আজকাল অনেক মুভি দেখি। হলিউড, বলিউড, ঢালিউড, টালিউড কোরিয়ান, তামিল ইত্যাদি। কিন্তু কেন যেন কিছু একটা মন খুঁজেছিল কিন্তু চোখ খুঁজে পায়নি। রংগিলা নতুন নতুন এইচডি প্রিন্ট, ব্লু রে হাই রেজুলেশন কিসের কি, ভরছিল না মন। তখন খুঁজে পেলাম "তিতাস একটি নদীর নাম"। সাদাকালো সাদামাটা ছবি। নদীমাতৃক বাংলার নদীর তীরের গ্রাম গঞ্জের লড়াকু মানুষের জীবন সংগ্রাম, প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, হাহাকার, পারিবারিক বন্ধন, বন্ধুত্ব সব কিছুই যেন মাটির মায়ায় বাধা এক অপূর্ব মিতালি যা মন চেয়েছে। কেনো আরো আগে দেখা হল না এই বলে মুভিটি দেখার পরে দর্শকের আফসোস হতে পারে যদি তিনি আগে না দেখে থাকেন। আর যারা দেখেছেন তাদের কাছে এই রিভিউ নস্যি তবে নস্টালজিক হতে পারেন। আর যারা একটু দেখে আর দেখেননি, বস আপনি মিস করেছেন। কেউ যদি গ্রাম ভালবাসেন, নদী ভালবাসেন, মানুষের দুঃখ কষ্টে নিজে ব্যাথিত হন তবে এই মুভিটি অবশ্যই র্যাংকিং এর প্রথম দিকের স্থানে রাখতে বাধ্য হবেন।
খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় ১৯৭৩ সালে মুভিটি মুক্তি পায়। মূলচরিত্রে কিশোর নামে প্রবীর মিত্র যিনি একজন পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, রাজারঝি চরিত্রে কবরী যিনি কিশোরে বঊ, বাসন্তী চরিত্রে রোজী আফসারী, তিলকচাদ চরিত্রে স্বয়ং ঋত্তিক ঘটক এছাড়াও গোলাম মোস্তফা, রওশন জামিল প্রমুখ অভিনয় করেছেন।
সংগীত পরিচালনায় রয়েছেন ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম শীর্ষক উপন্যাসের কাহিনীর সাথে মুভিটির মিল পঞ্চাশ ভাগের মত মনে হল। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ধারা বজায় রাখতে সাহিত্যভিত্তিক চলচ্চিত্রে এমনটা হয়েই থাকে। সে যাই হোক অদ্বৈত মল্লবর্মণ এর নিজের ভাষায় “তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়, রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।…তিতাস শাহী মেজাজে চলে।” চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক বারবার সেলুলয়েড পর্দায় তেমনি ভাবগাম্ভীর্য এনেছেন। এতেই মুভিটির স্বার্থকতা। স্বীকৃতি আমি দিচ্ছি না, ২০০৭ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের এক জরীপে দর্শক, চলচ্চিত্র সমালোচকদের ভোটে এটি সবার সেরা ১০টি বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের তালিকার মধ্যে শীর্ষস্থান লাভ করেছে।
মুভিটি মূলত কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত। প্রথম অংশে দেখা যায়, কিশোরী বাসন্তী (কবরী) বিয়ের বয়স হতে থাকে। বড় হতে থাকে । সে তিতাস পাড়ে অপেক্ষায় থাকে খেলার সাথী কিশোর চন্দ্র আর সুবলের জন্য। ওদিকে কিশোর আর বন্ধু সুবল এক সময় বড় হয়ে দূর নদীতে জাল বাইতে যায়। তিতাস পাড়ের গ্রামে মালোদের দোল এর সময় এক ঝামেলায় সহযোগিতার জন্য ওরা মারামরিতে জড়িয়ে পড়ে। এতে মোড়লদের ঘরের এক মেয়ে রাজারঝি অজ্ঞান হয়ে যায়। এক আক্রমণকারী রাজারঝিকে আক্রমণ করলে কিশোর তাকে রক্ষা করে। এতে মোড়ল খুশি হয়ে রাজারঝির সাথে সাহসী কিশোরের বিয়ে দেয়। যে দিন বউকে নিজ গাঁয়ে নিয়ে যাবে, রাতে ডাকাতেরা নতুন বউকে চুরির চেষ্টা করে। নতুন বউ পানিতে ঝাপ দিয়ে নিজেকে রক্ষা করে। কিন্তু কিশোর রাতের আঁধারে তা দেখতে পায় না। এই ঘটনায় কিশোর পাগল হয়ে যায়। আর নতুন বউ নদীতে ভেসে যায়। এরপরের ঘটনা চরম নাটকীয়তা মোড় নেয়। আবহমান গ্রাম বাংলার দারিদ্র্য ও শোকেজর্জর এক জনপদের বাস্তবিক দলিল চোখের সামনে মুহুর্মুহু আনন্দ বেদনায় দর্শককে নিয়ে চলে সেই তিতাসের পাড়ে। চরিত্রগুলোর অভিনয় নৈপুন্য, আবহ সংগীত, কলাকুশলীদের অসাধারণ দক্ষতা পরিচালকের ক্ষুরধার মেধার স্বাক্ষর তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রটি।
কাজলভরা চোখের সদ্যবিবাহিত বঊ হারিয়ে কিশোর ( প্রবীর মিত্র) পাগল হয়ে যায়। পরবর্তীতে তার বঊ বেঁচে গর্ভের সন্তান সমেত তার গ্রামে ফিরে আসে। কিন্তু কি নির্মম প্রহসন কিশোর তাকে চিনতে পারে না। দশ বছর পরে ছেলে অনন্ত সহ ফিরে আসা রাজারঝি আপন পরিচয় গোপন করে যাতে ডাকাতের হাত থেকে ফিরে আসা বঊকে কেউ ক্ষতির কারণ না মনে করে।
বিধবা বাসন্তীর সাথে রাজারঝির বন্ধুত্ব
রাজারঝির অন্ন বস্ত্রাদির অভাবে পাশে এসে দাঁড়ায় বাসন্তি। সইয়ের ছেলেকে আপন করে বড় করতে থাকে। আর চোখের সামনে থাকা পাগলের কর্ম দেখে রাজারঝি তাকে পিঠা বানিয়ে খাওয়ায়। পাগল তবুও তার নিজ ঘরণীকে চিনতে পারে না। এমন করে একসময় পাগল তাকে চিনতে পারে। কিন্তু ঠিক তার পরেই তাকে তার স্ত্রীকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়।ছেলে অনন্ত বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। মায়ের মুখ খুঁজে মালোপাড়ার প্রতিমায়। ঘরভাঙা পাখির মত নদীর পাড়ে রাজারঝি কিশোর অনন্ত বাসন্তীরা এভাবেই ছটফট করতে থাকে! এখানে যেন প্রাণ এই আছে, এই তো নেই!
পুনশ্চঃ
অদ্বৈত মল্ল বর্মনের অবিস্মরণীয় উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ তিতাস পাড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাট এলাকার মৎসীজীবী সম্প্রদায়ের যাপিত জীবন যার উপজীব্য। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফাউন্ডেশন তাদের আর্কাইভে সংরক্ষণ করেছে ঋত্বিক কুমার ঘটকের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘তিতাস একটি নদীর নাম" চলচ্চিত্রটি।
মুভি লিংকঃ https://youtu.be/aRs_Md0yHoo
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩৩