মানুষের শৈশব এত কিউট হয় কেন! একেকটা বাচ্চার শৈশব একেকরকম সুন্দর। এখনকার বাচ্চারা এদিক দিয়ে ভাগ্যবান যে তাদের শৈশবের প্রতিটা স্মৃতি খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা যায়। ছবি তোলা, ভিডিও করা এতটাই সহজলভ্য যে বাবা মা সারাক্ষণ বাচ্চার সুন্দর সময়গুলো ক্যামেরাবন্দী করে রাখছে। আমাদের শৈশবে এসব ছিল একেবারেই দুর্লভ। যখন ছোট ছিলাম তখন বাবা দেশের বাইরে থাকতেন। আমরা নানুবাড়ি। বাবা দেশে এলে টেপরেকর্ডারে আমার কথা রেকর্ড করে নিয়ে যেতেন। যখন আমি কাছে থাকব না তখন শোনার জন্য। আবার কেউ দেশ থেকে যাওয়ার সময় মাকে বলতেন আমার কথা রেকর্ড করে পাঠানোর জন্য৷ তেমনি একটা ক্যাসেট বাবার পুরনো লাগেজে খুঁজে পেলাম। কয়েকটা ছবিও খুঁজে পেলাম সে সময়ের। কি ছোট্ট আমি। ফ্রক, ঝুঁটি আর জুতো মোজা পরে বাবা মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বা মায়ের কোলে নাহয় বাবার। কী কোমল ছোট্ট একটা মুখ। আমার বিশ্বাসই হতে চায়না এ আমি। কেউ বলে না দিলে কথাগুলোও শুনে বুঝতে পারতাম না এ যে আমার কন্ঠ। ছোট্ট একটা মেয়ে আধো বোলে কথা বলছে৷ কী প্রাণোচ্ছল হাসি!
ধুলোজমা পুরনো ক্যাসেটপ্লেয়ারটা ঝেড়েমুছে প্লাগইন করে ক্যাসেটটা প্লে করলাম। মুহূর্তে আমি শৈশবে চলে গেলাম। পুনরায় আমার শৈশব যাপন করলাম। আমার তিন বছর বয়সের রেকর্ডিং। বাবা মেয়ের কত কত গল্প। আমার আধো আধো বোল। একটু পরপর খিলখিল হাসি। আপনমনে কথা বলা। কথার ফাঁকে ফাঁকে আটকে যাই৷ মাঝে মাঝে এ্যাঁ এ্যাঁ করি। শুরুতে বাবা সময় রেকর্ড রাখার জন্য সেদিনকার তারিখ বলছিল। বাবা বলছে '১০....(তারিখ)' আমি পাশে বসে বলে চলেছি 'দস এগালো বালো....' নিজেকে খুব লাকি মনে হচ্ছিল ছোটবেলার এ রেকর্ডিং আছে বলে। এ রেকর্ডিংয়ের বদান্যতায় আমার ছোটবেলা কখনো হারিয়ে যাবেনা৷ কিছু কিছু কথাবার্তা ছিল খুব মজার। বাবা বলছে 'তোমার খালামনিদের নাম বলতো।' আমি বলা শুরু করলাম 'আমাল মুন্না খামনির নাম মুন্না লুনা খামনির নাম লু.......না' এভাবে চাচা মামা সবার নাম। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল 'তোমার মুন্না খালামনি তোমাকে কি ডাকে?' বললাম 'মনাপাখি ডাকে৷ লুনা খামনি ডাকে ককিজা(কলিজা) আর লিমা খামনি ডাকে কুইয়্যা মনা(এর মানে আমিও জানিনা। খালামনিকে জিজ্ঞেস করতে হবে)'। বলে খিকখিক করে হাসি। তারপর বলি 'অনিক্যা ডাকে সাম্যা (নিজে নামকে এভাবে ডাকলে সমস্যা নেই। অন্যজন ডাকলে খারাপ)। সায়মা বলতে পারেনা৷' আবার খিকখিক হাসি। মুহুর্তে গম্ভীর হয়ে বলছি 'আরো বলে আমি নাকি পঁচা। আদনান আমাকে বলে থাম্যা। আপুও তো বলতে পারেনা। আর ফাতেমা বলে আপা (খুব গর্বিত কন্ঠে)। আপু বলতে পারেনা।' খিকখিক। 'আবার আমার জেঠাকে আব্বুও বলে।' এক কথা থেকে ট্র্যাক চেঞ্জ করে হাজার কথায় চলে যাই। কী নিষ্পাপ কথামালা। আর কত নির্মল হাসি। আর একটু পরপর অনিক ভাইয়ার নামে অভিযোগ। 'অনিক আমাকে লিকশায়(ট্রাইসাইকেল) বসতে দেয়নি। আমাকে লিকশা থেকে ফেলে দিয়েছে। আমি একটা লিকশা নিলে ওকেও বসতে দিবনা।.......আমাল চেইন হালাই ফেলছে ( যত দোষ নন্দ ঘোষ)।' আরো কত কি!
