অনেকদিন পর ড্রয়ার পরিষ্কার করতে যেয়ে হঠাৎ ৫০০ টাকার নোট পেয়ে গেলে যে আদিম মধ্যবিত্ত সুখ পাওয়া যায় এবং বইমেলার প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার সুগন্ধির সাথে মেলে এমন কোন গন্ধ হঠাৎ নাকে বাড়ি দিলে যেমন করে বুকটা মোচড় দেয়, স্বপ্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে স্নেহাকে এবং তার গালের টোলটাকে আবিষ্কার করে আমার তেমন আদিম সুখও হলো আবার বুকটা মোচড়ও দিয়ে উঠলো।
না, আমাদের কোন মিলিত অতীত নাই, আমি কোনদিন তার ঘাড়ে চুমু খাই নাই, আমার হাত কখনো তার হাতের উপর অবস্থান করে নাই, কোনদিন তাকে হলুদ খামে নীল চিঠি পাঠাই নাই, কিন্তু তবুও তাকে ও তার গালের টোল দেখে আমার প্রচন্ড সুখ হল। চিটাগাং পাবলিক স্কুলের সেই দিনগুলোর স্মৃতি ড্রয়ার থেকে পলকে উঠে আসলো আমার শপিং ট্রলি আর শপিং লিস্টের বাস্তবতায়।
স্নেহার গালের টোলের প্রেমে পড়েছিলাম ক্লাস ফাইভে থাকার সময়। পড়াশুনা ভাল লাগতোনা, কোন বন্ধু ছিলনা, খেলাধুলা পারতাম না, বইখাতা আকর্ষণ করতো না, স্কুলে যেতাম শুধু স্নেহার গালের টোল দেখবার জন্য। খুব করে লুকাতে চাইতাম যে আমি তার গালের টোল দেখি কিন্তু পারতাম না। এর মধ্যে কোন যৌন উদ্দীপক ব্যাপার ছিল না, এর মধ্যে কোন অশ্লীল কামনা ছিল না, এর মধ্যে কোন গুপ্ত রহস্য ছিল না, আমি শুধু নিষ্পাপ ভাবে তার টোলের প্রেমে পরেছিলাম। আমাকে নিয়ে ছেলেরা মশকরা করত, স্নেহা ও তার বান্ধবীরা হাসাহাসি করত, জহির স্যার পানিশমেন্ট দিতেন কিন্তু নিজেকে আমি কোনভাবেই শুধরাতে পারতাম না। ক্লাসে যেতাম আর প্রায় প্রতিদিনই অপমানিত হতাম।
বাবার ছিল বদলির চাকরি তাই বেশিদিন এই অপমান সহ্য করতে হয় নাই। আমরা চলে আসলাম ঢাকায়। আমার জীবন থেকে স্নেহার গালের টোল চিরতরে হারিয়ে গেল। ঢাকায় আসার দিন বসেছিলাম ট্রেনের জানালার ধারে। কান্না পাচ্ছিল, কাঁদছিলাম সারাটা পথ জুড়ে, আব্বা আম্মা মনে করেছেন বন্ধুদের জন্য কাঁদি অথবা স্কুলের জন্য।
কিন্তু আমি কাঁদছিলাম স্নেহার গালের টোল হারিয়ে ফেলার দুঃখে।
কলেজে পড়ি যখন, একদিন স্নেহার সাথে দেখা। ওকে চিনতে পেরেছিলাম, না পারার তো কোন কারন নাই, আমি ওকে সারাজীবন চিনতে পারব, কিন্তু বিস্ময়, সেও আমাকে চিনতে পেরেছিল। এরপর ব্যাংকে চাকরি নিলাম যে বছর, তাও ১৫-১৬ বছর আগের কথা, সে বছর স্নেহার সাথে একদিন এক বিয়ে বাড়িতে দেখা। আমাকে চিনে নাই, আমি আগ বাড়িয়ে যখন পরিচয় দিলাম, তখন দুই-তিনটা কথা বলল তারপর বিয়ে বাড়ির হৈ-হুল্লোড়ে হারিয়ে গেল।
