(বেশ অনেকদিন আগে নিজের শৈশবের গল্প শেয়ার করেছিলাম ব্লগে। সেটা ছিল মাতৃভূমি পর্ব। আর শেষে লিখেছিলাম 'চললেও চলতে পারে'। আজ নিজের ব্লগ স্ক্রল করতে সে লেখা চোখে পড়তে নস্টালজিক হয়ে পড়লাম আর মনে হল অসমাপ্ত রেখে কি লাভ! লিখেই ফেলি নাহয়! তারই ধারাবাহিকতায় অনেকদিন পর আজকের এ পর্ব।)
......তারপর একদিন দূর আরব দেশে পাড়ি জমানো৷ আমূল ভিন্ন পরিবেশ। পাড়া বেড়ানো দুরন্ত চঞ্চল মেয়েটা চার দেয়ালে বন্দী হয়ে গেল। খোলা আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিটা বদ্ধ খাঁচায় ডানা ঝাপটায়। সবুজের বুকে খেলে বেড়ানো মেয়েটা এখন যেদিকে তাকায় কেবল ধু ধু মরুভূমি। আশেপাশে তেমন পরিচিত মানুষজনও নেই। তবু শৈশব কোন বাধা মানেনা৷ সবখানেই আনন্দের উৎস খুঁজে বের করে।
সেই ছোট্ট পরিসরেই শিশুমনের খোরাক জোগাড় করা শুরু করলাম। নতুন খেলার সঙ্গী হল ছোট বোন। বাইরে খেলার বদলে এবার এলাম অন্দরে। বাবার সাথে বের হলেই দু'বোন মিলে পুতুল, পুতুলের ঘর, ছোট ছোট হাঁড়ি-পাতিল, চুলা, খেলনা বাঁশি যা যা পাই সব এনে ঘর ভর্তি করতে লাগলাম। আর বাসার পাশের দোকানে একধরনের ডিমাকৃতির খেলনা পাওয়া যেত। অনেকটা এখনকার 'কিন্ডার জয়ে'র মত। তার ভেতরে ছোট ছোট নানারকম খেলনা আর চকলেট থাকত৷ বাইক, মানুষ, চৌকি, আরো কি কি যেন। আমাদের খেলার মূল উপকরণ ছিল সেগুলো। বাবার সাথে বের হলেই দু'বোনের অন্তত দুটো তেমন ডিম কিনতেই হত৷ সোফার সবগুলো ফোম আর খাটের সব বালিশ নামিয়ে সেগুলো দিয়ে ঘর বানানো হত৷ তার ভেতরে দু'বোন কুটকুট করে গল্প করতাম আর সবগুলো খেলনা দিয়ে খেলতাম। খেলতে খেলতে কখন সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেত টেরই পেতাম না৷ মাঝে মা এসে দুটো ভাত দু'বোনের মুখে গুঁজে দিতেন৷ আর সন্ধ্যা হলে খেলাঘর ভেঙ্গে দিয়ে পড়তে বসাতেন। এগুলো সেসময়ের কথা যখন সেখানে যাবার পর কয়েক মাস স্কুলে ভর্তি হইনি। সেসময় বাসায় টিভিতে ডিশলাইন ছিলনা। আরবী চ্যানেলে খুব সকালে কার্টুন দেখাতো। বেশ রাত করে ঘুমালেও কি করে যেন আমরা কার্টুনের সময়টা টের পেয়ে যেতাম। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে টিভির সামনে বসে যেতাম। বাবা বাসায় থাকলে টিভির আওয়াজে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর অপরাধে মাঝেমধ্যে বকুনিও খেতে হত।
