আমার শৈশবের বেশ ক'বছর কেটেছে একদম অজ পাড়া গাঁয়ে। আদর্শ গৃহস্থ বাড়িতে৷ চারদিকে গাছগাছালির জঙ্গল। ছোট ছোট টিনের চালার ঘর৷ মাঝে দু'একটা পাকা বাড়ি। শান বাঁধানো ঘাট। গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ। গোয়ালে গরু আর গরুর বাছুর, ছোট ছোট খোপে হাঁস, মুরগী আর কবুতর৷ হেমন্তে পাকা ধানের গন্ধে বাড়ি ম ম করত। উঠোন জুড়ে সেদ্ধ ধান শুকোতে দেয়া হত৷ আমাদের ছোটদের দায়িত্ব ছিল দাওয়ায় একটা লম্বা লাঠি নিয়ে পাহারা দেয়া মুরগী কিংবা কাকে ধান খেয়ে ফেলল কিনা। আবার বড়দের দেখাদেখি মাঝে মাঝে ধান মাড়াই দিতাম। তখন নিজেরাই দৌড়ানি খেতাম। শীতের সকালে সবাই মিলে হৈ চৈ করে গরম গরম ভাপা পিঠা,নারকেলের পিঠা আর খেজুর রসের পায়েস খাওয়া। জৈষ্ঠ্যে প্রায় ভোর রাতে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই ছোট খালামনির সাথে আম কুড়াতে যেতাম। আলো আঁধারিতে ঠিক মত ঠাওর করা যেত না। তবু দু'একটা চোখে পড়ে গেলে দৌড়ে গিয়ে তুলে এনে টুকরিতে রাখতাম। কাঁচাপাকা, ছোট-বড়, ফেটে যাওয়া, কাদায় মাখামাখি গুটিকয়েক আম পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ফিরতাম। আবার বাড়িতেই লাকড়ির চুলায় মুড়ি ভাজা হত। নানু একটা ইয়া বড় মাটির হাঁড়িতে বালি গরম করে তাতে চাল দিয়ে কলাপাতার ডাল দিয়ে নাড়তে থাকতেন। কিছুক্ষন পর কী সুন্দর মুড়ি ফুটে যেত! দেখতেই এত ভালো লাগত। তারপর গরম গরম কিছু মুড়ি থেকে বালি ছেঁকে আমাদের ছোটদের খেতে দেয়া হত। নানাবাড়িতে সারি সারি নারকেল-সুপুরি গাছ ছিল। নারকেল ভেঙ্গে তেল নেয়া হত। একদম খাঁটি নারকেল তেল। তেল নেয়ার পর নারকেলের অবশিষ্টাংশ থেকে একজাতীয় খাবার তৈরি হত। দারুন সুস্বাদু। সবাইকে দেয়ার পরও আরেকটু নিয়ে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতাম৷ প্রতিদিন ভোরে নানাভাই গরুর দুধ দুইতে বসত। আমরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতাম। কাছে গেল গুঁতো খাওয়ার ভয় ছিল। গরুকে খড়ের গাদা থেকে খড় নিয়ে খেতে দিতাম। কাজের ছেলেটা গরু চরাতে নিলে আমরাও পিছু পিছু যেতাম। মাঠে গরু বেঁধে সবাই মিলে কানামাছি খেলতাম। সপ্তাহান্তে পুকুরে বড় জাল ফেলে মাছ ধরা হত। নানাভাই দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করতেন। আমরা সবাই বড় বড় চোখ করে গুনতাম কয়টা মাছ ধরা পড়ল। আবার কখনো নিজেই বড়শিতে মাছ ধরতে যেতাম। যদিও কখনো তেমন সুবিধা করতে পারতাম না। তবু হঠাৎ দু'একটা পোনা ছিপে ধরা দিলে খুশিতে টগবগ করতাম। নানাভাই চেম্বারে যাবার পর ছোট খালামনি রেডিও চালু করে দিত। সেখানে একের পর এক আধুনিক গান বাজতে থাকত। কোন অর্থ বুঝে না এলেও সে গানগুলো হয়ে উঠত ভীষণ প্রিয়। সারাদিন কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব থাকত বাড়ি জুড়ে৷
