আগে একবার তনুমা ঘুরে এসেছিলাম। তনুমা এত ভালো লেগেছিল যে আবার এখানে বেড়াতে আসব তা জানাই ছিল। আমাদের আবহাও চমৎকার শহর কিন্তু তনুমার মতো এত নিরিবিলি নয়।
একদিন এক পত্রিকায় দেখলাম তনুমার কাছাকাছি “বালআহমার” নামক একটি জায়গায় বৃষ্টির পানি জমে নদীর (আসলে নালা) মতো তৈরি হয়েছে। সৌদিরা মহা খুশী! তার পাশে তারা সময় কাটাচ্ছে, বার-বি-কিউ করছে। নদীর অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখে সেখানে যেতে মন চাইল। তনুমা ক্যাম্পাসের তিন সৈনিক কচি ভাই, মোশতাক ভাই আর উসামাকে নদীটি খুঁজে বের করতে বললাম। কয়েকদিন পর উসামা জানাল, সে খোঁজ নিয়েছে কিন্তু আমাদের গাড়ী আর ফ্যামিলি নিয়ে সেখানে যাওয়া যাবেনা। জায়গাটি কিছুটা দূর্গম।
ছবিঃ আরবনিউজ.কম
কিন্তু তাই বলে উইকএন্ডে বাসায় বসে থাকলে চলবে? উসামা প্রস্তাব দিল- তনুমা চলে যাই। আমিও রাজী। দেখতে দেখতে অনেকেই যোগ দিল। ওদিকে তনুমায় কচি ভাই বিশাল আয়োজন করে বসে আছেন। কচি ভাই নাকি নতুন কিছু লোকেশনের খোঁজ পেয়েছে- আমাদেরকে দেখাবে।
১০ জানুয়ারি, শুক্রবার ভোর সাতটায় আমি ও আদিল ভাই আগে ভাগেই রওনা দিলাম। আমার গাড়ীতে শাকিলা, মোশতাক ভাই, দিবা ও মামুন কে তুলে নিয়েছি। আদিল ভাইয়ের গাড়ীতে আদিল ভাই ও শম্পা ভাবী। উসামা’র ফ্যামিলি, সাঈদের ফ্যামিলি, ফারুক স্যারের ফ্যামিলি ও হাবিব স্যার ৯ টার দিকে রওনা দিবেন।
আমার ও আদিল ভাইয়ের আগে রওনা দেবার কারন হচ্ছে একটু ধীরে সুস্থে গাড়ী চালিয়ে যাওয়া। আমার মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছাও ছিল। উসামা প্রায়ই বলে- তনুমার রাস্তায় নাকি মেঘ নেমে আসে, তখন সামনের গাড়ী দেখতে পাওয়া তো দূরের কথা কয়েক হাত দূরেও দেখা যায় না। রাস্তা হয়ে পড়ে অনেক বিপজ্জনক। আমার ইচ্ছা একটু সকালে বের হলে নিশ্চয়ই রাস্তায় গাড়ী কম থাকবে, ফলে মেঘের ভেতর দিয়ে গাড়ী চালাতে কোন সমস্যা হবে না। এই ভারসাতেই আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা দিয়েছি।
শুরুটা ভালোই হলো। আঁকাবাকা রাস্তা ধরে আমার ও আদিল ভাইয়ের গাড়ী এগিয়ে চলছে। “বালআহমার” আসতেই আমাদেরকে মেঘে ঢেকে ফেলল। আমি সামনের গাড়ীটি দেখতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল অনেক দূরে কোথাও দুটি ইমার্জেন্সি লাইট মিট মিট করে জ্বলছে। আমার পেছনে আদিল ভাই- তিনি এই অবস্থার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। পরে বলেছেন-ড্রাইভ করাটা ভয়ংকর ছিল। আমি যেহেতু আগেই জানতাম এমন হতে পারে তাই গাড়ীর সবাই বেশ উপভোগ করলাম।
২ ঘন্টা পর কচি ভাইয়ের বাসায় পৌছেই কচি ভাইকে নিয়ে বের হয়ে পরলাম। শুক্রবার, সময় এমনিতেই কম। পরের টিমে যারা আসছে তাদের ঘন্টাখানেক দেরী হবে, ফলে ভালো করে ঘুরে বেড়ানো নাও হতে পারে। কচি ভাই একটি লেক ও বাঁধ খুঁজে পেয়েছেন, সেখানেই আমাদেরকে নিয়ে যাবেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই লেকের পাশেই ওনাদের তনুমা ক্যাম্পাস। ১ বছরেরও বেশী সময় পর তিনি এই লেকের খোঁজ পেয়েছেন।
