১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
আমরা চলছি আল-উখদুদের দিকে। নাজরান শহরের দক্ষিণে খুব কাছেই এই ঐতিহাসিক জায়গাটি। অন্যদের কথা জানিনা, আমার মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল আ’দ জাতি আর ধ্বংস হয়ে যাওয়া ইরাম শহরের কথা।
সূধা’র চেচামেচিতে বাস্তবে ফিরে এলাম। তার নাকি ক্ষুধা পেয়েছে। ২.৩০ টার মতো বেজে গিয়েছে। আসলেই পেট চো চো করছিল। কিন্তু জানিয়ে দিলাম এখনতো থামা যাবেনা। খাওয়ার জন্য আল-উখদুদ মিস করতে চাই না। ৪.৩০ এর ভেতর সেখানে পৌছতে হবে।
রাজা ইউসুফ নোয়াস (Yūsuf Dhū Nuwās) ছিলেন ইয়েমেনের হিমারাইট রাজত্বের সর্বশেষ রাজা। তিনি খ্রীষ্টাব্দ ৫১৭ সাল থেকে ৫২৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি ছিলেন কনভার্টেড ইহুদি। একমাত্র তাকেই রক্তসম্পর্ক ছাড়া ইহুদী হিসাবে স্বীকার করা হয়। রাজা ইউসুফ ইয়েমেনে সাফল্যের সাথে ইহুদি ধর্মমত প্রচার করতে থাকেন। তৎকালীন সময়ে নাজরান ইয়েমেনের অংশ ছিল (১৯৩৪ সাল পর্যন্ত)। নাজরানের অধিবাসীরা ছিল আল্লাহ'র অনুসারী- তারা সে সময়ে আল্লাহ প্রণীত বিধান খ্রীষ্টিয় অনুশাসন মেনে চলত। এক কথায় তারা ছিল খ্রীষ্টান।
রাজা ইউসুফ নোয়াস নাজরানবাসীদের ইহুদী ধর্মের দাওয়াত দেয়। কিন্তু নাজরানবাসীরা তা প্রত্যাখ্যান করে। রাজা ইউসুফ নাজরানবাসীদেরকে ইহুদী ধর্ম অথবা মৃত্যু'র মাঝে যে কোন একটি বেছে নিতে বলেন। প্রায় ২০, ০০০ আল্লাহ বিশ্বাসী খ্রীষ্টান মৃত্যুকে বেছে নেয়। তাদেরকে একটি বড় গর্তে আগুনে পুড়িয়ে জীবন্ত মারা হয়। এ মর্মান্তিক হত্যাকান্ড সবাইকে আলোড়িত করে। অন্যান্য খ্রীষ্টানদের অনুরোধে আবিসিনীয়ার (ইথুপিয়া) রাজা সেখানে একদল সেনাবাহিনী পাঠান। তারা রাজা ইউসুফ নোয়াসকে পরাজিত ও ক্ষমতাচ্যূত করে।
পরর্তীতে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর নির্দেশে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) ৬৩০/৬৩১ সালে তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যান। নাজরানবাসী ইসলাম গ্রহন করে।
পবিত্র কোরআনের ৮৫ নম্বর সুরা বুরূজে উক্ত হত্যাকান্ড ও আল্লাহ'র প্রতি তাদের অবিচল আস্থার কথা বর্ণিত হয়েছে।
শপথ বুরূজ (তারকা) বিশিষ্ট আকাশের, শপথ প্রতিশ্রুত দিবসের, শপথ যা উপস্থিত হয় এবং যা উপস্থিতকৃত, ধ্বংস করা হয়েছিল খন্দকবাসীদেরকে, যা ছিল জ্বালানীপূর্ণ অগ্নি, যখন তারা তার উপর উপবিষ্ট ছিল;
এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করেছিল তাই প্রত্যক্ষ করছিল, তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু এই (অপরাধের) কারনে যে, তারা সে পরাক্রান্ত প্রশংসাভাজন আল্লাহ'র প্রতি ঈমান এনেছিল। (সুরা বুরূজঃ ১-৮)
১৯৮১ সালের দিকে সৌদি সরকার হত্যাকন্ডের সেই জায়গাটিতে খননকার্জ পরিচালনা করে। তারা সেখানে অনেক স্থাপনা,পাথরে আঁকা চিত্রাবলি, হাড়গোড় খুঁজে পায়।
ধ্বংসাবশেষ
আমরা সময় থাকতেই সেখানে পৌছে যাই। পুরো জায়গাটি ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। ভেতরে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনাগুলো দেখতে পাই। আগুনে পোড়ানোর চিহ্ন এখনো স্পষ্ট। একটি বড় দেয়ালের পাশে দেখলাম অনেক ভীড়। দেয়ালটিতে বিভিন্ন লিপি ও চিত্রকর্ম আছে। আমরা ঝটপট কিছু ছবি তুলে নিলাম। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে দেখলাম, তারপর আমরা গেলাম পাশের মিউজিয়ামটিতে। নাজরান মিউজিয়ামটি সৌদিআরবের অন্যতম সমৃদ্ধ মিউজিয়াম। ভেতরে ঢুকেই তার প্রমাণ পেলাম। সবকিছুই সাজানো গোছানো। প্রতিটি জিনিষের পাশেই আরবি ও ইংরেজিতে বর্ণনা দেয়া আছে। ভেতরে ছবি তোলার অনুমতি ছিল, আমরা তার পুরো সুবিধাটাই নিলাম।
চিত্রাংকিত দেয়াল
ইউনিকর্ন (?)