আমার জীবনে প্রেম আসে নাই তাই টোল পরা গাল ছুঁয়ে দেখবার সুযোগ হয় নাই কখনো। মেনে নিয়েছি টোল পরা গাল ছুঁয়ে দেখবার বাসনা অতৃপ্ত থেকে যাবে সারাজীবন। বিয়ে হয়েছে পরিবারের পছন্দে। এছাড়া আমার গতি ছিল না। প্রেম করে কোন নারীর ভালোবাসা অর্জন করার সামর্থ্য নেই আমার।
আমার বউয়ের গালে টোল নাই।
স্বপ্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে স্নেহা ও তার গালের টোলটাকে পুনরায় আবিস্কার করে আমি যতটা না আপ্লুত হয়েছি, দেখলাম আমাকে দেখে তার চেয়েও বেশি আপ্লুত হয়েছে সে। সে এগিয়ে এলো, আমিও এগিয়ে গেলাম। বিস্ময়, সে আমাকে এত বছর পরও চিনতে পেরেছে। প্রশ্ন করাতে বলল - চিনতে অসুবিধা হয়নি তোমাকে; মাঝে টিভির টকশোগুলোতে দেখেছি তো। বাব্বা, কত জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বল তুমি। এই কথা শুনে আমার খুশী লাগে, RTV ও বাংলাভিশন কে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের সেকেন্ড গ্রেড অনুষ্ঠানগুলোতে আমার মতো থার্ড গ্রেড বিশেষজ্ঞকে ডাকার জন্য। অনুষ্ঠান শেষে সাদা খাম বা প্রডিউসারের প্রশংসাবাণী বা সহবক্তাদের মুগ্ধ চাহুনি কখনো এত খুশি আমাকে করে নাই যা স্নেহার কথায় করেছে।
আমার ট্রলির উপচে পরা ক্যাপিটালিজম দেখে স্নেহা বুঝে নেয় আমার বড় পরিবার; প্রশ্ন করে - কজন ছেলে মেয়ে তোমার? আমিও তাকে মাপি; তার হাতের দামী ব্যাগ আর কপালে উঠিয়ে রাখা ভালো ব্র্যান্ডের সানগ্লাস দেখে বুঝি কোনো ব্যবসায়ীর স্ত্রী সে। ব্যবসায়ীর স্ত্রী বলে নির্ণয় করি তাকে কিন্তু ঝুঁকি নেই না; প্রশ্ন করি - কি করছ তুমি? উত্তর দেয় - শিক্ষকতা; IUB তে বিজনেস কোর্স নেই। আমি তার কথায় চমকাই কিন্তু বুঝতে দেইনা।
বনানী এলাকা জুড়ে আরবানাইজেসন আর ক্যাপিটালিজম। এই উপচে পরা আরবানাইজেসন আর ক্যাপিটালিজম আমাকে, স্নেহাকে আর স্নেহার গালের টোলকে প্ররোচিত করে কোন একটা কফিশপে বসতে। আমরা অবাধে প্ররোচিত হই, Rio Coffee তে যেয়ে বসি। বসেই বউকে টেক্সট করি - পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা, কফিশপে বসছি, আসতে দেরি হবে।
স্নেহা লক্ষ্য করে সেটা, জিজ্ঞেস করে - বউকে জানাচ্ছ? আমি মাথা নাড়ি। এবার প্রশ্ন করে - তোমার বউ কিছু করে? হালকা গরম কফির আভা উপভোগ শুরু করার মুহূর্তে এই প্রশ্ন শুনে আমি বিব্রত হই। শিক্ষকতা পেশায় থাকা ব্রাইট এই নারীর যে আমার দেয়া উত্তর পছন্দ হবে না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। বলি - আমার বউ ফুলটাইম গৃহিনী। স্নেহা খুব মিষ্টি একটা হাসি দেয় যেন সে এটা আপ্রিসিয়েট করে। গতানুগতিক প্রশ্ন বা মন্তব্য থেকে সে আমাকে রেহাই দেয়। প্রশ্ন করেনা - টকশোতে এবং সেমিনারে বড় বড় কথা বলে নিজের বউকে ঘরে আটকে রেখেছো? প্রশ্ন করেনা - এই যুগে বাস করেও মানসিকতা তোমার মধ্যযুগীয় রয়ে গেল?