খুব ভোরে ঘুম ঘুম চোখে মক্তবে আরবী পড়তে যেতাম। বয়স পাঁচে পড়তেই মা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। কী করে যেন আমার ধারনা হয়েছিল স্কুলটা আমার নানাভাইদের৷ বড় খালামনি সে স্কুলেই শিক্ষকতা করতেন। তার উপর বাড়ির গন্ডি পেরুলেই স্কুল। বেশ কিছুদিন এ ভ্রান্তিতে ছিলাম। স্কুলে সবার সাথে খুব বাহাদুরি করে বেড়াতাম। আমার দাপটে কারো টেকার জো ছিলনা৷ বাবা তখন দেশের বাইরে ছিলেন। মা শিক্ষকতা করতেন। বাড়ি ফিরতে প্রায় বিকেল। তাই শাসন বারনের বালাই ছিলনা৷ আমার বেড়ে ওঠা নানু আর খালামনিদের মাঝে। একবার অঙ্ক কষতে ভুল করায় ছোট মামা চোখ রাঙিয়েছিলেন। পিঠে কয়েকটা উত্তম মধ্যমও বোধহয় পড়েছিল। এরপর থেকে ভয়ে আর অভিমানে মামার তেমন একটা কাছে ঘেঁষতাম না। এমন আরেক ভীতি ছিল বড় খালু। চাকরির সুবাদে তিনি ঢাকাতেই থাকতেন। ছুটিছাটায় বাড়ি এলে দিনের বেশিরভাগ সময় খালাতো ভাইদের পড়ার তদারকি করতেন। আর বাকিসময় বাগানের গাছ দেখাশোনা করতেন। কোনক্রমে যদি উনার সামনে পড়ে যেতাম আমাকেও পড়তে বসিয়ে দিতেন। 'দেখি এই অংকটা কষে দে তো সায়েমা।' কিংবা 'ভোর হল' কবিতাটা শোনা তো খালুকে।' বা 'ইংরেজী কোন্ রাইম পারিস শোনা তো।' না পারতে কখনো খালুর সামনে পড়তাম না। উনার ঘরের সামনেই ছিল বাড়ির মূল উঠান। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে বসতেন সবসময়। দরজা হাট করে খোলা থাকত। ভয়ে আমি সেই ঘরের সামনে দিয়ে কোথাও যেতামনা। পুকুরে যাবার দরকার হলে বাড়ির পেছনের জঙ্গল হয়ে ঘুরপথে যেতাম। তবু খালুর সামনে পড়া যাবেনা। বেচারা অনিক ভাইয়ার জন্য করুণা হত তখন। আমার সারাদিন কাটত দুরন্তপনায়। ঢিল মেরে এর গাছ থেকে বরই, ওর গাছ থেকে লিচু পেড়ে খাওয়া। কারো গাছ থেকে ফুল এনে মালা গাঁথা। কেউ নানাভাইদের কোন গাছের ফল পেড়ে নিয়ে গেল কিনা পাহারা দেয়া৷ ধরতে পারলে আচ্ছামত শাস্তি দেয়া। নানাভাইদের ঘরের সাথে লাগোয়া দুটো পেয়ারাগাছ ছিল। আর কোন গাছে চড়তে না পারলেও অনেকগুলো ডাল থাকায় সেই গাছে চড়তে পারতাম। গাছ বেয়ে একটু উঠলেই ঘরের চালা নাগাল পাওয়া যেত। পেয়ারা পেড়ে সেখানে বসে বসে খেতাম। পাড়া বেড়ানো শেষে ফিরলে কোন এক খালামনি ধরে বেঁধে খাইয়ে দিত। বাড়িতে আমার সমবয়সী ছিল আম্মুর এক চাচাতো ভাই। আমার সব দস্যিপনার সঙ্গী ছিল আকিব৷ বাকিরা হয় বেশি ছোট নাহয় বেশি বড়৷ ছোটদেরকে পাত্তা দিতামনা আর বড়দের কাছে পাত্তা পেতাম না৷ তা এ দু'জনই সই৷ দু'জন মিলে এক্কা-দোক্কা, দড়ি লাফ আর মিছামিছি চড়ুইভাতি খেলতাম। মাঝে মাঝে নিউজপেপারে কাগজের তিমি, জাহাজ যা যা টিউটোরিয়াল পেতাম সব বানাতাম। সেসব বানানোর সময় আমাদের উৎসাহ দেখার মত ছিল। নাওয়া খাওয়া ভুলে সারাদিন সেসবে পড়ে থাকতাম।
