বিগত বছর এবং এ বছরের শুরুতে আমাদের আবহায় তেমন প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত ছিল না। দিন যায়, আমি বৃষ্টির আশায় দিন গুনি। সৌদি আরবের অন্যান্য জায়গায় বৃষ্টি হলে সবাই নাজেহাল হয়ে যায়। ফ্ল্যাশ ফ্লাড এসে গাড়ী, বাড়ী ও জীবন তছনছ করে দেয়। কিন্তু আবহা পাহাড়ী এলাকা হবার কারনে এখানে পানি জমে থাকে না, ফলে এখানে আমরা সবাই বৃষ্টিকে উপভোগ করি। অথচ সেই বৃষ্টির দেখা নেই।
হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বিকালে আমি তখন জহির ভাইয়ের অফিসে। ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়ে জহির ভাই অফিস বন্ধ করে আমার সাথে ঘুরতে বের হলেন। আমরা গাড়ীতে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। বৃষ্টির তীব্রতায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, গাড়ী চালানো দায়। কয়েকবার পথ হারিয়ে আজমল ভাইয়ের বাসায় হানা দেই। সেখানে আরো অনেককেই আড্ডারত অবস্থায় পেলাম। আমাদের আড্ডা নতুন করে জমে উঠে। সবাই এই বৃষ্টির মাঝে খিচুরি খেতে চায়। আবুল হাসান ভাই রাতে খিচুরি রান্না করলেন। আমরা সবাই মিলে খেয়ে আরেক পশলা আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে বাড়ী ফিরি।
দু’দিন পরেই ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। তীব্র খরস্রোতা ৩টি ঝর্ণা একটি পাহাড় থেকে বয়ে চলছে। আশ্চর্যজনকভাবে এই ঝর্ণাগুলো নাকি আমাদের আবহা’র। অথচ আমাদের পরিচিতদের কোন ধারণাই নেই। তবে ভিডিও’র জায়গাটি হাবালা বলেই মনে হল।
সপ্তাহখানেক পর সকাল হতে আবার তুমুল বৃষ্টি। অনেক রাস্তাতেই পানি জমে গিয়েছিল। স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ভার্সিটি খোলা ছিল। আমি অফিসে এসে দেখি তেমন কেউ আসেনি, বাসায় ফিরে আসলাম। আযম ভাই ফোন দিয়ে বললেন, “চলেন, ওয়াদি বেইশ ঘুরে আসি। বৃষ্টির পানি জমে নিশ্চয় তা আরো সুন্দর হয়েছে।” রাজী না হবার কোন কারন নেই। দুপুরের পর আযম ভাইয়ের ফ্যামিলি সহ বের হয়ে গেলাম।
কিন্তু শুরুতেই ঝামেলা। পুলিশ জিজানের পথ বন্ধ করে রেখেছে। কোন গাড়ীই নামতে দিচ্ছে না। পরে জানতে পারি ভারী বৃষ্টিপাতে পাথর ধ্বসে একটি টানেল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন লোক আহত হয়েছিল। আমরা কিছুটা আশাহত। বৃষ্টি হচ্ছিল, আযম ভাই হাবালা’র পথে গাড়ী চালালেন। কিছুটা অনির্দিষ্ট যাত্রা।
এই পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মহিলা ক্যাম্পাস আছে। কিছুদূর যেতেই একটি ব্রিজে অনেক গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমরাও গাড়ী থামালাম। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। গাড়ী হতে নামতেই পানি প্রবাহের শো শো আওয়াজ পেলাম। কাছে যেতেই চক্ষু চানাবড়া-ব্রিজের নীচ দিয়ে যেন খরস্রোতা নদী বয়ে যাচ্ছে। এত পানি ! কয়েক দিনের বৃষ্টির পানি মনে হচ্ছে সব এখান দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাই বলে খরস্রোতা নদী হয়ে যাবে, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। আমরাও অন্যদের মতো ভিডিও করলাম, ছবি তুললাম। সৌদিরা গাড়ী থামিয়ে বৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করছিল।
আমি এতটুকোতেই তৃপ্ত ছিলাম। কিন্তু আযম ভাই হাবালা ঘুরে আসতে চাইলেন। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে আযম ভাই গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছেন। পাহাড়ের গাছগুলো আজ আরো সবুজ, বৃষ্টিতে গায়ের ময়লা ধুয়ে মুছে গেছে। ঈমান ও হানিনের অবাক দৃষ্টি, কৌতুহল আর নানারকম প্রশ্ন আমাকে মায়ার জগতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
হাবালা যাবার পথে পাহাড় থেকে নেমে আসা একটি সাময়িক ঝর্ণা চোখে পড়ল। কাছে যেতেই এর প্রকৃত সৌন্দর্য্য ধরতে পারলাম। বৃষ্টির সময় আবাহাতে অনেক ঝর্ণা তৈরি হয়- এতদিন তা শুধু শুনেই গেলাম, কখনো চোখের নাগাল পাইনি। কিন্তু এই কয়েকদিনের বিরতিহীন বৃষ্টি সে সুযোগটা করে দিল।
আমি ও আযম ভাই ঝর্ণার একেবারে কাছে চলে গেলাম- আহা! কি অপরূপ। আরবের বুকে ঝর্ণা। সারা জীবনের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। তখনো কি জানতাম আমাদের সামনে আরো কি বিষ্ময় অপেক্ষা করছে।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৬ দুপুর ২:২২