সে জানায় তার স্বামী ব্যবসায়ী। তার দুই ছেলে। পড়ে ISD স্কুলে। বুঝি আমার অনুমান ঠিক হয়েছে, স্নেহার জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করেছে তার ব্যবসায়ী স্বামীর অর্থ-বিত্ত। আমি মনে মনে তার ব্যবসায়ী স্বামীর ক্যারেক্টার আঁকি। নিশ্চয়ই তার স্বামী কিছুটা কর্মঠ, কিছুটা ধার্মিক এবং পুরোটা বাটপার। এই কম্বিনেশনই এখন চলছে। এর বাইরে তো কেউ টাকা বানায় না। এই কিছুটা কর্মঠ, কিছুটা ধার্মিক এবং পুরোটা বাটপার লোকটা স্নেহার গালের টোলটার মূল্য দিচ্ছে কিনা সে ভাবনা আসে আমার মাথায় কিন্তু আমি তা দ্রুত সরিয়ে দেই।
কথা আগায়, এত বছরের ফিল-ইন-দ্যা-ব্লাঙ্কস পুরন হতে সময় লাগে। এই কথা, সেই কথা চলে আর আমি সন্তর্পনে তার গালের টোলের দিকে তাকাই। পৌষের হীম রাতে মুরব্বীদের চোখ এড়িয়ে খেজুর গাছের রস চুরির যে আনন্দ পায় কিশোরের দল, এই কফি শপে বসে আসেপাশের মানুষের চোখ এড়িয়ে স্নেহার গালের টোলটা দেখে আমি সেই আনন্দ অনুভব করি। কিন্তু ক্লাস ফাইভে থাকতে যেমন ব্যর্থ হতাম, এত বছর পরও এবারও ব্যর্থ হলাম। স্নেহা বলে, সে নিশ্চয়ই জানে আমি বিব্রত হবো, তবুও বলে - তুমি আগের মতন নিষ্পাপ দৃষ্টিতে আমার গালের টোলটা দেখছো বারে বারে, যেন আমি এখানে নেই, আছে শুধু আমার গালের টোল, শুধু এই টোলটাই তোমার কাছে বাস্তব।
আমি চোখ নামিয়ে ফেলি, লজ্জা পাই কিন্তু পরক্ষণে বুঝি তার গালের টোলের প্রতি আমার আসক্ততা আমাকে না যতটা তৃপ্তি দেয় তার চেয়ে বেশী তৃপ্তি দেয় তাকে। স্নেহা বলে - আমাকে কত মানুষ ভালোবেসেছে, কত মানুষ রূপের প্রশংসা করেছে, কত মানুষ আমার শরীর কামনা করেছে, কত প্রেমিক আমার শরীর ছুঁয়েছে কিন্তু কারো চোখে তোমার মত মুগ্ধতা দেখিনি কখনো। আজও সেই একই মুগ্ধতা নিয়ে তুমি যখন তাকাচ্ছো তখন মনে হচ্ছে এমন মুগ্ধতাকে পুঁজি করে কয়েকশো বছর বাঁচা যায়। তার কথার মানে পুরোপুরি বুঝতে পারিনা আমি, অস্পষ্ট লাগে, মনে হয় সে যেটা বলছে আমি হয়তো সেই মানেটা ধরতে অপারগ অথবা বুঝবার সামর্থ্য আমার নেই, তাই বলি ...
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:৫৭