বাবা একবার জিজ্ঞেস করল 'তোমার নানু বাড়ি কোথায়?' আমি বললাম 'ওই যে আমার নানাভাইয়ারা থাকে যে?ওইটা আমার নানাবা.....ড়ি।' মাঝে আবার বাবাকে গালে, নাকে, চকে (চোখে) আদর দিই। কত আহ্লাদ। তারপর যখন বাবা বলল 'আব্বু বিদেশ চলে গেলে তুমি কান্না করবা?' আমি অভিমানে গাল ফুলিয়ে বললাম 'আমি আপনাকে চাঁনমামা দিবনা।' আব্বু হেসে বলে 'চাঁদমামা দিবানা?' আমি বলছি 'না। আমি লুকাই রাখব আপনি খুঁজেও তো পাবেননা।' এখন ভাবি এত ছোটবেলায় আমার মাথায় এমন কথা এলো কি করে। তখন আমি খুব ফ্যান্টাসিতে ভুগতাম মনে হয়। আবার মায়ের নামে বিচার দিচ্ছি 'আম্মু আমাকে মালে৷' 'কেন মারে?' 'আমি যে আম্মুকে জ্বালাই।' 'জ্বালাও কেন?' 'আম্মু যে আমাকে মালে তাই।' যদিও অডিও তবুও আমি যেন ছোট্ট আমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কল্পনার চোখে৷ কখনো উচ্ছ্বল হাসি কখনো কপট অভিমান। আবার গান গাই 'আম্মু তুমি লক্ষীইইইই।' আরেকটা অডিওতে মা বলছে ছোটবোনের কান্না থামাতে। সেটা আরো কিছুদিন পরের। আমি গান গাই, 'ও সাথী.... যেওনা ককনো দূলে....।' আবার 'সুমান লক্ষীমনি' এটা সেটা বলে কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিই। বলি 'আম্মু আমি পারি না গো।' এমন আরো কত কত কথা!
অডিওগুলো টেপরেকর্ডার থেকে মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছি। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে রেকর্ডগুলো প্লে করে শুনি৷ তখন আমি সব ভুলে নিমেষে শৈশবে হারিয়ে যাই। হারিয়ে যাই সেসময়ে যখন কোন দায়িত্ব ছিলনা, দুশ্চিন্তা ছিলনা। যখন কি বললে বা করলে কে কি ভাববে তা ভাবতে হতনা। মনে যা আসত তা অকপটে বলে দেয়া যেত। মন যা চাইত নির্দ্বিধায় করে ফেলা যেত। যখন দুঃখ মানে ছিল প্রিয় খেলনা হারিয়ে যাওয়া কিংবা বন্ধু আর কাজিনদের সাথে আড়ি নেয়া। যখন পৃথিবী ছিল স্বপ্নময়। যেখানে আকাশ থেকে চাঁদ পেড়ে আলমিরার কোনায় লুকিয়ে রাখা যায়। আহা শৈশব। আহা আমার সরলতার দিনগুলো!
১৯.০৯.২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ ভোর ৪:১২