প্রতিদিনের অভ্যাসমত সন্ধ্যায় চা বিস্কুট নিয়ে বসেছি। বাসার সবাই একটা পার্টিতে গেছে। আমার ইচ্ছে করলনা। হাতে একটা গল্পের বই। বই পড়তে পড়তে চায়ের কাপে চুমুক, এর তুলনাই হয়না। চায়ের টেবিলের স্বচ্ছ কাঁচের উপর অল্প অল্প বিস্কুটের গুঁড়া পড়ছে। হঠাৎ দেখি পায়া বেয়ে কয়েকটি পিঁপড়া উঠে আসছে। এরই মধ্যে বিস্কুটের গন্ধ পেয়ে গেছে বাবাজীরা। কয়েকটা মিলে একটা বড় বিস্কুটের কণা ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে। আরেকটা ছোট একটা কণা একাই মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি পড়া, খাওয়া বাদ দিয়ে তাদের কান্ড-কারখানা লক্ষ্য করছি।
'এমন হা করে কি দেখছো? আমাকে দেখার কি আছে!'
আরে, কে কথা বলল! রুমে তো আমি একাই! চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। নাহ, আর কেউ নেই।
'আরে এদিকে।'
টেবিল থেকে আওয়াজ আসছে। একা পিঁপড়াটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাকিরা বিস্কুটের কণা নিয়ে চলে গেছে।
'হ্যাঁ আমিই বলেছি।'
পিঁপড়াটা কথা বলছে নাকি! আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে নিশ্চয়। সাইকোলজি পড়ে মাথাটা গেছে। বইয়ে মনোযোগ দিলাম।
'বিশ্বাস হচ্ছেনা? আমরা কি কথা বলতে পারিনা নাকি?'
আবারো কথা বলছে দেখছি। তাকিয়ে দেখি আমার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম আমিও উত্তর দিয়ে দেখি। তাহলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়।
-আসলেই তোমরা কথা বলতে পারো?
-নাহয় কে বলছে? তোমার কী মনে হয় খোদা কি এমন একচোখা যে এক প্রাণী কে কথা বলতে দেবেন আর আরেক প্রাণী কে দেবেন না?
-তা ঠিক, তা ঠিক। তবে আর কখনো কথা বলতে শুনিনিতো তাই আর কী বিশ্বাস হচ্ছিল না।
- আমরা কি তোমাদের মত অকর্মার ঢেঁকি যে বকবক করে সময় নষ্ট করব? কত কাজ থাকে আমাদের!
- তাতো বটে। তা তোমরা এই শীতের সকালে বেরিয়েছো যে? আমি তো শুনেছি পিঁপড়েরা বছরের অন্যসময় খাবার সংগ্রহ করে রাখে শীতের জন্য। শীতের সময় বের হয়না।
- হাহাহা। ভালো পয়েন্ট ধরেছো। এটাই আমাদের দলের ট্রিক্স। বছরের অন্য সময় কে কার আগে কোথা থেকে খাবার সংগ্রহ করবে তার একটা প্রতিযোগিতা চলে। শীতে একচেটিয়া কারবার। আর তাছাড়া এ ঘরটা বেশ গরম থাকে তাই সমস্যা হয়না। সেজন্যই তো থাকার জন্য এ বাড়ি বেছে নেয়া।
-আচ্ছা তাই বলো! তা তুমি কি তোমার দলের রাণী?
-আরে নাহ। রাণী কি এতো তুচ্ছ যে এভাবে কোথাকার কোন মানুষের সাথে কথা বলবে? তিনি হচ্ছেন রাণী বুঝলে, রাণী। তোমাকে বলে কী লাভ, তুমি আর কী বুঝবে! যারা কাজের দাম দিতে জানেনা, সময়ের দাম দিতে জানেনা তারা পিঁপড়েদের রাণীর গুরুত্ব কী বুঝবে!
-কেন কেন? আমরা আবার কী করলাম!
-কী আর করোনি? এই যে ধরো আমরা সারি বেঁধে কোন একটা কাজে যাচ্ছি। তোমরা কী কর? লাইনের মাঝে বিশাল বিশাল আঙুল ঢুকিয়ে দাও। এটা কোন খেলা হল? নিজেরা তো ডিসিপ্লিন মেন্টেইন করই না, অন্যকেও করতে দেবেনা। কী যে বিরক্ত লাগে। আর তাছাড়া একই বাসায় থাকি। কোথায় মিলেমিশে থাকব, তা না তোমাদের শুধু আমাদেরকে তাড়ানোর ফন্দি। সেদিন দেখলাম তোমার বাবা একটা ইন্সেক্ট কিলিং স্প্রে নিয়ে এসেছে। হুহ। (গলার স্বরে মহাবিরক্তি)
-তোমরা আবার এতো কিছুও খেয়াল কর?
