতে “পা” আর “ছু’ মিলিয়ে পারোর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী’র অংশটি’র নাম পাছু। তেমনি থিম্পুর নদীটির নাম হয়েছে থিম্পুছু।
রাস্তার ধারে আপেল বাগান, ঠান্ডা বাতাস, পাশে পারো নদী। মন চাইছিল দৌড়ে পানিতে নেমে পড়ি। কর্মা জানাল এখন কোথাও থামবেনা, সময় মত সব ঘুরিয়ে দেখাবে। আমার ধারণা ছিল হিমালয়ের কাছাকাছি যাচ্ছি, যদিও এখন গ্রীষ্মকাল তারপরও অনেক ঠান্ডা থাকবে। তাই ভারী অনেক কাপড় নিয়ে এসেছি। নানা আমার কোন উপদেশ শোনেননি। তিনি ছোট একটি হাত ব্যাগে কয়েকটি পাঞ্জাবি আর একটা চাদর নিয়ে এসেছেন। আবহাওয়া সংক্রান্ত আমার ধারণা ভুল হওয়ায় নানা বেজায় খুশী।
সন্ধ্যা নাগাদ থিম্পু পৌছে গেলাম। ক্লক টাওয়ার হতে কিছুটা সামনে হোটেল টাসাঙ্গ এ (Hotel Taktsang)আমাদের গাড়ী থামল। বাহির হতে হোটেলটি পুরনো মনে হল, রিসিপশনটিও অন্ধকারচ্ছন্ন । মনে মনে কিছুটা দমে গেলাম। হোটেল ভালো না লাগলে বা সার্ভিস খারাপ হলেতো সবাই আমাকে দোষারোপ করবে। কিন্তু রুমে ঢুকে ও পরে হোটেলটি ভালভাবে দেখে খারাপ মনে হল না, অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল হোটেলটি।
কর্মা আজকের মত চলে গেছে। আগামীকাল সকাল ৯ টায় সে আসবে। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে আধাঘণ্টা পর নীচে নামলাম। প্যাকেজে আমাদের খাবার ইনক্লুডেড। রাতের খাবার ব্যাপারে রিসিপশনে খোঁজ নিলাম। আমরা যেহেতু হালাল খাবার খাব তাই কোন ধরনের মাংস খাওয়ার উপায় নেই। আলাপ আলোচনা করে মাছ, সব্জি ও ডাল অর্ডার করলাম। রাত সাড়ে ৮ টায় খেতে হবে।
হোটেলটা শহরের প্রাণকেন্দ্রে। হোটেলের পাশের প্রধান রাস্তায় নামতেই রাতের কলকাকলি ভেসে এল। প্রধান রাস্তাটি মাত্র ২ লেনের। একজন মাত্র ট্রাফিক পুলিশ দেখলাম। সে মাঝে মাঝে গাড়ী থামিয়ে মানুষদের পারাপারের ব্যবস্থা করছিল। অনেক মেয়েকে দেখলাম পরিপাটি অবস্থায় রাস্তার ধারে বাজার করে বাড়ী ফিরছে। মনে হয় মেয়েগুলো অফিস ফেরত। ফুটপাতে অনেক মেয়ে মরিচ, ধনে পাতা, মাশরুম আর পনির নিয়ে বসে আছে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি।
এটিএম বুথ দেখে স্থানীয় টাকা তুলতে গেলাম। আমার ২টি কার্ড কাজ করল না, এমনকি মিলনেরটাও কাজ করল না। শাকিলার অস্ট্রেলিয়ার কার্ডটি কাজ করায় এ যাত্রায় বাঁচলাম। আমাদের কার্ডগুলো কি ভূটানের ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের আওতাধীন নয়? প্রশ্নের উত্তর জানা হল না। নানা’র ওসবের চিন্তা নেই উনি বাংলাদেশ হতেই ১,৭০০ নুল্ট্রাম নিয়ে এসেছেন। উনি ভেবে পাচ্ছেন না, এই টাকা কিভাবে খরচ হবে। ওনার কেনাকাটার কোন ইচ্ছা নেই, থাকা/খাওয়া প্যাকেজের মধ্যেই, টাকাটা বোধকরি থেকেই যাবে। মিলনরা কিছু ডলার নিয়ে এসেছে। ডলার ভাঙ্গানোর আগ পর্যন্ত কাজ চলার জন্য ওদেরকে কিছু নুল্ট্রাম ধার দিলাম। নুল্ট্রামের চিন্তা দূর হওয়ায় সন্ধ্যার কোলাহলে ফুটপাতের বাজার দেখতে দেখতে সামনে চললাম।