লোহিত সাগর আমাদের শহরের খুব কাছে হওয়ায় প্রায়ই ছুটির দিনে সবাই মিলে সাগর পাড়ে ঘুরতে যেতাম। কখনওবা প্রতিবেশি দু' এক পরিবার মিলে পিকনিকে যেতাম। একেকজন একেক আইটেম রান্না করে নিয়ে যেত। তারপর সাগরের তীরে চাদর বিছিয়ে সবাই মিলে জম্পেশ আড্ডা দিত, তারপর খাওয়াদাওয়া। আর আমরা ছোটরা ছোটাছুটি করে বেড়াতাম। দোলনার দখল পাওয়ার জন্য দোলনার আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম। নাহয় বালি দিয়ে উঁচু ঢিবি বানাতাম। মাঝে মাঝে শিশুপার্কে যেতাম। বিভিন্ন রাইডে চড়তাম। একটা রাইড ছিল চায়ের কাপ-পিরিচ। সবগুলো কাপ-পিরিচ একসাথে ঘুরতো আবার আমরা যে কাপে বসতাম সেটাও আলাদাভাবে ঘুরত৷ আরেকটা ছিল আপেল আর পোকা। এটা আসলে ছোটদের রোলার কোস্টার। আরেকটা পছন্দের রাইড ছিল নৌকা। এমন আরো কত কি! নাহয় এমনি খোলা কোন পার্কে যেতাম। মা-বাবা চাদর বিছিয়ে বসে থাকতেন আর আমরা দৌড়াতাম, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম, দোলনায় দোল খেতাম৷ সে দেশে ছুটির দিন মানেই ছিল এমন ঘুরে বেড়ানো। মাঝে মধ্যে বাবা মায়ের সাথে উমরাহ করতে যেতাম। সেসময় একবার হজ্জ করেছিলাম। সেই স্মৃতিও কিছুটা মনে আছে। বাবা সুমাকে কাঁধে আর আমাকে এক হাতে শক্ত করে ধরে রাখতেন। একবার এমন ধূলা ঝড় হল! সামনে কিচ্ছু দেখা যায় না। সম্ভবত তখন আমরা কাবা শরিফ তাওয়াফ করে নিজেদের তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। পথিমধ্যে এ ভয়ংকর অবস্থা। তাড়াতাড়ি একটা কিছুর আড়ালে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। আর মনে আছে বাবা মানা করা সত্বেও অনেকটা জিদ করে মানুষের ভীড়ের মধ্যে বাবার সাথে শয়তানকে পাথর মারতে গিয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকে মায়ের মুখে এসব গল্প শুনে খুব আগ্রহ জন্মেছিল। আমার ছোট ভাইটা তখনও পৃথিবীতে আসেনি।
ছোট ভাইয়ের জন্মের সময়েরও একটা মজার ঘটনা আছে৷ যখন জানতে পেরেছি আমাদের ঘরে নতুন মেহমান আসবে তখন একদিন এক প্রতিবেশি আন্টি জিজ্ঞেস করলেন আমি ভাই চাই নাকি বোন চাই। আমি নির্দ্বিধায় বলে দিলাম বোন চাই। আমার আরো খেলার সাথী চাই যে! ভাই হলে তো আর আমার সাথে খেলবেনা তখন তাই মনে হত। বাইরে গিয়ে অন্য ছেলের সাথে খেলবে অন্য সব ছেলেদের মত৷ তাছাড়া আমাদের সামনের ফ্লাটে তখন আমাদের সমবয়সী একটা ছেলে ছিল। ওর সাথে আমাদের দু'বোনের একটুও বনতো না। প্রায়ই সেই ছেলে আমাদের প্রিয় কোন খেলনা হাতের কাছে পেলে বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে দিত। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাও ভাই না চাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল। পরে অবশ্য কেউ যদি বলত ভাইকে নিয়ে যাবে তখন খুব রাগ হত। যাচ্ছে তাই শুনিয়ে দিতাম!