মূল রাস্তা থেকে একটি চিকন রাস্তা ডানে চলে গিয়েছিল। আমরা মূল রাস্তার পাশে গাড়ী থামিয়ে পায়ে হেটে রওনা হলাম। ভাবী ও দীবা গাড়ীতেই থাকছে কিন্তু শাকিলা আমার সাথে চলল। কিছুদূর যেতেই উপর থেকে লেকটি দেখতে পেলাম। পাহাড়ের মাঝের ঢালে বৃষ্টির পানি জমিয়ে লেকটি তৈরি করা হয়েছে। কি দারূণ দেখতে! আমরা সবাই হৈ হুল্লোড় করে নীচে নেমে এলাম। কচি ভাই জানাল এখানে পানকৌড়ি আছে, সাঁতার কাটে। পানকৌড়ির খোঁজ করলাম- দূরে, লেকের অপরপাশে আবছাভাবে পানকৌড়িদেরকে ভেসে থাকতে দেখলাম।
ছবি উঠানোয় আমাদের কোন ঘাটতি রইল না। বৃষ্টির সময় কখনো কখনো বাঁধটি পানিতে উপচিয়ে পড়ে, তখন পাহাড়ের অপরপাশে নয়নাভিরাম ঝর্ণার সৃষ্টি হয়। ইন্টারনেট ঘেটে কচি ভাই সেই ঝর্ণার একটি ছবি বের করেছেন।
ফেরার পথে আমি ও মামুন পাশের একটি অনুচ্চ পাহাড়ে উঠে গেলাম। অপর পাশে যেতেই পুরো তনুমা শহর চোখের সামনে চলে আসল। পাহাড়ের ভ্যালিতে তৈরি শহরটি কতইনা মায়াবী। রোদ বাড়তে থাকলে সামনের কয়েকটি পাহাড় চিকচিক করে উঠে, যেন White Mountain।
তনুমা শহর
White Mountain!
এখান থেকে কচি ভাই আমাদেরকে নিয়ে চললেন একটি প্রত্নত্বাত্তিক নিদর্শনের দিকে। গতবার এটার কথা জেনেছিলাম, কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি। একটি ছোট পাহাড়ের উপর পাথরের তৈরি কয়েকটি বাড়ী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যায় এগুলো অনেক প্রাচীন। এলাকার বয়স্ক লোকরা তাদের পূর্বপুরুষের মাধ্যমে জেনেছে – এখানে কোন কারনে হযরত ঈসা (আঃ) এসেছিলেন এবং যাত্রা বিরতি করেছিলেন। তথ্যটি খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয় এবং এখানকার অনেক লোকই এখন এর খবর জানেনা।
প্রাচীন বাড়ী
প্রথমবার তথ্যটি জেনে খুবই অবাক হই। সৌদি আরবের তনুমায় হযরত ঈসা (আঃ) এসেছিলেন? ইন্টারনেটে সার্চ দিলাম। কিছু চমকপ্রদ তথ্যও পেলাম।
নিউ টেস্টামেন্টে ঈসা (আঃ) এর শৈশব থেকে ধর্ম প্রচারের আগের সময়টুকুর (বয়স ১২-৩০ বছর) কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। ১৮ বছরের এই সময়টুকুকে বলা হয়েছে "lost years of Jesus" । অনেকেই ধারনা করে থাকেন এই সময়ে ঈসা (আঃ) ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন। যদিও এই ধারনা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। যদি "lost years of Jesus" এর সত্যতা থেকে থাকে তাহলে তনুমায় ঈসা (আঃ) এসেও থাকতে পারেন। আরবের বেদুঈন রীতি হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিভিন্ন তথ্যকে লালন করা।
Click This Link
এই জায়গা থেকে কচি ভাই আমাদেরকে তনুমা ক্যাম্পাস ঘুরাতে নিয়ে গেলেন।
(চলবে)
২য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:৪৯