প্রায় সব মেয়েরাই মাশরুম ও পনির বিক্রি করছিল। পনিরগুলো শুকিয়ে কিউব করে কাটা, সুতা দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে। আরবের লোকজনও অনেক পনির ব্যাবহার করে। আমাদের বাংলাদেশে এর ব্যাবহার খুবই সীমিত। ভূটানি মেয়েদের শরীরে বাড়তি কোন মেদ দেখলাম না এবং তারা বেশ চটপটে। মিলন একটি দোকান হতে সিম কিনে দেশে যোগাযোগ করল।
কয়েকটি জামা কাপড় ও জুতোর দোকানে ঢুকলাম। অনেক দাম। ভূটানের অধিকাংশ জিনিসই বাহির হতে আমদানী করা, তাই দামও বেশী। ভূটানে শপিং না করাই ভাল। রাস্তা দিয়ে হাটছি, দেখলাম দু’জন ছেলে ও একটি মেয়ে বাংলায় কথা বলতে বলতে আসছে। তাদের হাতে বাজারের ব্যাগ, তেল ও নানা কিছু- তার মানে এখানে বসবাস করে। কৌতুহল বশতঃ ওদেরকে থামালাম। ওরা বাংলাদেশের উত্তরায় একটি সফটওয়্যার কোম্পানীতে কাজ করে। কোম্পানী ওদেরকে ভূটান অফিসে ট্রান্সফার করেছে। ওরা ৩ মাস ধরে ভূটানে আছে। তারা জানাল, ভূটান তাদের খুব ভাল লাগছে। গভীর রাতে মেয়েরা রাস্তায় হেটে বেড়াতে পারে। নিরাপত্তা নিয়ে কখনো তারা শংকিত নয়। আরো কিছু আলাপচারিতা শেষে তাদেরকে বিদায় জানালাম। এই প্রথম আমার মনে হল- আহা! ভূটানে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলে মন্দ হত না। এমন ছিমছাম, নির্মল, অনিন্দ্য, পরিচ্ছন্ন শহর আর কোথায় পাওয়া যাবে।
হোটেলে ফিরে সোজা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। আমাদের দেখে মনে হয় রান্না চাপানো হল। রেস্টুরেন্টে ১টি মাত্র মেয়ে- সে স্বাগত জানাল, অর্ডার নিল, সার্ভও করল, সন্দেহ হল রান্নাটাও কি সে নিজেই করেছে? আধাঘন্টা পরে খাবার আসে। এর মাঝে নানা বেশ বিরক্ত হয়ে যায়। রাতে খাওয়ার পর উনি ঘড়ি ধরে ২ ঘন্টা পরে ঘুমাতে যান, সব সময়ই তিনি এটা করেন। তাই এই ৮০ বছর বয়সে অন্যদের তুলনায় তিনি অনেক ফিট আছেন।
গরম গরম খাবার আসল- মাছ ভূনা, ডাল, মশরুম ও ফুল কপি’র সব্জি এবং আলু পনির। বৌদ্ধ ধর্মে যেহেতু প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ, তাই তারা মাছ ও মাংস বাহির হতে আমদানী করে। ব্যাপারটা এমন-হত্যা নিষিদ্ধ, কিন্তু খেতে মানা নেই। ফ্রোজেন মাছ, তেমন ভাল লাগল না। মাশরুম ও পনিরের আইটেম ভালো লাগল। খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষন ইন্টারনেট ব্রাউজ করে, বাসায় কথা বলে ঘুমোতে গেলাম। সারাদিন কিছু না করেও অনেক ধকল গেছে!
শেষ ৩টি ছবি- ইন্টারনেট হতে।
(চলবে)