-করবনা? এটা নিয়ে কাল কাজে যাবার পথে একটা তেলাপোকার সাথেও কথা হল। তাদেরও একি কথা। এক জায়গায় যেহেতু আছি কিসের এতো জেলাসি? যে যার মত থাকিনা!
- তুমি তো দেখি ভালোই ইংলিশ জানো। তোমাদেরও পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে নাকি!
- তা আর বলতে! তোমার কেন ধারণা হল একমাত্র তোমরাই শিক্ষিত হও? আমাদেরও শিক্ষা ব্যবস্থা আছে বটে। তোমাদের চেয়েও উন্নত বলতে পারো।
-খুব ভালো, খুব ভালো। তুমিতো বেশ জ্ঞানী মনে হচ্ছে। একেবারে দার্শনিকের মত কথাবার্তা।
- জ্ঞানী তো অবশ্যই। সেদিন শুনলাম তোমার ভাইকে জাফর ইকবালের একটা সায়েন্স ফিকশন শোনাচ্ছ। আমাদের ব্যাপারে।
- ওই যে এলিয়েনরা পৃথীবির সবচেয়ে জ্ঞানী এবং সুশৃঙ্খল প্রাণী হিসেবে পিঁপড়েদের চিহ্নিত করে। সেটা?
- হ্যাঁ। তাহলে ভাবো? এলিয়েনরা পর্যন্ত আমাদের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে, শুধু তোমরা মানুষেরাই মানতে চাওনা। মনে কর নিজেরাই মহাজ্ঞানী।
-আরে সেটা তো গল্প। বাস্তব তো না।
-হোক গল্প। গল্প তো জীবন থেকেই হয়।
-তাও ঠিক। আচ্ছা অনেকদিন থেকে তোমাদের মত ছোট প্রাণীদের ব্যাপারে একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ যখন তোমার সাথে কথা হচ্ছে জিজ্ঞেস করেই ফেলি।
-হ্যাঁ, বল বল কী প্রশ্ন। সমস্যা নেই।
-ইয়ে, মানে আমাদের মানুষদের তো সবার চেহারা আলাদা আলাদা হয়। তাই চিনে নিতে পারি। তোমরা কিভাবে আলাদা কর একজন থেকে আরেকজনকে?
- ও এই কথা। কী যে বলনা! তোমাদের দৈত্যের মত চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা এগুলোকে চেহারা বলে নাকি! আমার কাছে তো একই রকম মনে হয়। কপালে স্যাঁতসেঁতে দুইটা বল। তার নিচে একটা লাঠি আবার তার মধ্যে দুইটা ছিদ্র। মুখের ভেতর আবার সারি সারি পাথর বসানো। এটা কোন চেহারা হল? ছ্যাঃ!
- এহেম এহেম!
- ওহ কিছু মনে কোরোনা। আমার কাছে তো এমনই মনে হয়। অথচ আমাদের চেহারা কত সুন্দর হয়। আমার গার্লফ্রেন্ডের কথাই ধর। আহ কি মিষ্টি মুখ! দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
- তোমার আবার গার্লফ্রেন্ডও আছে নাকি!
- আবার জিগায়! থাকবেনা কেন? ভালো কথা মনে করেছো এতক্ষণে নিশ্চয় খোঁজ পড়ে গেছে। কখনো এতো দেরী হয়না তো। দেখি এক ফোঁটা চা দাওতো। একটু আয়েশ করে খাই। কথা বলতে বলতে গলাটা শুকিয়ে গেল। তোমরা মানুষেরা এতো প্রশ্ন করতে পার! কাজের কাজ কিছুনা খালি প্রশ্ন। এজন্যই তোমাদের কখনো উন্নতি হবেনা।
আমি খোঁচাগুলো হজম করে নিয়ে এক ফোঁটা চা টেবিলে ঢেলে দিলাম। খাক বেচারা। আসলেই মনে হয় গলা শুকিয়ে গেছে। আমার তো ওর কথা শুনেই গলা শুকিয়ে গেল। আস্তে ধীরে চা শেষ করে রওনা দিল।
- ধন্যবাদ। যাই এবার। রাণীমা টের পেলে ঠ্যাং ভেঙে দেবে। উনি আবার ফাঁকিবাজি একদম পছন্দ করেন না। কে জানে হয়তো এতক্ষণে তলব পড়ে গেছে।
- আবার এসো। গল্প করা যাবে। তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল। অনেক কিছু শিখলাম। আসলে আগে তোমার মত এমন জ্ঞানী পিঁপড়ার সাথে পরিচয় হয়নি তো।
- ব্যাপার না। সময় পেলে আসব আবার তোমার সাথে গল্প করতে। যদি সময় পাই আর কী! তুমি মিলেমিশে থাকার ব্যাপারটা একটু মাথায় রেখো।
- আলবৎ!
১০.০১.২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:৩৩