প্রবাসে শৈশবের আমার প্রিয় আরেক স্মৃতি হচ্ছে বাবার কর্মস্থল ঘিরে। বাবা তখন একটা হাসপাতালের একাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। হাসপাতালের পাশেই আমাদের বাসা। হাঁটার দুরত্ব। প্রায়ই বাবা আমাদের সাথে করে নিয়ে যেতেন। হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা আমাদের খুব আদর করতেন। নিজের বাসার মতই সাচ্ছন্দ্যে আমরা হাসপাতালে ঘুরতাম ফিরতাম। ওয়েটিং এরিয়ায় একটা ফ্রীজ ছিল। সেই ফ্রীজ থেকে আমাদের যখন মন চাইতো যে কোন জুস নিয়ে খেয়ে নিতাম। সব ফ্রী ছিল আমাদের জন্য। ক্যান্টিনের চিপ্স, স্যান্ডুইচ-বার্গারও। বাবা নিশ্চয়ই পরে বকেয়া শোধ করে দিতেন। হাসপাতাল ছিল তখন আমাদের দ্বিতীয় ঘর! হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে একটা ফার্মেসী পড়ত। সেই ফার্মেসীতেও কেন যেন আমাদের খুব যাওয়া হত। সেখানে ঢুকতেই গেটের মুখে সিলিং থেকে বড় একটা ওষুধের বিজ্ঞাপন ঝুলত। সেই বিজ্ঞাপনটা এমন ছিল যে একটা লোকের ঘাড় থেকে মই বেয়ে কতগুলো লোক তার মাথায় উঠে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। প্যারাসিটেমলের বিজ্ঞাপন। খুবই ইন্টারেস্টিং। সেই বিজ্ঞাপন আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। ছবিটি দেখতাম আর কত কি যে মনে মনে ভাবতাম। কেমন করে লোকগুলো মাথায় উঠল! ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে না কেন! আহ, না জানি কত কষ্ট হচ্ছে লোকটার! আমারো বুঝি মাথা ব্যাথা হলে এমন কতগুলো অদৃশ্য লোক মাথায় উঠে হাতুড়ি দিয়ে পেটায়!
সেসময় একা একা থাকার কারণেই বোধহয় বেশ কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠেছিলাম৷ আমার একটা হাতঘড়ি ছিল গোলাপি রঙের। খুব সুন্দর আর আমার খুব পছন্দের। ঘড়ির মাঝখানে একটা মেয়ে তার পোষা কুকুর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমন একটা কার্টুন ছিল। আর পানি, স্টার, ছোট ছোট বল আরো কি কি যেন ছিল ভেতরে। গোসলে যাওয়া ছাড়া সারাক্ষণ আমি সেই ঘড়ি হাতে পরে থাকতাম। আর সেই কার্টুনগুলোকে নিয়ে কল্পনার জগতে হারিয়ে যেতাম। আমার মনে হত যেন সেই মেয়ে কুকুর নিয়ে হাঁটছে৷ কত কথাও যেন বলছে। সব যেন আমি দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি। আরেকবার সাগর পাড়ে গিয়ে উটের পিঠে চড়েছিলাম। ছোট বোন ভয় পাচ্ছিল। তাই আমি একাই সওয়ারী হয়েছিলাম। উটের পিঠে নৌকার ছইয়ের মত একটা ছাউনি থাকে। তার ভেতরে বসিয়ে দেয়া হয়। তারপর উটপালক উটটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় আর হাঁটার সাথে সাথে সওয়ারী ডানে-বাঁয়ে মৃদু দোল খায়। ছাউনির ভেতরে আসলে কোন খেলনা ছিল কিনা আমার মনে নেই। কিন্তু আমার একটু একটু মনে আছে যেন আমি কিসব নিয়ে ওখানে খেলছিলাম। আর আমার মনে হচ্ছিল লিলিপুটের মত কতগুলো মানুষ, জন্তু-জানোয়ার এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে৷ দু'একটা মনে হল যেন লাফ দিয়ে কিংবা মৃদু দোলের কারণে নিচেও পড়ে গেল। তার জন্য আবার আমার খুব দুঃখও হচ্ছিল। অনেক বছর পর্যন্ত আমি এগুলোকে সত্যি বলেই বিশ্বাস করতাম। একটু বয়স হবার পর বুঝেছি এগুলো সব আমার অবুঝ মনের নিছক কল্পনা ছিল!
এমন করেই সমুদ্রের লোনা ঢেউয়ে ভেসে, মরুর বুকে উট আর ঘোড়ার পিঠে চড়ে, পার্কের দোলনায় দোল খেয়ে কেমন করে কখন যে শৈশব পেরিয়ে গেল, সেই সরলতা আর উদ্যম চঞ্চলতা হারিয়ে গেল, সেই খেলাঘর একেবারে ভেঙ্গে গেল টেরই পাইনি!
২২. ০৪. ২০২১
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ গুগল
মাতৃভূমি পর্ব
শৈশব নিয়ে আরেকটি পোস্ট
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৩