মিউজিয়ামের এক জায়গায় গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আল-উখদুদের পুরো মানচিত্র দেয়া আছে। সেখানে সম্ভাভ্য "Kaaba of Najran"চিহ্নিত করা আছে। ঐ সময়ে এখানে খ্রীষ্টানদের একটি চার্চ ছিল। তারা মক্কার কাবা'র মতো একটি কাবা বানিয়ে ধর্মীয় আচার পালন করত। রাজা ইউসুফ নোয়াস অন্য সবকিছুর সাথে এটিও ধ্বংস করে দেন। একটু আফসোস লাগল, জানা না থাকায় খ্রীষ্টানদের কাবা'র জায়গাটি দেখতে পারলাম না। তার আশে পাশেই আমরা ছবি তুলেছিলাম। তখন সময়ও তেমন ছিল না যে আবার গিয়ে দেখে আসব। তবে অবাক হলাম, নাজরানের কাবা'র মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয় মিউজিয়ামের মানচিত্রে চিহ্নিত দেখে। বর্তমান সরকার এ ধরনের জিনিষ ভালো চোখে দেখে না।
মিউজিয়ামের ভেতরে
হাতে লেখা কোরআন
Kaaba of Najran
সবাই মোটামুটি ক্ষুধার্ত ছিলাম। মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে সরাসরি একটি রেস্টুরেন্টে গেলাম। সেখানকার আল-ফাহাম অমৃতের মতো লাগল। বেশী ক্ষুধা থাকলে যেকোন খাবারই অমৃত মনে হয়। সাঈদ এখনো সেদিনের সেই আল-ফাহামের স্বাদের স্মৃতিচারণ করে।
খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা সবাই রাজীব ভাইয়ের বাসায় যাই। ৩ জন বাংলাদেশি শিক্ষক নাজরান বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। রাজীব ভাইয়ের বাসায় কিছুক্ষণ থেকে আমরা আবহা'র পথে রওনা হই।
নাজরান একটি ছোট শহর হলেও এর ইতিহাস অনেক অনেক সমৃদ্ধ। এখানে সেখানে প্রাচীন রেলিকগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ১ দিনের এই ট্যুরে অনেক কিছুই দেখা হয়ে উঠেনি। এই ট্যুরকে আমি পরিপূর্ণ বলব না। অনেক কিছু না দেখতে পারার আফসোসটা রয়েই গেছে। সাঈদ ও আমি ঠিক করেছি, খুব শীঘ্রই আবারো নাজরান ঘুরে যাব।
যা দেখা হয়ে উঠেনিঃ
নাজরানের কা'বা, আল রসাস ভ্যালি-পানি ও পাথরসমৃদ্ধ এলাকা, পানি সহ নাজরান বাঁধ, নাজরান ফোর্ট, আল আন প্যালেস, কসর আল-ইমারাহ। খুঁজে বের করতে হবে- ছোট শহর 'লায়লা'; লাইলি-মজনু'র প্রেমকাহিনী'র উপর ভিত্তি করে শহরটির নামকরন হয়।
(শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৭