বজ্র ড্রাগনের দেশ ভূটান-১
সংস্কৃত শব্দ “ভূ-উত্থান” হতে ভূটান শব্দটি এসেছে যার অর্থ উচ্চভূমি। ১৯০৭ সাল থেকে ওয়াংচুক বংশ দেশটি শাসন করে আসছে। ১৯৫০ এর দশক পর্যন্ত ভূটান একটি বিচ্ছিন্ন দেশ ছিল। ভূটানের মাতৃভাষা জংকা, তাদের ভাষায় ভূটানকে “দ্রুক ইয়ুল” বা বজ্র ড্রাগনের দেশ বলা হয়। স্থলবেষ্টিত দেশটির পার্বত্য ভূ-প্রকৃতি সুইজারল্যান্ডের মত বলে দেশটিকে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড ডাকা হয়।
২২ আগস্ট, সোমবার ছিল আমাদের রওনা হবার দিন। ফ্লাইট বিকাল ৪ টায়। দ্রুক এয়ারের ফ্লাইট এমন সময়ে হওয়াতে আমাদের আজকের দিনটা নষ্ট হবে। এছাড়া উপায়ও নাই। মিলন ও লিজা সরাসরি বগুড়া হতে এসেছে। ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত কাজ শেষ করে আমরা নির্ধারিত গেটে অপেক্ষা করতে থাকি। শাহজালাল এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন সেবা আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। ২/৩ মিনিটেই পাসপোর্টে স্ট্যাম্প দিয়ে দেয়। দ্রুক এয়ার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। নানা’র কাছে বিমানটি অনেক বড় মনে হচ্ছে। আমি জানালাম বোয়িং এর যে বিমানগুলোতে আমি সৌদি আরব যাই তার কোন কোনটি দোতলা, হাজারখানেক যাত্রী ধরে (প্রকৃত তথ্যঃ Click This Link)। সৌদি আরবের ডমেস্টিক বিমানগুলো দ্রুক এয়ারের চেয়ে বড়। নানা অবিশ্বাসে মাথা নাড়লেন। বিমানে উঠতেই ভূটানি বিমানবালারা স্মিত হেসে আমাদের স্বাগত জানায়। তাদের পরনে জাতীয় পোশাক- কিরা।
বিমানে উঠে দেখি আমাদের সামনের সারিতেই শফিক তুহিন ও তার বন্ধুরা বসে আছে। কিন্তু তার প্রতি আমরা কেউই আগ্রহ দেখাইনি। ভূটান ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন সময় পার্থক্য নেই-একই টাইম জোন। মাত্র ১ ঘন্টার পথ, খাবার হিসাবে দিল- স্যান্ডউইচ, কেক, চিনাবাদাম ও জুস। মন্দ নয়।
আমি, শাকিলা ও নানা একপাশে এবং অপরপাশে মিলন ও লিজা বসেছে। বিমান ল্যান্ড করার খুব একটা দেরী নেই। বয়সের দাবীতে নানা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জানালার পাশে বসেছেন এবং অবাক চোখে নীচের পাহাড়, নদী দেখছেন। আমি ভেবেছিলাম বিমান থেকে কিছু ছবি তুলব। নানার কারনে তা ভেস্তে গেল। মিলন ও লিজার কণ্ঠে বিষ্ময় ধ্বনী –কি সুন্দর নদী! আরে পাহাড়! আমি আমার পাশে দেখার চেষ্টা করি, আবার ওদের পাশে যাই-আমি যে পাশেই থাকি তখন সে পাশে কিছু দেখা যায় না। একেই বলে মন্দ ভাগ্য।
ভূটানে একটিই মাত্র এয়ারপোর্ট- পারো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এটি বিশ্বের ছোট বিমান বন্দরগুলোর মাঝে অন্যতম। আমাদের বিমান অনেক নীচে নেমে আসল। এখন বিমানের দুই পাশে পাহাড়, তার মাঝ দিয়ে আমরা উড়ে যাচ্ছি-থ্রিলিং। পাহাড়ের গা বেয়ে সাপের মত অচেনা নদীর পানি ঝিকমিক করে উঠল। নানার চোখ বড় হয়ে আছে। নানা বহু দেশ ঘুরেছেন কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
সামনের আসনে শফিক তুহিনকে এ্যারাইভাল ফরম পূরণ করা নিয়ে ভুগতে দেখলাম-না বোঝার কোন কারন নাই। ঝপ করে আমাদের বিমান রানওয়ে স্পর্শ করে।
বিমান হতে বের হয়ে প্রায় সব যাত্রীই উল্লাস প্রকাশ করল। চনমনে আবহাওয়া ও অবারিত সবুজে আমাদের চোখ ও মন জুড়িয়ে যায়। সবার হাতের ফোন অথবা ক্যামেরা ঝটপট ছবি তুলেই চলছে। দুই পাহাড়ের মাঝে একটু সমতলে ছোট একটা এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের বিল্ডিংগুলো তাদের নিজস্ব ঢং এর-দেখলেই বুঝা যায় সাধারনের মাঝেও নান্দনিকতা থাকতে পারে। যাত্রীরা কেউই ইমিগ্রেশনের দিকে যাচ্ছে না দেখে কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে এসে ইমিগ্রেশনে যাবার তাগাদা দিলেন।
৫ মিনিটের মাঝেই ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হয়ে গেল। বাংলাদেশিরা অন এ্যারাইভাল ভিসা পায়। কবে ফেরত যাব জিজ্ঞাসা করে ৫ দিনের ভিসা দিয়ে দিল। আমি ও শাকিলা সাথে করে ডলার আনিনি। আমার সাথে সৌদি আরব হতে ইস্যু করা ইন্টারন্যাশনাল ভিসা কার্ড আছে, বাংলাদেশের এফসি একাউন্টের কার্ড আছে। তাই ডলার বহন করার প্রয়োজন মনে করিনি। এয়ারপোর্টের ভেতরে এটিএম মেশিন দেখে কার্ড ঢুকালাম। দুটি কার্ডের একটিও কাজ করল না। মেশিনে সমস্যা থাকতে পারে, শহরে তোলা যাবে।
ব্যাগেজ চেকিং করে বের হতে যাব, দেখি কাস্টমস কর্মকর্তারা বিশিষ্ট শফিক তুহিনকে জেরা করছে। কে যেন বলল- এয়ারপোর্টের ভেতরে সু-দৃশ্য “বোতল” দেখে তা কিনেছেন কিন্তু ডিক্লেয়ার করেননি। এখন ২০০% পর্যন্ত ট্যাক্স দিতে হতে পারে। ভূটানে মদ্যপানে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, কিন্তু ধুমপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
গেটের বাহিরে একজন গাইড কাগজে নাম লিখে আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। কর্মা লোটে- আগামী পাঁচ দিনের জন্য আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড।
(চলবে)