নানাভাইদের বাড়ির পেছনে একটা বাগান ছিল আমাদের খেলার মূল জায়গা। নাম গাবদুলালী। যদিও সে বাগানে জন্মাবধি আমি কোন গাব গাছ দেখিনি। হাতিরঝিলে হাতি নেই, ধানমন্ডিতে ধান নেই সেরকম অবস্থা। বাগানটা ছিল চারদিক থেকে নারকেল গাছে ঘেরা আর এক কোনায় ছোট একটা খেজুর গাছ। সে গাছটা ছিল আমাদের রান্নাঘর৷ আশপাশ থেকে বুনোফুল, লতাপাতা জোগাড় করে এনে রান্না করা হত। বাগান শেষ হলেই দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত। আর তার ওপারে আমাদের পিকনিক বাড়ি। বাড়িটা আগে হিন্দুদের ছিল। শুনেছি মায়ের ছোট ফুফুর শ্বশুর স্বাধীনতার পর কিনে নেয়। বাড়ির নাম ধোপাবাড়ি। বাড়িতে হিন্দুদের পুরনো বাড়ি আর ভাঙ্গা মন্দির তখনো ছিল। আর বাড়িভর্তি ছিল নানান ফল গাছ। আম, আতা, আনারস, কামরাঙা, জলপাই আরো কত কী। মাঝে মাঝেই আমরা দলবল নিয়ে সে বাড়িতে হামলা দিতাম। ধানক্ষেতের কাদামাটির পথ ভেঙ্গে ধোপাবাড়িতে উপস্থিত হতাম। ছেলেরা গাছে চড়ে নানারকম ফল পেড়ে আনত। বড় গামলায় করে নুন-মরিচ এনে মাখিয়ে সবাই মিলে কাড়াকাড়ি করে খেতাম। বাড়ির দিঘীতে একটা নৌকা ছিল। খাওয়া শেষে নৌকা বাইতাম। মাঝে মাঝে সবাই মিলে সাঁতার প্রতিযোগিতা করতাম। তারপর আবার হৈ-হুল্লোড় করে বাড়ি ফেরা। সন্ধ্যা নামলে বড় খালামনি আমাকে আর অনিক ভাইয়াদের নিয়ে পড়াতে বসতেন। আকিবও মাঝে মাঝে আমাদের সাথে পড়তে বসত। একটু পড়তে না পড়তেই বিদ্যুৎ চলে যেত৷ এ ছিল রোজকার নিয়ম। তখন সবাই এক ছুটে উঠানে চলে যেতাম। চাঁদের আলোয় বরফ-পানি, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম। জোনাকির পিছে পিছে দৌড়ে বাগানে চলে যেতাম। তারপর কতগুলো জোনাকি এনে ঘরে ছেড়ে দিতাম। তারমধ্যে হারিকেন-কুপি জ্বালানো হলে খালামনি ধরে এনে আবার পড়তে বসিয়ে দিতেন। কিন্তু মন পড়ে থাকত জোনাক পোকায় আর লুকোচুপিতে। আবার কোন কোন দিন বিদ্যুৎ আসতে বেশি দেরী হলে বড়রা উঠানে পাটি পেতে বসত। আমরাও সুযোগ বুঝে গল্প শুনতে এক কোনায় বসে পড়তাম। গল্প শুনতে শুনতে হয়তো সেখানেই কারো কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।
তারপর একদিন দূর আরব দেশে পাড়ি জমানো। আমূল ভিন্ন পরিবেশ। পাড়া বেড়ানো দুরন্ত চঞ্চল মেয়েটা চার দেয়ালে বন্দী হয়ে গেল। খোলা আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিটা বদ্ধ খাঁচায় ডানা ঝাপটায়। সবুজের বুকে খেলে বেড়ানো মেয়েটা এখন যেদিকে তাকায় কেবল ধু ধু মরুভূমি। তবু শৈশব কোন বাধা মানেনা। সবখানেই আনন্দের উৎস খুঁজে বের করে। সেই ছোট্ট পরিসরেই শিশুমনের খোরাক জোগাড় করা শুরু করলাম.....
(চললেও চলতে পারে )
০৫.১২.২০১৮
ছবি: গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৩৬